
মনোরি
সায়েন্স ফিকশন ৫
তৌফিকুল ইসলাম পিয়াসপ্রকাশিত : এপ্রিল ০৯, ২০২০
সিসিলিয়া দারুণ একটা মেয়ে। যতই ওকে দেখছি ততই আমি ওর আচরণে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। তবে এ বিষয়টাও আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি যে, সে অত্যন্ত প্রফেশনাল। ওর দায়িত্বই হচ্ছে আমাকে আগলে রাখা। নতুন পৃথিবীতে আমাকে যতটা সম্ভব স্বাচ্ছন্দ দেয়া। সবকিছু সহজ করে দেয়া।
সিসিলিয়া তাই-ই করে যা্চ্ছে এবং অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। ‘তুমি বিয়ে করোনি কেন সিসিলিয়া?’ প্রশ্নটা না করে থাকতে পারলাম না। অবশ্য প্রশ্নটা করার মতো ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা এরই মধ্যে আমাদের তৈরি হয়েছে আর সেই যোগ্যতায় ব্যক্তিগত প্রশ্নে পূর্বঅনুমতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না।
ও মিষ্টি করে হেসে দিল। ‘আমাকে বিয়ে করবে তুমি?’ আমিও হেসে দিলাম। ওর রসিকতায় আবারও মুগ্ধ হলাম। সঙ্গে যোগ করলাম, ‘হ্যাঁ, আপাতত করে দেখতে পারি, কি বলো?’
দুজনেই হেসে উঠলাম উচ্চস্বরে। সিটিসেন্টারডিসি শপিং মলটা সত্যিই অসাধারণ। এটাও নাকি আমার মতোই শতাধিক বছরেরই পুরাতন। কিন্তু আমার তো এখানে আগে আসা হয়নি, তাই চিনিও না। আমি সিসিলিয়ার রুচিতে নির্ভর করে বেশ কিছু পোশাক কিনলাম। নতুন জীবনে এটাই আমার প্রথম শপিং। ওরা নাকি আমার ঠিকানায় ফ্রি হোম ডেলিভারি করবে।
এখন সবকিছুই ড্রোন-ডেলিভারি হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বাসার অ্যাড্রেসটা ঠিকঠাক মতো দিয়ে দিলেই হলো। মেইলবক্সে ড্রপ করে দেবে মুহূর্তেই অত্যাধুনিক ড্রোন-ডেলিভারি সার্ভিস প্রভাইডার কম্পানিগুলি। সিসিলিয়ার উপর দায়িত্ব পড়েছে আগামী সাতদিন আমার সঙ্গে থাকবে। আমাকে সঙ্গ দেবে। আমাকে নতুন পৃথিবী চেনাবে। ফ্যাশন, চলাফেরা সবকিছু। অবশ্য আমি এরই মধ্যে অনেক কিছুই বুঝে উঠেছি।
সিসিলিয়ার ভাষায় আমি নাকি ভেরি ফাস্ট লার্নার ম্যান। শপিং মলের বাইরেই ‘বার্গার কিং’ রেস্টুরেন্ট। আমার এক সময়ের অত্যন্ত পরিচিত ও প্রিয় এই রেস্টুরেন্ট। সিসিলিয়াকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ও আমাকে আমার সবকিছুতেই সহযোগিতা করে।
‘কি খাবে সিসিলিয়া?’ প্রশ্ন করলাম।
‘তোমার যা ইচ্ছে হয় আমিও তাইই খাব, ইভান। সমান সমান অর্ডার করবে। আমি কিন্তু কম খাব না।’ মেয়েটির মুখে এত হাসি কোথা থেকে আসে, আমি বুঝি না। অর্ডার করার সঙ্গে সঙ্গে আমার ‘ওয়ান কার্ডে’ অর্ডার ইনভয়েস চলে আসলো এবং আমিও সঙ্গে সঙ্গে অ্যামাউন্টটা অ্যাপ্রোভ করে দিলাম। আমার অ্যাকাউন্ট থেকে ৬৫.৫৭ ডলার ট্রান্সফার হয়ে গেল, আমি একটা কনফার্মেশন মেসেজ দেখতে পেলাম আমার ওয়ান কার্ডে।
