
মনোরি
সায়েন্স ফিকশন ৪
তৌফিকুল ইসলাম পিয়াসপ্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০২০
আমি আর কোনও উত্তর খুঁজে পেলাম না। সিসিলিয়া আমার বাঁ হাতটি ধরে রেখেছে। মুন ঠিক এভাবেই আমার হাত ধরে রাখতো। মুনের সঙ্গে সিসিলিয়ার বেশ কিছু মিল দেখতে পাচ্ছি। মুনও অনেক লম্বা ছিল।
আমরা আবার আমার রুমে ঢুকলাম। সোফায় বসলাম। সিসিলিয়া জিগেশ করল, দুপুরে আজ কি খাবেন? আমি আপনার সঙ্গে লাঞ্চ করবো। আমি জবাব দিলাম, কি খাব কিভাবে বলবো? আমি তো জানি না।
সিসিলিয়ার মুখের হাসিটা এত সুন্দর কেন? আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। মুখে সেই অসহ্য সুন্দর হাসি ধরে রেখেই বলল, আপনি যদি চান তাহলে আজ দুপুরে আপনাদের দেশি রুটি, ভাত এবং চিকেন মাসালা অর্ডার করা যাবে। কাছেই একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট রয়েছে। অর্ডার করবো?
আমি মাথা ঝাকালাম। সিসিলিয়া বলল, আপনাকে আজই এই হসপিটালের বাইরে যাবার অনুমতি দেয়া হবে। ডিনার আপনি বাইরে গিয়েও খেতে পারবেন। আপনি একটু বসুন আমি আপনার খাবারের ব্যবস্থা করে ফিরছি।
সিসিলিয়া চলে গেল। আমি বাথরুমে ঢুকলাম।
ভদ্রলোক সাড়ে ছয় ফুট লম্বা। বিশাল শরীর। হোয়াইট। পুরু গোফ, সাদা। মাথার চুলগুলিও শতভাগ সাদা। সাদা সার্টের সঙ্গে একটা লাল টাই পরেছেন। কালো সুটে দারুণ দেখাচ্ছে। আমার সঙ্গে হাত মেলালেন। বললেন, আমি ড. জর্জ জেফারসন। এই হসপিটালের সিইও ও প্রেসিডেন্ট। আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি উদ্গ্রীব হয়ে আছি কয়েক সপ্তাহ। আপনাকে আমি এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার দেখে গিয়েছি। প্রতিবারই আপনি ‘শীতনিদ্রা’য় ছিলেন। আপনাকে আজ এভাবে দেখে আমি অভিভূত। আজ এই দিনটির জন্য আমি অপেক্ষায় ছিলাম দীর্ঘ ২২ বছর। আপনাকে এই পৃথিবীতে আবারও স্বাগতম।
থ্যাংক ইউ। আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না আমার। ড. জেফারসন কথা বলেই যাচ্ছেন, মিস্টার ইভান, আপনি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। আপনার চিকিৎসা গবেষণায় নিয়োজিত বোর্ড সার্বক্ষণিক রিপোর্ট আমাকে উপস্থাপন করেছে। আপনি চমৎকার রয়েছেন। সে যাই হোক। আপনার মানসিক অবস্থা যেন শতভাগ সুস্থ থাকে, সেজন্য আমি আপনাকে কিছু কথা বলবো এবং কিছু তথ্য দেব।
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। সিসিলিয়া আমার ডানপাশে বসেছিল। ও আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। আমার বাম হাতের কনি আঙুলে হালকা চিমটি কাটলো। চিমটি এতটা আনন্দদায়কও হয়!
মিষ্টার ইভান। আপনাকে আজ ডিসচার্জ করা হলো। কিন্তু আপনি চাইলে আরও এক সপ্তাহ এই রুমটাতেই থাকতে পারবেন। আপনি সম্পূর্ণ স্বাধীন চিন্তা করে যা মন চায় তাই করবেন। আপনাকে কিছু কথা বলা অত্যন্ত জরুরি। সিসিলিয়া আপনাকে অনেক তথ্য শেয়ার করবে। কিন্তু আমার মুখ থেকেও আপনার কিছু কথা জানতে হবে।
ড. জেফারসন সোডার ক্যান খুলে চুমুক দিলেন। এরপর বললেন, হ্যাঁ যা বলছিলাম, আপনি ৯৯ বছরের পুরনো মানুষ। এই শতবর্ষে পৃথিবী অনেকটাই চেঞ্জ হয়ে গেছে। আমি তারই সামান্য কিছু ধারণা আজ আপনাকে দেব। প্রথমত যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা ডাটাবেজ ঘেটে দেখেছি সেই ২০০০ সালের দিকে দুবাই থেকে নিউ ইয়র্ক আসতে আকাশ পথে সময় নিত প্রায় ১৪ ঘণ্টা। আর এখন এই সময়টা নেমে এসেছে মাত্র দুই ঘণ্টায়। আপনি চাইলে নিউ ইয়র্ক থেকে মুম্বাইও যেতে পারবেন মাত্র দুই ঘণ্টাতেই। অবশ্য এজন্য এয়ারক্রাফটের ডিজাইন, গতি ও টেক অফ, টেক অন বিষয়গুলিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ইন্টারনেট এখন ইলেকট্রিক স্পীডে কাজ করছে। ডাউনলোড আপলোড শব্দগুলি এখন শুধুই ইতিহাস। আপনাকে সহজভাবে যদি বুঝাই তাহলে ক্যামেরায় ছবি তোলার গতিতে এখন ইন্টারনেট কাজ করে। টেলিফোন, ফ্যাক্স বা মোবাইল সিস্টেমটি অত্যন্ত পুরনো হয়ে যাওয়ায় আমেরিকা তা বাতিল ঘোষণা করেছে। টেলি-যোগাযোগের জন্য এখন আর কোনও