মনোরি

সায়েন্স ফিকশন ৬

তৌফিকুল ইসলাম পিয়াস

প্রকাশিত : এপ্রিল ১০, ২০২০

চিজ-বার্গারে কামড় দিতে দিতে সিসিলিয়াকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, সিসিলিয়া, তোমরা কি আমার মেমোরিটাকে ফরমেট করে আগের সব স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে পারো না?
সিসিলিয়ার পাল্টা প্রশ্ন, কেন?
আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি সবকিছুই মনে করতে পারছি। আমার জীবনের সবকিছুই আমি জীবন্ত দেখতে পারছি। অথচ কোনো কিছুই এক্সিস্ট নেই। সবকিছুই একশো বছর আগের স্মৃতি। কারো কোনো অস্তিত্ব নেই এই পৃথিবীতে, যাকিছু আমার অতি চেনা। আমি কিভাবে বেঁচে থাকবো, তুমিই বলো?
দ্যাখো ইভান, তুমি যা চাইছো এটা এখন অত্যন্ত সাধারণ একটা বিষয় বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাছে। কিন্তু আমাদেরকে কিছু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয়। আমরা ক্ষমতা থাকলেও এটার প্রয়োগ করতে পারবো না। সম্ভব নয়।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আমরা আমার হসপিটালের রুমে ফিরে আসলাম। খুব টায়ার্ড লাগছিল। একটু ঘুমানো দরকার। কি কি কাজ করা যায়, তা নিয়েও ভাবছি। আমার কোনো কাজ নেই, কাউকে চিনি না এই বিশাল পৃথিবীতে। আমার কোনো বন্ধু নেই। নেই পরিবার, পরিচিত অথবা আত্মীয়-স্বজন। আমি একা। সম্পূর্ণই একা।

অবশ্য এরই মধ্যে সিসিলিয়াসহ আরো কয়েকজন বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারছি, এরা সকলেই প্রফেশনাল। এটাকে কোনো যুক্তিতেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক বলা উচিত হবে না। তাহলে এখন আমার কি করা উচিত?

ওয়ান কার্ডটি হাতে নিলাম। প্রজেক্টর এপসটি ওপেন করে সাদা ওয়ালে কমপিউটার মনিটর ভেসে উঠলো। আমার টেবিলের উপর ভার্চুয়াল কি-বোর্ড দেখতে পাচ্ছি। ই-মেইল পাসওয়ার্ডটি মনে আছে। মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনও লগিন করেছিলাম।

হঠাৎই ফেসবুকের কথা মাথায় চলে আসলো। অনেকগুলি ওয়েব ব্রাউজার দেখতে পাচ্ছি। ফেসবুকের এপসও রয়েছে। ফেসবুক রান করলাম। শতবর্ষ আগের ব্যবহৃত আমার ফেসবুক ইউজার পাসওয়ার্ড দিলাম। কিন্তু লগিন হচ্ছে না।

বেশ কিছুটা সময় বাদে আমার ডেট অব বার্থ জানতে চাইলো। দিলাম। একটা সিকিউরিটি প্রশ্ন ভেরিফাই চাইলো, পার্ফেক্ট এনসার ইনপুট করলাম। এবার লগিন হলো। আমার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। নিউজ ফিডে নতুন কোনো স্ট্যাটাস নেই। সর্বশেষ স্ট্যাটাসটি দেখতে পাচ্ছি সেটাও ২০৮৪ সালের ১২ ডিসেম্বরের। বাংলায় লেখা, কতদিন ঘুমাই না!

জাস্ট এটুকুই। মনে করতে পারছি না, ঠিক কে ছিল এই স্ট্যাটাসদাতা। নিজের বেখায়ালেই ‘লভ’ দিলাম স্ট্যাটাসটিতে। নিউজ ফিডের নিচে আর নামতে ইচ্ছে হচ্ছে না। নস্টলজিয়া বড়ই কষ্টকর। অথচ নিচে নামার লোভও সামলাতে পারছি না। কি করবো? কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। কী করা উচিত? খুব অসহায় বোধ করছি। আমি জানি, ২০২০-২০৩০ এর দিকেও যদি নামি অনেক পরিচিত বন্ধু, আত্মীয়কে পেয়ে যাব। তাদের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাব।

অথচ ওরা আজ আর কেউই এই পৃথিবীতে নেই। ৫০০০ বন্ধুর সকলেই মৃত। ওহ মাই গড! অথচ আমি তো জানিই যে, সকলেই মৃত। কিন্তু মানতে পারছি না কেন? আমাকে তো সবই মানতে হবে। অন্য কোনো রাস্তাতো নেই আমার। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো ভেতর থেকে। আমার অতি পরিচিত শহর-গ্রামের সকলের নাম-চেহারাগুলি আমার সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি! এরা কেউ আর নেই আজ। কেউ নেই। আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।

মিনিট দশেক চোখ বন্ধ করে রইলাম। আস্তে আস্তে মনকে বোঝাতে পারলাম। শক্ত হলাম। আরও শক্ত। এ জীবন তো আমি নিজেই বেছে নিয়েছি। এর দায়তো শুধুই আমার। তাহলে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি কেন? আমি আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করবো। শুরু করতেই হবে আমাকে। নতুন শতাব্দীর নতুন মানুষ হয়েই আমাকে এই পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। একটা নতুন কর্ম-পরিকল্পনা আঁকতে হবে। বিক্ষিপ্ত কিছু করা যাবে না আর। সবকিছুই সুন্দর করে শুরু করবো। অনেক সুন্দর করে। নতুন মানুষ। নতুন জীবন। নতুন পৃথিবী। শুধু অভিজ্ঞতাই থাকবে শতবর্ষের পুরাতন।

তাতে কি? সবকিছুই আয়ত্ব করে ফেলবো। আমাকে ব্যর্থ হলে তো চলবে না। কাঁধে সিসিলিয়ার হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। অন্য হাতে টিস্যু দিয়ে নিজেই আমার চোখ মুছে দিল মেয়েটি। বলল, দেখো ইভান, আমি তোমার কষ্ট অনুভব করি। আমি অনেকবার কল্পনায় তোমার অবস্থানে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিয়ে ভেবেছি। আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তুমি পেরেছো, অত্যন্ত সাহসী মানুষ হিসাবে। তোমাকে তো ভেঙে পরলে চলবে না। তোমাকে আবারও সব কিছুকে মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে দাঁড়াতে হবে। এবং তুমি পারবে। আমিও তোমার সঙ্গে রয়েছি। তুমি শুধুই আমার প্যাসেন্ট নও। আমার বন্ধুও। তুমি আমাকে তোমার বন্ধু হিসাবে ভাবতে পারলে আমি গর্বিত হবো। আমাকে বন্ধু করবে না?

সিসিলিয়ার মুখের দিকে তাকালাম। মেয়েটার চোখে জল। আমার জন্য মেয়েটি কাঁদছে। আমার জন্য কাঁদার মতো মানুষ তাহলে এই শতাব্দীতেও আছে! মানুষের কান্না দেখলেও যে মন ভালো হতে পারে, এই প্রথম বুঝতে পারলাম। সিসিলিয়া নিজের চোখ মুছলো। চলবে