মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ২

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৪, ২০১৯

বাংলাদেশের পাঠকরা জুলফিকার নিউটন নামের এক অনুবাদককে চেনেন, যিনি অন্যের অনূদিত বই হুবহু কম্পোজ করিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দিতেন। এখনো দেন কিনা জানি না। তার এই কুম্ভীলকবৃত্তির কথা মোটামুটি সর্বজনবিদিত। তাকে নিয়ে একবার এনটিভি নিউজও করেছিল। প্রয়াত অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় কবীর চৌধুরী নিউটনের কোনো কোনো বইয়ের বইয়ের ভূমিকাও লিখতেন। আমার খুব অবাক লাগত। স্যার কী করে নকল বইয়ের ভূমিকা লেখেন! একবার আমি কবীর স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ব্যাপারে। তাঁর সরল স্বীকারোক্তি ছিল, ‘ও তো একটা লিখে নিয়ে আসে, আমি একটু পড়ে সিগনেচার করে দিই।’ স্যার অবশ্য এমনই ছিলেন, কাউকে বিমুখ করতেন না। এক ধরনের পিতৃত্বসুলভ ব্যাপার ছিল তাঁর মধ্যে। সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত মানুষদের, সে যে-ই হোক না কেন, ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। কেউ যদি কোনো বইয়ের একটা ফ্ল্যাপ লিখে নিয়ে যেত, তিনি বিনাপ্রশ্নে সই করে দিতেন।

অন্যের অনুবাদকর্ম নিজের নামে চালিয়ে দিয়ে নিউটন যে কত বই করেছেন, তার শুমার আমার কাছে নেই। শুধু দুটো বইয়ের কথা বলি। এক. হারমান মেলভিলের ‘মবি ডিক’ উপন্যাসটির অনুবাদ করেছিলেন কলকাতার গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, সম্ভবত ১৯৬৭ সালে। পরে এটি কলকাতার প্যাপিরাস থেকে ছাপা হয় ২০০৫ সালে। নিউটনের ‘মবি ডিক’ পড়তে গিয়ে সন্দেহ হয়েছিল। পরে মিলিয়ে দেখি গৌরীশঙ্করের অনুবাদটিই হুবহু মেরে দিয়েছেন নিউটন। একই কাণ্ড করেছেন স্তাঁদালের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি রেড এন্ড দি ব্ল্যাক’-এর ক্ষেত্রেও। উপন্যাসটির মূল অনুবাদক কলকাতার পূর্ণিমা রায়। নিউটন ওধারকা মাল এধার করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন।

নিউটনের কথা থাক। এবার আসি ড. মনজুর রহমানের প্রসঙ্গে। তিনি কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। লেখালেখি করেন। বেশ কিছু বই আছে। লেখালেখির জন্য পুরস্কৃতও হয়েছন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ, নির্বাচিত উপন্যাস, ড. লুৎফর রহমান রচনাসমগ্র, সুকান্ত রচনা সমগ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচিত উপন্যাস, শরৎচন্দ্রের নির্বাচিত উপন্যাস... এসব বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন। বইগুলোর প্রচ্ছদে ভূমিকা লেখক হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিজের নাম। এছাড়া লিউ তলস্তয়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর অনুবাদও করেছেন।

ড. মনজুর অনূদিত একটি বইয়ের নাম ‘দ্য গ্রেট মিথোলোজি।’ ঢাকার বাংলাবাজারের ‘সৃজনী’ প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত। কলকাতার সুধাংসুরঞ্জন ঘোষের ‘গ্রীক পুরাণকথা’ নামে একটি বই আছে। বইটি থেকে প্রায় ৩০ পাতা হুবহু মেরে দিয়ে ‘দ্য গ্রেট মিথোলোজি’তে অন্তর্ভুক্ত করেছেন ড. মনজুর। বইয়ের বাকি লেখাগুলো কোন বই থেকে মেরেছেন, তা আবিষ্কার করা যায়নি। যে ত্রিশ পাতা মারতে পারে, তার পক্ষে বাকিটাও মারা সম্ভব। ড. মনজুরের এই কুম্ভীলকবৃত্তি নিয়ে ফেসবুকে প্রথম একটি পোস্ট দেন কলকাতার অভীক সরকার। লেখেন, “কলকাতার গতকাল বাংলাদেশ বইমেলা থেকে মনজুর রহমানের ‘দ্য গ্রেট মিথোলজি’ বইটা কিনেছি। প্রথম চ্যাপ্টার, গ্রীক মিথোলজি পার্টটা পড়তে গিয়ে আমি স্তম্ভিত। ভদ্রলোক উনিশশো ষাট সালে তুলি-কলম থেকে প্রকাশিত সুধাংশুরঞ্জন ঘোষের ‘গ্রীক পুরাণ কথা’ থেকে লাইন বাই লাইন টুকে দিয়েছেন!”

