বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান

মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ১৩

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০

বইমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমির মাঠের মূলমঞ্চে প্রতিদিন একটি আলোচনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে একটি অনুষ্ঠানের আলোচক ছিলাম আমি। আলোচনার বিষয় ছিল, গবেষক সাইমন জাকারিয়া রচিত ‘সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি’ বইটি নিয়ে। মূল প্রবন্ধ লিখেছেন গবেষক সুমনকুমার দাশ। মঞ্চে বসেই বইটির পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। পড়তে পড়তে চোখ আটকে গেল একটা জায়গায়। ১৯৫৪ সালে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে সাধক-শিল্পী শাহ আবদুল করিম লোকায়ত ধারার গীতিকারদের মধ্যে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান রচনা করেন:

পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা
চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা
জনগণের নয়নতারা
শেখ মুজিবুর রহমান
জাগো রে জারো রে কৃষাণ।

আমি চমকে উঠলাম। তথ্যটি আমার জানা ছিল না। লোকায়ত ধারার শাহ আবদুল করিমের আগে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘শহুরে ধারার’ জাতীয় পর্যায়ের নাম-যশঅলা কোনো কবি কবিতা লেখেননি, গান লেখেননি, গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখেননি। শাহ আবদুল করিমই প্রথম।

তার মানে ইতিহাসের ভবিষ্যৎটা আগে কে টের পেল? কে বুঝতে পারল শেখ মুজিবই যে বাংলার ভবিষৎ-কাণ্ডারি হবেন? টের পেলেন সেই সাধক, যাকে আমরা নাগরিক কবি-সাহিত্যিকরা ছোট ভাবি, খাটো ভাবি, অস্পৃশ্য ভাবি, শূদ্র ভাবি। যেমন ভেবেছিলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। একবার তিনি শাহ আবদুল করিমের গান নিয়ে একটা প্যাকেজ পোগ্রাম করলেন। করিমকে আনার জন্য সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে পাঠালেন এক লোককে। লোকটির জোরাজুরিতে ঢাকায় এলেন করিম। হুমায়ূনের হয়ে এক লোক তার সাক্ষাৎকার নিলেন। ফিরে আসার সময় হুমায়ূন আহমেদ তার সঙ্গে সৌজন্যমূলক আলাপটুকুও করলেন না। কিছু টাকা দিলেন, তাও ড্রাইভারের মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গে টিএম আহমেদ কায়সারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শাহ আবদুল করিমের প্রশ্ন, বাউলরা কি এতই অস্পৃশ্য? এভাবেই উপেক্ষিত থাকবে যুগের পর যুগ? হাওড় অঞ্চলে আমি বড় হয়েছি, অন্তত মনটা তো ছোট নয়। শুধু টাকার জন্য কি আমি এতদূর গিয়েছিলাম।

এই ‘অস্পৃশ’ সাধকদের আরেকজন হচ্ছেন চারণকবি মোসলেম উদ্দিন বয়াতী। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি লিখেছেন:

অমানিশি মান দেন তৃণাদপি সুনেচন
তরুরেবা সহিষ্ণুতা মহামানব সমীচীন
তুমি পিতা, তুমি ভ্রাতা, তুমি বন্ধুবর
সর্বরূপী তুমি দয়াল শেখ মুজিবর
তুমি দিবা ও নিশি, তুমি কান্না ও হাসি
তুমি আকাশের শশী, তুমি সাক্ষাৎ ভগবান।

খেয়াল করে দেখুন, মুসলিম উদ্দিন বয়াতী সেই কত আগে বঙ্গবন্ধুকে ‘পিতা’ সম্মোধন করেছেন। জাতির পিতা। তার আগে জাতীয় পর্যায়ের খ্যাতিমান কোনো কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর লেখায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পিতা’ উল্লেখ করা হয়েছে, এমন তথ্য আমার জানা নেই। সাইমন জাকারিয়া তার বইতে দেখিয়েছেন, লোকসাধক-বাউল-ফকির-চারণ কবিদের লেখায় কীভাবে এসেছেন বঙ্গবন্ধু। এই যে লোকসাধক-বাউল-ফকিররা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন, এর পেছনে তাদের ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না। দু-পয়সা কামাইয়ের জন্য লেখেননি, বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য লেখেননি, নিজের যশ-খ্যাতির জন্য লেখেননি। লিখেছেন বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে, লিখেছেন প্রাণের তাগিদে, লিখেছেন সমাজ ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে।

আর এখন? মুজিববর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিস্তর বই-পুস্তক লেখা হয়েছে, হচ্ছে। এগুলো কতটা মনসম্পন্ন সেই আলোচনায় যাব না। শুধু একটা গল্প বলি। গত বছরের কথা। জনৈক ব্যক্তি একদিন ফোন দিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গল্পের একটি সংকলন সম্পাদনা করবেন। আমাকে বললেন আমি যেন গল্পকারদের একটি তালিকা তৈরি করে দিই। আমি জানতে চাইলাম, ‘এই সংকলনের সম্পাদক কে?’ তিনি বললেন, ‘আমি।’ বললাম, ‘সম্পাদক আপনি, আর তালিকা তৈরি করে দেব আমি? আপনার কাজটা কী তবে? লেখা জোগাড় করা?’ তিনি ঠিক উত্তরটি দিতে পারলেন না।

মুজিববর্ষকে কেন্দ্র করে এরকম বিস্তর অযোগ্য ব্যক্তি ‘যোগ্যতার’ পরিচয় দিচ্ছেন। আমরা তাদের যোগ্যতা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখে যাচ্ছি। এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কতটা সম্মানিত করা হচ্ছে, আমি ঠিক জানি না। বইমেলার শুরু থেকে স্টলগুলোতে ঘুরে ঘুরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত বইগুলোর দেখার চেষ্টা করেছি, করছি। লেখা বাহুল্য, অধিকাংশই মানহীন। সহজেই বোঝা যায়, এক শ্রেণির লেখক-প্রকাশক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য, বিশেষ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য, ফাঁকতালে দু-পয়সা কামিয়ে নেয়ার জন্য বইগুলো প্রকাশ করছেন।

সাইমন জাকারিয়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ অসাধারণ এই গবেষণাকর্মটির জন্য। বইটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত। পড়ছি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, আমরা যারা নগরে বসে শিল্প-সাহিত্য করি, আমরা যারা কথায় কথায় দেরিদা-ফুকো-ফ্রয়েড-লাঁকা আওড়াই, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের চেয়ে প্রান্তবাংলার সাধক-শিল্পী-বাউল-ফকিরেরা অনেক বেশি ভূমিকা রেখেছেন, রাখছেন। আমাদের চেয়ে তারা অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন, অনেক বেশি তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা। জাতির সংকটে প্রথমে তারাই এগিয়ে আসেন। ইতিহাসের ভবিষ্যৎ, সমাজের স্পন্দন তারাই প্রথম টের পান।

বাউলশিল্পী শাহ আবদুল করিমকে বুকে জড়িয়ে ধরে অশ্রু ছেড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘করিম ভাইকে যত দেখি ততই মুগ্ধ হই। এই একটা মানুষকে কেন এত ভালোবাসি, তা নিজেও জানি না।’ শাহ আবদুল করিমের মতো অসংখ্য লোকশিল্পীকে ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু, ভালোবাসতেন তাদের গানকে। কারণ তিনি জানতেন বাংলার ভাবকে, তিনি বুঝতেন বাংলার লোকচেতনাকে, তিনি বুঝতেন বাঙালি মানুষের দর্শনকে।

আর আজ? এই প্রশ্ন তোলা থাকুক।

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০