নাম্বারের প্রচলন নেই। সরাসরি আপনি যে-কাউকে তার নাম ধরেই কল করতে পারবেন। গত মাস থেকে মার্স ও মুনে রেগুলার স্পেসফ্লাইট শুরু হয়েছে। মার্কিন কম্পানিগুলো সেখানে ট্যুর প্যাকেজ শুরু করেছে। যদিও ভ্রমণ প্যাকেজগুলি সামান্য ব্যয়বহুল। বাট আপনার মতো বিলিওনিয়ারদের জন্য সেটা কোনও বিষয়ই না। আরও কিছু চমকপ্রদ ঘটনা গেল শতাব্দিতে ঘটেছে। আমরা এই মহাবিশ্বে আর একাকী নই, ভিনগ্রহের বুদ্ধিমানদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘটেছে। আমাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। আপনি আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন শিগরিরই। আমরা মানে পৃথিবীর মানুষ মঙ্গল ও চাঁদে আমাদের কলোনি তৈরী করেছি। যদিও সেখান আমরা স্থায়ীভাবে কেউই বসবাস করছি না। আমরা দুটো স্থানকেই ব্যবহার করছি গ্রহান্তরে যোগাযোগের হাব হিসাবে। আপনাকে ধীরে ধীরে বিস্তারিত আরও অনেক কিছুই জানানো হবে, যা আপনার জানা দরকার। ভিনগ্রহীদের সংগে অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, ঘটে চলছে। সবই আপনি জানতে পারবেন।
আমি চমকে উঠলাম! অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলাম, বিলিওনিয়ার! আমি? মানে?
ড. জজ জেফারসন হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, মিস্টার ইভান, আপনাকে তো আপনার সম্পর্কে আসল তথ্যগুলিই দেয়া হয়নি। নিউ ইয়র্কের ফোর্ডহামে আপনার নিজের সেই অ্যাপার্টমেন্টটি ঠিক আগের মতোই করে রাখা হয়েছে। আমি আপনাকে চাবিটি হস্তান্তর করবো একটু পরই। আপনি যখন নিজেকে বিজ্ঞান চর্চায় ‘উৎসর্গ’ করলেন পুরো আমেরিকা আপনার বীরত্বে, আপনার সম্মানে সম্মানিত হয়ে উঠলো। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আপনার জন্য টু বিলিয়ন ডলার বাজেট বরাদ্দ করলেন। আরও বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ইউএন, হুসহ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থাও আরও প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার সেই তহবিলে প্রদান করেছে। এবং এই সমুদয় অর্থই আপনার একক মালিকানায় এবং সব মিলিয়ে আপনার নগদ অর্থের পরিমাণ এখন প্রায় সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। আমি আপনাকে আপনার ব্যাংক কার্ডটিও আজ হস্তান্তর করবো, যার নাম মুলত এখন ‘ওয়ান কার্ড’। মজার বিষয় হলো, আমি আপনাকে যে ব্যাংক কার্ডটি দিচ্ছি সেটা একই সঙ্গে আপনার ব্যাংক কার্ড, যেখানে ব্যালেন্স রয়েছে সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার এবং আপনাকে আরও প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ক্রেডিট ফ্যাসালিটি দেয়া রয়েছে এই একই কার্ডে কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাংক থেকে। এখন আর আলাদা আলাদাভাবে ভিন্ন ভিন্ন কার্ড হয় না। আপনার এই ‘ওয়ান কার্ড’টিই আপনার কমিউনিকেশন্স ডিভাইস হিসাবে কাজ করবে। সিসিলিয়া আপনাকে সমস্যা হলে দেখিয়ে দেবে। আপনার কার্ড শুধুমাত্র আপনার আঙুলের ছোঁয়া পেলেই কাজ করবে। অন্যথায় এটা ডিএকটিভেট থাকবে।
আমার মাথা ঘোরাতে লাগলো। আমি ঠিক কি শুনছি, বুঝে উঠতে পারছি না। সিসিলিয়া আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। ড. জেফারসন আমার হাতে একটা ট্রান্সপারেন্স কার্ড দিলেন। কার্ডটি একটি ক্রেডিট কার্ডের মতোই। কিন্তু বেশ ভারি। একটা ছোট মেশিনে আমার দশ আঙুলের বায়োমেট্রিক ফিংগার প্রিন্ট নিলেন। আমাকে কার্ডের পাসওয়ার্ড সেট করে নিতে বললেন এবং এক্সেস কোড তৈরি করে নিতে বললেন। আমি নিজে নিজেই করে নিলাম। এই প্রথম আমি এই সময়ের কমপিউটার ব্যবহার করছি। অপারেটিং সিস্টেমটি বুঝতে পারছি না। তবে সব কাজই যে অনলাইনে হচ্ছে এবং ইলেকট্রিক স্পীডে হচ্ছে, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
ড. জেফারসন আমার হাতে আমার আমেরিকান পাসপোর্টটি বুঝিয়ে দিলেন। আমার অ্যাপার্টমেন্টের চাবি হিসাবে নাকি আমি আমার এই ‘ওয়ান কার্ড’টিই ব্যবহার করতে পারবো। চলবে