মস্তিষ্কের বিভিন্ন সমস্যায় করোনা ভাইরাস

অপূর্ব চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ০৫, ২০২০

ছয় মাস আগে করোনা ভাইরাসের কথা যখন লোকের মুখে মুখে ঘুরছিল, বিজ্ঞানী থেকে চিকিৎসক, সাধারণ থেকে মন্ত্রী মহোদয়রাও ভেবেছিল, নতুন ভাইরাসটি হয়তো SARS, MERS এর মতো কোনো একটি উৎপাত। কয়েকদিন পর লোকে বকতে লাগলো, এটি একটি ফ্লু। দিন গড়িয়ে মাস যেতেই চিকিৎসকরা জোরে চেঁচাতে লাগল, কোভিড ১৯ একটি শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ। আরো কিছুদিন যেতে ফুসফুসে ইনফ্লেমেশনের ঝড় তুলে ভাইরাস যখন হানা দিতে লাগলো হার্টে, একদল বলা শুরু করল, শেষপর্যন্ত এটি হয়তো কার্ডিওভাস্কুলার প্রব্লেম।

ছয় মাস পর চিকিৎসকদের হাতে যখন কোভিড আক্রান্তদের প্রচুর তথ্য, এ সময়ে একদল খুঁড়ে দেখতে পেল যে, যারা করোনা থেকে বেঁচে উঠছে, তাদের একটি অংশ মারাত্মক থেকে মৃদু মস্তিষ্কজনিত সমস্যায় ভুগছে। শরীরের অন্য অঙ্গগুলোর সমস্যা যত তাড়াতাড়ি চোখে পড়ে, মস্তিষ্কের সমস্যাগুলো সামনে আসে ধীরে ধীরে। দেখা গেছে যে, স্ট্রোক হওয়া এবং স্ট্রোক ঝুঁকি কোভিড ১৯ থেকে বেঁচে ওঠাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আগে ভাবা হতো, হার্টের সমস্যা কিংবা উচ্চ রক্তচাপ অথবা ডায়াবেটিস থাকলে স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এখন যারা একবার কোভিড ১৯ থেকে বেঁচে উঠেছে, তাদের কারো কারো মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে গেছে।

মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে যা হয় তাকে Stroke বলে। অনেকে ভুলবশত ভাবে, স্ট্রোক হয় হৃদপিণ্ডে। মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে কিংবা রক্তক্ষরণ হলে স্ট্রোক হয়। মস্তিষ্কের কোথাও এমন রক্ত যেতে না সে অংশের কোষগুলোতে. অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়, তাতে সে অংশের কোষগুলো মরে যায়। মস্তিষ্কের সেই অংশ শরীরের যে যে অংশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন তা আর করতে পারে না। যেমন স্ট্রোক হলে প্যারালাইসিস হয়, মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

শুধু স্ট্রোক নয়, উদ্বিগ্নতা থেকে অবসাদ, মুড্ ডিজঅর্ডার থেকে সাইকোসিস, অযথা ক্লান্ত লাগা থেকে মনোসংযোগ ক্ষমতা হ্রাস, ধোঁয়াটে চিন্তা থেকে মেমোরি লস, কনফিউজড থেকে মানসিক অবসাদ অনেকগুলি নিউরোলোজিক্যাল সমস্যা পোস্ট কোভিড সময়ে সেরে ওঠারা ভুগছে। শরীর থেকে ভাইরাস চলে গেলেও শরীরের কোথাও কোথাও তার তাণ্ডব চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। ভাইরাসটি আক্রমণের শুরুতে অনেক কোভিড আক্রান্তদের মস্তিষ্ককেও আক্রান্ত করে। তাতে মাথা যন্ত্রণা থেকে ভার ভার লাগা, কনফিউশান থেকে মুখের স্বাদ চলে যাওয়া, নাকের গন্ধ অনুভব ক্ষমতা হ্রাস থেকে seizures, অনেকগুলো মস্তিষ্কজনিত সমস্যার মুখোমুখি হয়।

নাকের এমন গন্ধ পাওয়া কমে যাওয়াকে চিকিৎসকদের ভাষায় বলে anosmia। সাধারণের ভাষায় বলে smelling blindness। জিভের স্বাদের পরিবর্তনকে বলে dysgeusia। প্রশ্ন দাঁড়ালো, কেন এমন হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে এবং তাতে কি কি সমস্যা বাড়তে পারে কিংবা বাড়ছে। নতুন করোনা ভাইরাস চারভাবে মস্তিষ্ককে আক্রমণ করে।