কলকাতার একজন পাঠক বাংলাদেশের একজন অনুবাদক সম্পর্কে এই যে অভিযোগটি তুললেন, এটা বাংলাদেশের লেখক-সমাজের জন্য অপমানজনক। সত্যতা যাচাই করে দেখি, অভিযোগটি মিথ্যে নয়। অভীক সরকারের অভিযোগ তোলায় ড. মনজুর রহমান আত্মপক্ষ সমর্থন করে একটি পোস্ট দেন। যদিও ওই পোস্টটি এখন তার ওয়ালে দেখতে পাচ্ছি না। লেখেন, “ফেসবুকে দেখলাম, ড. মনজুর রহমানের নাম ব্যবহার করে গ্রেট মিথোলোজি নামে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। আমি ড. মনজুর রহমান বলছি, এই বইটির রচনা বা অনুবাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো প্রকাশনা আমার অজান্তে আমার নাম ব্যবহার করে বইটি প্রকাশ করেছে। সকল দায় প্রকাশকের। অনতিবিলম্বে আমার নাম ব্যবহার বন্ধ করা হোক।”

খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সৃজনী প্রকাশনীর প্রকাশকের নাম মশিউর রহমান। তিনি লেখক কিনা জানি না, তবে তার নামে বইপুস্তক রয়েছে। তিনি একবার জনতা পাবলিকেশন্সের বই নিজের নামে ছাপায় পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছেন। পার্ল পাবলিকেশন্সের একটি বই নিজের প্রকাশনী থেকে ছেপে পাবলিক লাইব্রেরিতে জমা দিয়ে ধরা খান। পরে ক্ষমাটমা চেয়ে পার পান।

প্রশ্ন হচ্ছে, ‘দ্য গ্রেট মিথোলজি’র কাণ্ডটা কে করেছেন? ড. মনজুর রহমান, নাকি মশিউর রহমান? মনজুরের বক্তব্য অনুযায়ী, অপরাধটা যদি মশিউর করে থাকেন, তবে এতদিন কেন প্রতিবাদ করলেন না মনজুর? সৃজনী থেকে তো তার আরো বই প্রকাশিত হয়েছে। এতদিন কি এ বইটা তার চোখে পড়েনি? না পড়ার তো কোনো কারণ দেখছি না। সুতরাং তার আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যটা হাস্যকর। বইটার কথা তিনি জানতেন, জেনেই চুপ ছিলেন। গ্রামাঞ্চলে একটা গল্প আছে। এক দুষ্ট লোক একজনের সঙ্গে আরেকজনের গ্যাঞ্জাম লাগিয়ে ধান্দা করে খেত। একদিন এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই বাল করে ক’দিন খাবি?’ দুষ্ট লোকটি বলল, ‘গোলেমালে ক’দিন যাক।’ ড. মনজুরও সম্ভবত ওই লোকটির মতো, এসব টোকাটুকি করে গোলেমালে ফাঁকতালে করে-কেটে খেয়ে যাচ্ছন। নইলে কি রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, মানিকের মতো লেখকের বইয়ের ভূমিকা লিখে প্রচ্ছদে নাম ব্যবহার করতেন? চিরায়ত কোনো বইয়ের ভূমিকা লেখা দোষের কিছু নয়। কিন্তু ভূমিকা লেখকের নাম যখন প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়, সেটা দৃষ্টিকটু। হাস্যকরও বটে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কজন শিক্ষককে চিনি, যারা এসব কাণ্ড করে থাকেন। অনেক আছেন ঠিকমতো বাক্যটি গঠন করতে পারে না, অথচ একেকজন বড় বড় লেখক। বিশ-ত্রিশটা বইয়ের রচয়িতা, সম্পাদক। প্রমোশনের ক্ষেত্রে নাকি এসব বই কাজে লাগে। তাই তারা বছর বছর এ ধরনের প্রোডাকশন দিতেই থাকেন।

ড. মনজুরও কি সেই দলে? তা নইলে কেন তিনি অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিলেন? কেন এতদিন প্রতিবাদ করলেন না? জানার পরও কেন তিনি প্রকাশকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? যেহেতু তিনি এই ব্যাপারে নিশ্চুপ, সেহেতু আমরা ধরেই নিতে পারি, দ্য গ্রেট মিথোলজি বইটি আসলেই তার। কিংবা তিনি ও প্রকাশকের যৌথ দুষ্কর্ম। অভিযোগ ওঠায় তিনি এখন প্রকাশককে দায়ী করছেন। আমরা এখন দেখার অপেক্ষায় প্রকাশক কী বলেন। পাশপাশি এই সন্দেহও জাগছে, তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর অনুবাদটি আদৌ ড মনজুরকৃত, না এটাও মেরে দেওয়া! বইটি সংগ্রহের চেষ্টা করছি। মিলিয়ে দেখব সত্যি তার অনুবাদ কিনা। কারণ এত বড় উপন্যাস বাংলাদেশের কেউ অনুবাদ করেছে, আমার জানা ছিল না।

ড. মনজুর রহমানের এই কুম্ভীলকবৃত্তির ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া যেত। তবু লিখলাম। কারণ এর সঙ্গে দেশের লেখক-সমাজের সম্মান জড়িত। বিদেশি একজন পাঠক দেশের কোনো লেখকের বিরুদ্ধে আঙুল তুলবেন, এটা দেশের জন্য অসম্মানজনক। এ ছাড়া সৃজনীর প্রকাশক মশিউর রহমানের মতো ঢাকা শহরে এমন অনেক প্রকাশক রয়েছেন, যারা হরহামেশাই এসব দুই নম্বরি করে একেকজন বড় বড় প্রকাশক সেজে বসে আছেন। মুরগী ধরাই তাদের কাজ। সাপ্লাই নির্ভরতা ছাড়া একটা বই বাজারজাত করার মুরোদ তাদের নেই। এসব বন্ধ হওয়ার দরকার বলে মনে করি।

১৪.১১.২০১৯