ওয়ান কার্ডের কার্যক্রমে আমি মুগ্ধ। এই সামান্য একটা মাত্র কার্ড থাকলে ওয়ালেটে অন্য কোনোকিছুই প্রয়োজন হয় না। বাস্তব জীবনের সকল কাজকর্ম এই একটিমাত্র কার্ড দিয়েই আমি অনায়াসে চালিয়ে নিতে পারছি। এটাই আমার এটিএম কার্ড, এটাই ক্রেডিট কার্ডস, এটাই মেট্রোকার্ড। এটা দিয়েই আমি কমপিউটারের কাজ কাজ চালাতে পারছি; ফোন পর্যন্ত করছি এই একটা কার্ড দিয়েই।
গেল শতাব্দীতে আমার জীবন শেষ হয়ে গেলে এসব তো দেখা হতো না। এক কোনায় গিয়ে আমরা একটা টেবিলে বসে খাচ্ছি। সেই একই স্বাদ এখনও ধরে রেখেছে এই রেস্টুরেন্টটি। একই নামে। কত স্মৃতি রয়েছে আমার এই রেস্টুরেন্টটিকে ঘিরে। ইদানীং স্মৃতিগুলিও আমাকে পেয়ে বসেছে। সারাক্ষণ শুধুই যা-ই দেখি তারই স্মৃতি সামনে চলে আসে। আর সঙ্গে চোখও ভিজে ওঠে। সিসিলিয়ার সামনে এখন লজ্জাও করে চোখে পানি আসাতে।
চাইনিজ মেয়ে হেলন গং এর কথাটা মাথায় আটকে রয়েছে। কী দারুণই না ছিল মেয়েটি। সেটাও তো সেই ২০০১ সালের দিকে কথা হবে! আজকের মতোই ঠিক এভাবে কুয়ালালামপুরে হেলেনের হাত ধরে ঢুকে ছিলাম ‘বার্গার কিং’ রেস্টুরেন্টে। ওদিনই ছিল আমার জীবনে প্রথম বার্গার কিং খাওয়া। হেলেনের অনুরোধে। বিলও হেলেনই দিয়েছিল। খুব বেশি সুন্দরী ছিল চাইনিজ মেয়েটি। বেশ দুর্বল ছিল সে আমার প্রতি। অথচ আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতাম। সামনে আগানোর মোহ আমাকে পেয়ে বসেছিল তখন!
শেষ কবে যেন কথা হয়েছিল হেলেনের সঙ্গে? হ্যাঁ, প্রায় বছর পাঁচেক পর একদিন হেলেনের স্কাইপ প্রোফাইলে দেখলাম একটা ছোট্ট কিউট বেবির ছবি। চোখটা অনেকক্ষণ আটকে ছিল সেই বেবির ছবিতে। হেলেনের ইচ্ছেকে সম্মান দিলে এই বেবিটা আমারও হতে পারতো তখন। তারপরও তো অনেকবার কথা হয়েছিল হেলেনের সঙ্গে। ফোনে কেঁদেছিলও একদিন। অথচ আজ আমার কান্না পাচ্ছে হেলেনের জন্য।
হেলেনের সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে গেলে আজ আর আমি এখানে থাকতাম না। এই নতুন পৃথিবী, নতুন মানুষগুলিও দেখার সুযোগ পেতাম না। ব্যক্তিজীবনে একজন সুখি মানুষ হিসাবেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা রেখে আমি ইহলোক ত্যাগ করতাম। হেলেনের ছেলেমেয়ে তার ছেলেমেয়ে কেউ কি বেঁচে রয়েছে? রয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি তো তাদের কোন কন্ট্রাক্টস জানি না! আচ্ছা, বিজ্ঞান তো অনেক দূর এগিয়েছে। আমার পুরাতন মেমোরিরগুলি কি মুছে ফেলা সম্ভব নয়? অনেকটা হার্ডডিক্স ফরমেট করার মতো করে? সবকিছু যদি ভুলে যেতে পারতাম, তাহলে হয়তো নতুন পৃথিবীতে আবার সবকিছুই নতুনভাবে তৈরি হতো! চলবে