মহাকালে রেখাপাত
পর্ব ৪
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯
একদল লেখক আছেন, যাদেরকে প্রায়ই এই বলে হা-হুতাশ করতে শুনি―অমুক পত্রিকা আমার লেখা ছাপে না, তমুক পত্রিকা আমার কাছে লেখা চায় না, অমুক সাহিত্য অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকে না, তমুক সাহিত্যমোড়ল আমাকে হিংসা করে, গুরুত্ব দেয় না। এই শ্রেণির লেখকগুলোকে আমার স্রেফ মেরুদণ্ডহীন মনে হয়। জোঁকের মেরুদণ্ড নেই, তবু সে রক্ত খাওয়ার জন্য মানুষের গায়ে ওঠার সময় একটু হলেও দাঁড়াতে পারে। এই লেখকগুলোর মেরুদণ্ড সেটুকুও নেই। এরা অন্যের উপর ভর করে দাঁড়াতে চায়। পরগাছা যেমন।
বাংলাদেশের বহুল প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলো কখনো আমার লেখা ছাপেনি। একটিও না। হয়ত ভবিষ্যতেও ছাপবে না। শুনেছি, সম্পাদক মতিউর রহমান নাকি বলেছেন, ‘স্বকৃত নোমান এটা আবার কেমন নাম? এই নামে লেখা ছাপা যাবে না।’ কথাটা তিনি আদৌ বলেছেন কিনা আমি শিউর নই। শোনা কথা। শোনা কথা সত্যি হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। এমনও হতে পারে, মতিউর রহমান কখনো আমার নামই শোনেননি, যিনি আমাকে কথাটি বলেছেন তিনি বানিয়ে বলেছেন। তবে কথাটা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ মানুষের নাম নিয়ে মতিউর রহমানের এলার্জি আছে। প্রায়ই তিনি কবি-সাহিত্যিকদের নামের খৎনা করান।
সত্যি মিথ্যা যাই হোক, কথাটা শুনে আমি হেসেছি। আহত হইনি, খারাপ লাগেনি। আমার বাসায় প্রতিদিন প্রথম আলো রাখি। নাজু ও সাকির জন্য। আমি সাধারণত পত্রিকা পড়ি না। কোথাও নিজের লেখা ছাপা হলেও পত্রিকাটি সংগ্রহ করি না। মতিউর রহমানের এই কথা শুনে মন খারাপ করে বাসায় প্রথম আলো রাখা বন্ধ করে দিইনি। কারণ আমি যদি লিখতে জানি, আমার যদি লেখার ক্ষমতা থাকে, কথাটা শুনতে একটু ঔদ্ধত্ব্যপূর্ণ মনে হলেও, আমার লেখার স্তুপে এরকম বহু মতিউর রহমান চাপা পড়ে যাবে। আর যদি আমার লেখার ক্ষমতা না থাকে, আর যদি লেখালেখি আমার কাছে ধান্দাবাজির পথ হয়, তবে আমি মতিউর রহমানের একটা নখের যোগ্যও নই।
প্রথম আলোর কথা থাক। এটা বাঙালি মধ্যবিত্তের মনজোগানোর পত্রিকা। পাঠকরুচি অনুযায়ী চলে। পাঠক রুচি পরিবর্তনের, পাঠকের মন জাগানোর কোনো দায় তার আছে বলে মনে হয় না। এখন যদি দৈনিক সমকাল, ইত্তেফাক, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অন্য পত্রিকাগুলো আমার লেখা ছাপানো বন্ধ করে দেয়, তাতে আমার কী করার আছে? লেখা ছাপানোর জন্য আমি সম্পাদকদের তেল মালিশ করব? বারে নিয়ে মদ খাওয়াব? উপহার উপঢৌকন দেব? তাতেও কাজ না হলে তাঁদের চৌদ্দগোষ্ঠী ধরে গালাগাল করব? আমার লেখালেখি কি থেমে যাবে? রাগে-ক্ষোভে আমি লেখালেখি বন্ধ করে দেব? মোটেই না। আমি যা লিখতে চাই, লেখার যেসব পরিকল্পনা আমার মাথায় রয়েছে, তা লিখে ওঠার জন্য এক জীবন যথেষ্ঠ নয়, এরকম আরো তিন-চারটা জীবন দরকার বলে মনে করি। প্রথম আলো যে আমার একটি লেখাও ছাপেনি, তাতে লেখক হতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি, হচ্ছে না, ভবিষ্যতেও হবে না। অন্যসব পত্রিকা আমার লেখা ছাপা বন্ধ করে দিলও সমস্যা হবে না। আমার বই তো আছে, থাকবে। আমার পাঠকরা বই থেকেই আমার লেখা পড়বে।
