মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ১২

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০

‘হীরকডানা’র ভারতীয় সংস্করণ হাতে পেলাম। কদিন আগে কবি শিমুল সালাহ্উদ্দিন কলকাতায় গিয়েছিলেন। তাকে বলেছিলাম এক কপি নিয়ে আসতে। সহৃদয় শিমুল নিয়ে এলেন। আজ দিলেন। হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলাম। কী চমৎকার ছাপা! কী চমৎকার বাঁধাই! মনটা ভরে গেল।

রাতে বাসায় ফিরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পাতা ওল্টাতেই আঙুল ফসকে খুলে গেল ২৬৯ পাতাটি। চোখ বুলাই। মনে পড়ে গেল ২০১২ সালের এক হৈমন্তী বিকেলের কথা। তখন ‘হীরকডানা’ লেখা শেষ। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছিল কোথাও একটা ফাঁক রয়ে গেছে, কোথাও একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে।

অপূর্ণতাটা কী, খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেদিন বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে আজিজ মার্কেটের দিকে যাচ্ছি। পরিবাগ ওভার ব্রিজের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে আমি ডুবে গেলাম অবচেতনের গভীরে। নিজমনে আওড়াতে লাগলাম:
মহারাজ!
বলুন উজিরে আজম।
নিদারুণ খরা শুরু হয়েছে, প্রজারা খাজনা দিতে পারছে না।
সমস্ত খাজনা মকুফ করে দিন।
মহারাজ!
বলুন দেয়ানজি।
হার্মাদরা বড় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
আপনি কার পরোয়া করছেন? আপনাকে মনসবি দেয়া হয়েছে কেন? আপনার সৈন্যরা বসে আছে কেন? ত্রিপুরার সীমানায় কোনো জীবিত হার্মাদকে দেখতে চায় না ত্রিপুরপতি শমসের গাজী।
মহারাজ!
বলুন কী সংবাদ?
চাষাভুষাদের ওপর বড় জুলুম শুরু করেছে ইংরেজরা।
খামোশ!
দুঃস্বপ্নের ঘোরে চিৎকার করে ওঠেন গাজী। ঘুম ও জাগরণের সাঁকোয় দাঁড়িয়ে হাতড়াতে শুরু করেন। আহত বাঘের মতো অন্ধকারে হামাগুড়ি দিতে দিতে কী যেন খুঁজে বেড়ান। খোঁজেন, খুঁজতে থাকেন...। কাঁসার থালা-বাসনগুলো উপুড় হয়ে পড়ে, ঝনঝন আওয়াজ তুলে একটা থালা গড়াতে গড়াতে গারদের শিকের ফাঁকে আটকায়।”

ওভার ব্রিজ থেকে নামার পর ফিরে আসি চেতনে। চমকে উঠি। এতক্ষণ আমি কার সঙ্গে কথা বলছিলাম! কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করি। হ্যাঁ, স্পষ্ট মনে পড়ছে। রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে সঙ্গে থাকা একটি বইয়ের পেছনের সাদা পৃষ্ঠাটায় কথাগুলো লিখতে শুরু করি। পরে বাসায় এসে সংযোজন করি পাণ্ডুলিপিতে। মনে হলো, না, এবার আর অপূর্ণ মনে হচ্ছে না। যে ফাঁকটি ছিল সেটি ভরাট হয়ে গেছে।

আসলে ওই ‘খামোশ’ শব্দটি ছিল উপন্যাসটির একটি খুঁটি। এই খুঁটিটি সংযোজন করা ছিল না বলে অপূর্ণ মনে হচ্ছিল। নড়বড়ে মনে হচ্ছিল। বুঝতে পারলাম, কখনো কখনো একটি গল্প যেমন একটি শব্দের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, উপন্যাসও। যেমন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’র সর্বশেষ শব্দটি, ‘শিট্’। একইভাবে কোনো কোনো চরিত্রও দাঁড়িয়ে থাকে একটি শব্দের ওপর ভর করে। এমনটা হয়। কখনো কখনো। সবসময় নয়।

উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। পাক্কা ছয় বছর লেগে যায় প্রথম মুদ্রণ শেষ হতে। আমার এক মন বলছিল, হায়, উপন্যাসটি বুঝি মাঠে মারা গেল। মহাকালের অন্ধকূপে বুঝি হারিয়ে গেল। কিন্তু না, গত বছর প্রকাশিত হলো এটির দ্বিতীয় সংস্করণ। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে। এ বছর প্রকাশিত হলো এটির ভারতীয় সংস্করণ। কলকাতার অভিযান পাবলিশার্স থেকে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলো উপন্যাসটি। আমি জানতাম, এটি বেঁচে উঠবে। ফিরে আসবে। আমার দ্বিতীয় সত্তা আমাকে বরবার বলে যাচ্ছিল, ‘হীরকডানা’ বেঁচে উঠবে। ফিরে আসবে। শত বছর না হলেও অন্তত সিকি শতাব্দি হলেও এটি বেঁচে থাকবে।

‘হীরকডানা’ সবচেয়ে বেশি পঠিত হয় বাংলাদেশের কারাগারগুলোতে। উপন্যাসটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশের পর প্রকাশক মজিবর রহমান খোকা এটি ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। তারই উদ্যোগে কারা-মহাপরিচলক এটির প্রায় আশি কপি কিনে বাংলাদেশের সব কটি কারাগারের লাইব্রেরিতে রাখেন। কয়েদি-হাজতিদের মধ্যেও তো পড়ুয়া থাকে। উপন্যাসটি তারা পড়েন। গত বছরের কথা। কুমিল্লা থেকে জনৈক ব্যক্তি আমাকে ফোন দিলেন। অনেক কষ্টে তিনি আমার মোবাইল নম্বরটি জোগাড় করেছেন। তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। সদাচারণের কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার দু-বছর আগে মুক্তি পান। আমার সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান। আমি তাকে বললাম একদিন ঢাকায় আমার অফিসে আসতে। সত্যি সত্যি তিনি চলে এলেন। অনেকক্ষণ থাকলেন। দুপুরে খেলাম এক সঙ্গে। বললেন, ‘আমি বই তেমন পড়তাম না। জেলে যখন অবসর পেতাম তখন লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়তাম। বিস্তর বই পড়েছি। আপনার ‘হীরকডানা’ উপন্যাসটি পড়েছি। পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জেল থেকে বেরিয়ে এই লেখককে খুঁজে বের করব। যে করেই হোক। আপনাকে খুঁজে বের করতে পেরে আমি সফল।

তার কথা শুনে আমি আপ্লুত হয়ে পড়ি। জড়িয়ে ধরি তাকে। মনে হয়, লেখক জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছু হতে পারে না। কিচ্ছু না।

আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় আমার সেরা উপন্যাস কোনটি? আমি হয়ত ‘হীরকডানা’র কথাই বলব। আসলেই কি? না মনে হয়। তবে কি ‘রাজনটী’? না মনে হয়। তবে কি ‘কালকেউটের সুখ’? না মনে হয়। তবে কি ‘শেষ জাহাজের আদমেরা’? না মনে হয়।

আমি আসলে নিশ্চিত নই। সম্ভবত এই অনিশ্চয়তাই লেখককে অনুপ্রাণিত করে নতুন লেখায়।

১৫.২.২০২০