মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ১৭

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মার্চ ১৯, ২০২০

প্রকৃতির বুঝি একটা বাটখারা আছে। দুই পাল্লাকেই সে সমান রাখে। কোনো একটা পাল্লা ভারি হয়ে গেলে কিছুটা কমিয়ে সে ব্যালেন্স করে। ব্যালেন্স করার জন্য সে প্রয়োগ করে তার অস্ত্র, আমরা যাকে বলি মহামারি। এই মহামারি যুগে যুগে কালে কালে এসেছে পৃথিবীতে। কখনো প্লেগ নামে, কখনো কলেরা নামে, কখনো সোয়াইন ফ্লু, কখনো বার্ড ফ্লু আর কখনো এইডস নামে। এই বাংলায়ও একদা মহামারি আসতো। আমাদের পূর্বপুরুষ তাদের নাম দিত ওলাবিবি, ঝোলাবিবি, মড়িবিবি। ব্যাধির বীজ ভরা কুঁজ নিয়ে তারা হাজির হতো দোর্দণ্ড প্রতাপে। মরণদণ্ড ঘোরাতে ঘোরাতে বিরান করে দিত জনপদের পর জনপদ। কত গ্রাম, কত গঞ্জ, কত নগর যে বিরাণ হয়ে পড়েছিল, তার তো কোনো শুমার ছিল না।

কিংবা এমনও হতে পারে, এসব মহামারি প্রকৃতির কোনো অস্ত্র নয়। এ আমারই ভুল ধারণা। কেননা আমিই তো প্রকৃতির অংশ। আমার মতো হাজার হাজার প্রাণ-অপ্রাণের সমন্বিত শক্তিই তো প্রকৃতি। প্রকৃতি তো আলাদা কোনো সত্তা নয়। আমিই প্রকৃতি, আমরাই প্রকৃতি। এসব মহামারি হয়ত প্রকৃতির কোনো গভীর গভীরতর অসুখ। অসুখ তো থাকে, থাকতে হয়। দিন থাকলে রাত থাকবে, রোদ থাকলে বৃষ্টি থাকবে, পূর্ণিমা থাকলে অমাবস্যা থাকবে। একইভাবে সুখ থাকলে অসুখও থাকবে। জীবনে আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিষাদ। হরিষে বিষাদ। পুরাণ হয়ত একেই বলে সুর ও অসুর। সুরাসুরের যুদ্ধ পৃথিবীতে চলছে অবিরাম। সেই যুদ্ধ সাধারণত আমরা চর্মচক্ষে দেখি না। কিন্তু যুদ্ধটা যখন ভয়াবহ রূপ নেয় তখন আমরা দেখি। আমরা তাকে বলি মহামারি।

আমি দুই শতাব্দীর সন্তান। দেখেছি বিশ শতকের মৃত্যু আর একুশ শতকের জন্ম। বেঁচি আছি একুশের বুকে। দেখিনি কোনো মহামারি। শুনেছি পূর্বপুরুষের মুখে, পড়েছি ইতিহাসে, সাহিত্যে। ভেবেছি এই জন্মে আর মহামারি দেখা হবে না। মানুষ তার সর্বোচ্চ মেধা প্রয়োগ করে মহামারি নামক অসুরকে বিদায় করে দিয়েছে এই পৃথিবী থেকে। কিন্তু না, ধারণা ভুল হলো। ‘করোনা ভাইরাস’ নাম নিয়ে হাজির হলো এক মহামারি। মানুষ মুখোমুখি হলো ভয়াবহ এক সংক্রামক ব্যাধির। এই অসুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা পৃথিবী। তার ভয়ে প্রাণীকুলের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার মানুষেরা সন্ত্রস্ত। মানুষ মরছে হাজারে হাজার। ঠেকানো যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল।

এই অসুরের আক্রমণ ঠেকাতে পৃথিবীতে ঘটে যাচ্ছে এমন সব ঘটনা, যা ঘটতে পারে আমরা কখনো ভাবিনি। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মুসলমানদের শীর্ষতীর্থ মক্কা-মদিনা, সেখানকার যাবতীয় উপাসনা। সৌদিসহ আরবের বেশ কটি দেশে মসজিদে নামাজের জামাত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জুমা বন্ধ হয়েছে আরবের বাইরের দেশেও। একসঙ্গে নামাজ পড়া যাবে না, করোনা সংক্রমণ হতে পারে। কুয়েতের মসজিদ থেকে আজানের মাধ্যমে মসজিদে আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। প্রচারিত হচ্ছে বিশেষ আজান। ‘হাইয়া লাস-সালাহ’র পরিবর্তে প্রচারিত হচ্ছে ‘আসসালাতু ফি বুয়ুতিকুম’। অর্থাৎ ‘তোমরা বাড়িতে বসে নামাজ পড়ো।’

ওদিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে খ্রিস্টানদের শীর্ষতীর্থ ভ্যাটিকান সিটি। ভক্তকে চুমু খেয়ে জ্বরাক্রান্ত, করোনার শঙ্কায় শঙ্কিত ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস লাইভে পরিচালনা করছেন ধর্মসভা। করোনা ঠেকানোর আশায় ইরানিরা শাস্ত্র ও রাষ্ট্রের বিধিবিধান উপেক্ষা করে দেদারসে খাচ্ছে মদ। মদ খেয়ে কেউ কেউ হয়ে পড়ছে অসুস্থ। আমেরিকাসহ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোতে জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা। সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে বহু দেশের সীমান্ত। হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। পৃথিবীটা যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। স্থবির হয়ে গেল। যেন সে ক্লান্ত। তার যেন একটু বিশ্রাম দরকার।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশও করোনার হুমকির মুখে। স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ থেকে সতর্ক করা হয়েছে বাংলাদেশকে। দেশে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সতেরজন, মারা গেছে একজন। কোয়ারেন্টিন বা পর্যবেক্ষণে রাখা রয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে। করোনা নামক অসুরের হাত থেকে বাঁচতে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে প্রবাসীরা ফিরছে দেশে। করোনা নিয়ে কিংবা না নিয়ে। আমরা তাদের ফেরাকে ঠেকাতে পারিনি, পারছি না, হয়ত পারবও না। কেননা তারা এ দেশেরই মানুষ, দেশে ফেরার অধিকার রয়েছে তাদের। তাদেরকে বলা হচ্ছে হোম কোয়ারেন্টিন বা গৃহপর্যবেক্ষণে থাকার জন্য। কেউ থাকছে, কেউ থাকছে না, কেউ পালিয়ে যাচ্ছে, কেউ আবার রাষ্ট্রকে ‘ফাক’ বলে গালি দিচ্ছে। কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে হাটে-বাজারে, জনসমাগমে।

সরকার স্কুল-কলেজ ছুটি ঘোষণা করল। ছাত্রছাত্রীদের ঘরে রাখতে বলল। ছুটি পেয়ে আমরা চলে গেলাম কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কুয়াকাটায়। আমরা ভাবলাম আনন্দ-ফূর্তির এই তো সুযোগ, যত পারো ফূর্তি করো। এই অসুরের হুহুংকারের কালে বারবার যেখানে বলা হচ্ছে জনাসমাগম এড়িয়ে চলতে, সেখানে গতকাল সকালে লক্ষ্মীপুরের হায়দরগঞ্জ ঈদগাহ ময়দানে লাখো মানুষ জমায়েত হয়ে করোনা থেকে মুক্তির জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করেছে। অপরদিকে একদল গুজব ছড়িয়েছে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যাবে, মানুষ ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। বাঙালি তো চিরকালের গুজবপ্রিয়। গুজবে সাড়া দিয়ে মানুষ ভিড় করছে হাটে-বাজারে, খালি করে দিচ্ছে মুদিখানাগুলো। খাদ্য জমা করে ঘরগুলোকে করে তুলছে একেকটা মুদিখানা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমন বেচাকেনা ঈদের সময়ও হয় না। কেউ ভাবছে না বেঁচে থাকার জন্য যে এত এত খাবারের দরকার হয় না। চাল, ডাল আর লবন হলেই বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু আমাদের বেশি চাই, বেশি বেশি চাই। একজনের বেশির জন্য যে আরেকজন বঞ্চিত হতে পারে সেই ভাবনা কারো নেই। আমরা কোনো কিছুই মানছি না। কারণ আমরা বাঙালি। একারণেই বুঝি পুর্বপুরুষ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’