ক. জীবাণুর সরাসরি আক্রমণ
খ. ফুসফুসের কারণে রক্তে অক্সিজেনের পরিমান কমে গেলে
গ. রক্ত জমাট বেঁধে
ঘ. ফুসফুসের অতিরিক্ত ইনফ্লামেশনের কারণে

কোভিড ১৯ এর কারণে মস্তিষ্কে যেসব সমস্যা দেখা দেয়, তা নিয়ে এপ্রিল এবং মে মাসে ইংল্যান্ডে সবচেয়ে বড় গবেষণাটি হয়েছে। এবং তার ফলাফল The Lancet Psychiatry জার্নালে জুনে প্রকাশ করা হয়েছে। তিনটি প্রতিষ্ঠান একসাথে এই গবেষণায় সমন্বয় করে।
1. Association of British Neurologists (ABN)
2. The British Association of Stroke Physicians (BASP)
3. The Royal College of Psychiatrists (RCPsych)

প্রথমে তারা কোভিড আক্রান্তদের শরীরে কতগুলো নিউরোলোজিক্যাল এবং সাইকায়াট্রিক সমস্যা দেখা যায় কিনা, সেটার একটি তালিকা তৈরি করে। যেমন,

1. Cerebrovascular problems মানে হলো মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে রক্ত চলাচলের কোনো কমপ্লিকেশন
2. Altered mental status মানে হলো ভাইরাসের কারণে মানসিক সুস্থতার কোনো পরিবর্তন হলো কিনা। এটা দেখতে চারটি বৈশিষ্ট্যকে লক্ষ্য করা হয়: personality, behaviour, cognition, consciousness।
3. Peripheral neurological problems মানে হলো মস্তিষ্কের বাহিরে পেশী এবং স্নায়ু জনিত কোনো সমস্যা ।

গবেষণাটি চলেছিল এপ্রিলের ২ তারিখ থেকে ২৬ এপ্রিল। মস্তিষ্কজনিত কমপ্লিকেশন দেখা গেছে, এমন ১৫৩ জন করোনা ভাইরাস আক্রান্তকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এরা পুরো ইংল্যান্ডের কয়েকটি হাসপাতালজুড়ে ছিল। রোগীদের বয়স ছিল ২৩ থেকে ৯৪ বছর বয়সের। এই ১৫৩ জন থেকে ১২৫ জনের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট ছিল। রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে,

1. কোভিড আক্রান্ত ১২৫ জনের মধ্যে ৭৭ জনের মাঝে Cerebrovascular problems গুলো দেখা গেছে, যা প্রায় কোভিড আক্রান্তদের ৬২%। এই ৭৭ জনের মধ্যে ৫৭ জনের কোনো না কোনো ধরনের স্ট্রোক হয়েছে। বাকিদের মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, প্রদাহ এমনসব সমস্যা দেখা দিয়েছে।

2. এই ১২৫ জনের মধ্যে ৩৯ জনের altered mental state দেখা দিয়েছে। এদের ৯ জনের Encephalopathy এবং সাতজনের Encephalitis হয়েছে। মস্তিষ্কের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে বলে Encephalopathy। মস্তিষ্কের কোথাও ইনফ্লামেশন হলে সেটাকে বলে Encephalitis।

3. বাকি ২৩ জনের বিভিন্ন ধরণের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন, ১০ জনের মধ্যে দেখা গেছে Psychosis, ৬ জনের Dementia। Psychosis হলো হেলুসিনেশন এবং ডিলুশন হওয়া, Dementia হলো স্মৃতিভ্রংশ।

গবেষণাটি থেকে বেরিয়ে এলো যে, করোনা ভাইরাস শুধু মাত্র ফুসফুসকে আক্রমণ করে না, করোনাকালীন এবং করোনা পরবর্তী মস্তিষ্কে প্রদাহ থেকে বিভিন্ন ধরনের মানসিক ব্যাধি এবং ভারসাম্যহীনতাও দেখা দিচ্ছে। মস্তিষ্কের উপর করোনা ভাইরাসের এই প্রভাব সেরে ওঠা রোগীকে অনেকদিন পর্যন্ত ভোগাতে পারে। যথাযথ চিকিৎসা না নিলে পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের মস্তিষ্কের এবং মানসিক সমস্যায় দীর্ঘমেয়াদী সময়ের জন্যে জড়িয়ে যেতে পারে।

আতংকিত হবার কিছু নেই। সমস্যা থাকলে তার সমাধানও আছে। সমস্যা চিহ্নিতকরণ সমাধানের অর্ধেক। তাই এই ব্যাপারে অবহিত হওয়া কোভিড পরবর্তী আক্রান্তদের সতর্ক হতে সাহায্য করবে। মস্তিষ্কের উপর যে কোনো প্রভাব এবং পরিবর্তন গোটা শরীরকেই ব্যাহত করে।