হে মেরুদণ্ডহীন হা-হুতাশকারী ক্রন্দনশীল লেখকগণ, লেখালেখি চটকদারি কোনো ব্যাপার নয়। ধরাধরি করে লেখক হওয়া যায় না। সাহিত্য সংগঠন করে লেখক হওয়া যায় না। সাহিত্য অনুষ্ঠানে গেলেই, মঞ্চে বসার সুযোগ পেলেই লেখক হওয়া যায় না। পত্রিকায় লেখা ছেপে লেখক হওয়া যায় না। পত্রিকায় লেখা ছেপে যদি লেখক হওয়া যেত, তবে শাহনেওয়াজ বিপ্লবই হতো এই দেশের সবচেয়ে বড় লেখক। লোকটা অস্ট্রিয়া থাকত। একটা সময় পত্রিকাগুলো খুললেই তার লেখা দেখা যেত। সে কি দৌড় তার! হেন পত্রিকা নেই যেখানে তার লেখা নেই। এখন প্রমাণ হলো, শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের ‘রাতের কাহিনীকার’ গল্পটির দাড়ি-কমাশুদ্ধ নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে বিপ্লব। যে একটি লেখা মারতে পারে, তার পক্ষে ১০০টি মারাও সম্ভব। খুঁজলে দেখা যাবে বিপ্লব আরো বিস্তর গল্প মেরে নিজের নামে পত্রিকায় ছেপে দিয়েছে। বিপ্লবের মতো কত লেখককেই তো দেখলাম, দৈনিকের সাহিত্যপাতা খুললেই যাদের লেখা দেখা যেত। এখন তাদের নামই শোনা যায় না। কোথাও তাদের দেখা যায় না। হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজলেও তাদেরকে পাওয়া যায় না।
সুতরাং পত্রিকা কাউকে লেখক বানাতে পারে না। সাহিত্য সংগঠন, সাহিত্য অনুষ্ঠান, সাহিত্য মোড়ল কখনো কাউকে লেখক বানাতে পারে না। লেখক হওয়ার জন্য ভেতরে ‘মাল’ থাকতে হয়। মাল থাকলে কলমের ডগা দিয়ে আগুন বেরুবে। সেই আগুনে জগৎ উজালা হবে। পত্রিকার সম্পাদকরা আপনার পেছনে ঘুরবে, আপনাকে ঘুরতে হবে না, লেখা ছাপানোর জন্য আপনাকে হা-হুতাশ করতে হবে না, কান্নাকাটি করতে হবে না। সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলোতে আপনাকে সসম্মানে ডেকে নেবে, ডাকে না বলে হা-হুতাশ করতে হবে না। আপনার তো একটা ফেসবুক আইডি আছে। সকল পত্রিকা যদি আপনার লেখা নিষিদ্ধ করে আপনি ফেসবুকে লিখলেও আপনার পাঠকরা আপনার লেখাটি পড়বে। লেখাটি কাউকে ট্যাগ করতে হবে না, ম্যানশন করতে হবে না; সত্যিকারের পাঠক আপনার লেখাটির জন্য অপেক্ষা করবে, খুঁজে খুঁজে পড়বে।
আর যদি আপনার ভেতরে মাল না থাকে, আপনার কলমের ডগা দিয়ে বুড়িগঙ্গার পানি বেরুবে। সেই পানি চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াবে। সেই লেখা দেশ-জাতির কোনো কাজে আসবে না। সেক্ষেত্রে লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে আপনার উচিত অন্য কোনো কাজ করা। যেমন মুদি দোকানদার, মানবাধিকার ব্যবসা, এনজিও ব্যবসা, মাছ ও হাঁস-মুরগির খামার ইত্যাদি। চলবে
২৮.১১.২০১৯