আর মুসলমান? চীনে যখন করোনা দেখা দিল, এই বাংলার কতিপয় মৌলবি-মাওলানা বলতে শুরু করল, এটা নাকি আল্লাহর গজব। করোনা নাকি আল্লাহর সোলজার। চীনা সরকার কর্তৃক উইঘুর মুসলমানদের নির্যাতনের কারণেই নাকি চীনা নাস্তিকদের ধ্বংস করার জন্য করোনা নাম দিয়ে আল্লাহ তার সৈনিক পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে। মুফতি ইব্রাহিম নামের এক ধর্মকথা সওদাগর বলে বেড়াতে লাগল করোনা ভাইরাসের সঙ্গে নাকি তার স্বপ্নে কথা হয়েছে। করোনা নাকি স্বপ্নে তাকে মুক্তির সূত্র বলে দিয়েছে। তার স্বপ্নে পাওয়া এই সূত্র নিয়ে নাকি ইউরোপ-আমেরিকায় গবেষণা শুরু হয়ে গেছে। শুরুতে ইব্রাহিম বলেছিল করোনা নাকি শুধু চীনে থাকবে, বিশ্বের কোথাও যাবে না। কারণ শুধু চীনা নাস্তিকদের ধ্বংস করার জন্য আল্লাহ পাঠিয়েছেন করোনা। কিন্তু করোনা যখন ইরানে ঢুকল তখন সে বলল, ইরানের মুসলমানরা খাঁটি মুসলমান নয়। কিন্তু সৌদি আরব? এ নিয়ে ইব্রাহিম নীরব। কারণ সেটা তীর্থস্থান। সেটা নিয়ে সে কথা বলবে না। বললে তার সওদাগরি থাকবে না। কিন্তু বলল মুফতি মোহাম্মদ নোমান কাসেমি নামের আরেক ধর্মকথা সওদাগর। সে চিৎকার করে বলল, ‘কুয়েতে, সৌদি আরবের মসজিদে নামাজ বন্ধ হবে সেটা আমাদের দেখার সময় নাই। বাংলাদেশের কোনো মসজিদে নামাজ বন্ধ হতে পারবে না।’ আরেক ধর্মকথা সওদাগর বলল, করোনাতেই নাকি আছে মুক্তির ওষুধ। সে ব্যাখ্যা দিল, ‘ক-তে কোরান, রো-তে রোজা, না-তে নামাজ।’ অর্থাৎ কোরান-রোজা-নামাজই নাকি মুক্তি দিতে পারে করোনা থেকে। একেই বলে গাঁড়লামি। এদেরকেই বলে গাঁড়ল। আর ওদিকে চীনে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর সেই ঘটনাকে দেশটির ওপর ‘আল্লহর গজব’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন ইরাকের শিয়া ধর্মতাত্ত্বিক মাওলানা হাদি আল-মোদাররেসি। এবার তিনিও আক্রান্ত হলেন ধর্ম ও রাষ্ট্রনিরপেক্ষ করোনা ভাইরাসে।

আমি মনে করি না পৃথিবীর সব মুসলমান মুফতি ইব্রাহিম, কাসেমি বা মোদাররেসির মতো গাঁড়ল। অগ্রসর, উদার, বহুত্ববাদী, মানবতবাদী মুসলমানের সংখ্যা পৃথিবীতে কম নয়। কিন্তু তারা গাঁড়লদের কাছে অনেকটা কোণঠাসা। এই গাঁড়লদের নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। তারা পিছিয়ে পড়া মানুষ। একদিন নিশ্চয়ই তারা অগ্রবর্তীদের দলে ভিড়বে। একদিন নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে উদয় হবে শুভবোধ। একদিন নিশ্চয়ই তারা মনবতা ও সর্বপ্রাণবাদকে মহীয়ান করে তুলবে। কিন্তু ভারতবর্ষের হিন্দুরা? ভেবেছিলাম বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষের হিন্দুরা অনেক এগিয়েছে। ভুল ভাবনা। করোনা ভাইরাস ঠেকাতে তাদের কেউ কেউ পান করছে গোমূত্র। গোমূত্র আর গোবরই নাকি ঠেকিয়ে দেবে করোনা। তারা পূজা করছে গরুকে। কারণ গরুতে থাকে তেত্রিশ কোটি দেবতা। হায় ভরতবর্ষ! হায় ভারতপুত্রগণ!

আর ওদিকে আমেরিকা আবিষ্কার করেছে করোনা ভাইরাসের টীকা। পরীক্ষামূলক প্রথম ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে চৌত্রিশ বছর বয়সী জেনিফার হ্যালার নামে এক নারীর দেহে। জেনিফার নিশ্চয়ই সোনার মানুষ, সর্বমানবের কল্যাণে যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রহণ করলেন করোনার প্রতিষেধক। তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম। বসে নেই চীন-রাশিয়ার বিজ্ঞানীরাও। তাঁরাও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন এই অসুর ঠেকাতে। বাংলাদেশের উদ্দেশে চীন বলেছে, মহামারি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সাহায্য করবে চীন। এই হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব, এই হচ্ছে তাদের উদারতা। তারাই সত্যিকারের মানুষ। আমরা তাদের যতই গালি দিই, মানুষের সংকটে এগিয়ে আসেই তারাই। সুতরাং তারাই তো দেবে পৃথিবীর নেতৃত্ব।

সর্বপ্রাণ সুখী হোক।
অসুরের থাবা থেকে মুক্তি পাক মানুষ।