মহাকালে রেখাপাত

পর্ব ১৯

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : মার্চ ২৭, ২০২০

যখন প্রলয়ংকারী ঝড় ওঠে, বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষ ঘরের ভেতর থেকে শিল-পাটার শিলটা ছুঁড়ে মারে উঠানে। এতে নাকি ঝড়ের গতি কমে যায়। এটা লোকবিশ্বাস। লোকবিশ্বাস লোকসংস্কৃতিরই একটা উপাদান। এই সংস্কৃতির উৎপত্তি কোথায়, কবে থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, আমার ঠিক জানা নেই। হয়ত আদিম কালে, মানুষ যখন গুহাবাসী ছিল, মানুষ যখন বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। হয়ত তারা ঝড়কে কোনো অপদেবতা মনে করত। শিল ছুঁড়ে মারলে সেই দেবতা আহত হবে। আহত হয়ে পালিয়ে যাবে। আমাদের ছোটবেলায় এই সংস্কৃতিটা চালু ছিল। এখনো আছে কিনা, কে জানে। হয়ত আছে। লোকবিশ্বাস মানুষের মনে একবার খুঁটি গেঁড়ে বসলে সহজে যায় না।

একইভাবে, বিধ্বংসী ঝড়ের সময় যখন ঘরের চালটা উড়ে যায় যায়, বাড়ির মানুষেরা যখন বিপন্ন বোধ করত, যখন বুঝতে পারত এই মহাদুর্যোগে তাদের বাঁচানোর মতো কেউ নেই, কেউ বাঁচাতে আসবে না, তখন তারা পশ্চিমমুখো দাঁড়িয়ে আজান হাঁকতে শুরু করত। খোদার মহত্ব ঘোষণা করে তার আশ্রয় কামনা করত। কিন্তু ঝড়ের ভয়ংকর হুঙ্কারের শব্দ উজিয়ে সেই মহত্বকথা খোদার কুদরতি কান পর্যন্ত পৌঁছত না। নইলে তুফান থামত না কেন? কেন উড়ে যেত বাড়িঘর? তবে কি আজান নিরর্থক? ধর্মগুরুরা বলত, না না, নিরর্থক হবে কেন? খোদার আরেক নাম তো ‘কাহহার’। অর্থাৎ ধ্বংসকারী। তিনি যখন ধ্বংসকাণ্ডে মেতে ওঠেন তখন তার ‘রাহিম’ (দয়ালু) রূপটি বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। তাই তিনি আজান শুনেও সদয় হন না। তাই বলে আজান দেয়া বন্ধ করা যাবে না। বন্ধ করলে তিনি আরো গোস্বা হবেন। মেতে উঠবেন আরো ভয়ংকর ধ্বংসলীলায়।

গতকাল রাত দশটার দিকে গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন এলো। গ্রামের মসজিদে মসজিদে নাকি আজান হাঁকা হচ্ছে। ইমাম-মুয়াজ্জিনরা নাকি সবাইকে অনুরোধ করছে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আজান হাঁকতে। তাই সবাই আজান দিচ্ছে। এত রাতে আজান কেন? মনে পড়ে গেল শৈশবস্মৃতি: মধ্যরাতের ঘোর তুফানে মানুষজন আজান হাঁকছে, উঠানে শিল ছুঁড়ে মারছে। ভাবলাম, হয়ত করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির আশায় আজান হাঁকা হচ্ছে এত রাতে। আতঙ্কের কিছু নাই। আশ্বস্ত করলাম আত্মীয়দের। কিন্তু গ্রামের মানুষ তো গুজবপ্রবণ। সহজে কি তারা আমার কথা বিশ্বাস করে! নিশ্চয়ই খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু খারাপ কিছুটা কী?

জানা গেল খানিক পর। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় নাকি একটা শিশু জন্ম নিয়েছে। জন্মের কুড়ি মিনিট পর সে কথা বলেছে। বলেছে, ‘মুসলমান হলে আজান দাও, হিন্দু হলে উলুধ্বনি দাও। করোনা ভাইরাস পালাবে।’ তার কথামতো মুসলমানরা আজান দিচ্ছে, হিন্দুরা উলুধ্বনি দিচ্ছে। আজান ও উলুধ্বনির শব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে রাতের নৈঃশব্দ্য। অজানা আতঙ্ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জনপদে জনপদে।

কিন্তু পরক্ষণে আবার গুজব ছড়াল, আনোয়ারায় নয়, শিশুটির জন্ম হয়েছে নোয়াখালিতে। এই গুজবের ভার্সনটা আলাদা। এই ভার্সন অনুযায়ী ছেলেটি শুধু আজান দিতে বলেছে, উলুধ্বনি দিতে নয়। এবং বলেছে, দুধ-চিনি ছাড়া আদা দিয়ে লাল চা খেতে। এটাই নাকি করোনা ভাইরাসের একমাত্র ওষুধ। বলেই ছেলেটি মারা গেছে। ছেলেটির কথামতো করোনায় আতঙ্কিত মুসলমানেরা আজান দিচ্ছে। মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে দফায় দফায় খাচ্ছে আদা-চা।

আরো কিছুক্ষণ পর শোনা গেল আরেকটা গুজব। এই গুজবের উৎপত্তি স্থল রংপুর কি চাঁদপুর কি কুমিল্লা। রাত দশটার দিকে ফেসবুকের মাধ্যমে নাকি গুজব ছড়ায় যে, রাত বারোটায় কেয়ামত সংঘটিত হবে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আর মাত্র তিন ঘণ্টা বাকি। মসজিদে মসজিদে বাড়িতে বাড়িতে আজান দিতে হবে। আজান দিলে কেয়ামত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। গুজবে তো মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধির বিলুপ্তি ঘটে। তারা বিচার করে দেখল না শাস্ত্রমতে কেয়ামত যে অনিবার্য। এই অনিবার্য কেয়ামত যে আজান দিয়ে ঠেকানো যাবে না। শাস্ত্রের কথা ভুলে তারা মসজিদে মসজিদে মসজিদে আর বাড়িতে বাড়িতে দিতে শুরু করল আজান।

আমি ঘুমাচ্ছি না। ফেসবুক দেখছি। ফেসবুকে খরস্রোতা নদীর মতো প্রবাহিত হয় সমস্ত তথ্য ও গুজব। এবার জানা গেল আরেকটি গুজবের কথা। কে যেন গুজবটি নিয়ে রসিকতা করে পোস্ট দিলেন। তার নামটি মনে নেই। এই গুজবের উৎপত্তি স্থল হবিগঞ্জের চুনারুঘাট। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে গুজব ছড়ায় যে, আকাশ থেকে আরবি হরফ ‘আলিফ’ পড়ে ঢুকে গেছে মাটির গভীরে। রাত ঠিক বারোটায় এটা বিস্ফারিত হবে। তখন ভয়াবহ বৈশাল (ভূমিকম্প) শুরু হবে। সেই বৈশালে ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। মানে কেয়ামত ঘটে যাবে। এই গুজবে জেগে ওঠে চুনারুঘাটের ঘুমন্ত মানুষজন। বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। রাস্তায় নেমে তারা ‘আল্লাহু আকবর’ ‘লা ইলাহা ইল্লাহ’ ধ্বনি দিতে দিতে শুরু করে। খবর পৌঁছে যায় পুলিশের কানে। পুলিশ এসে শুরু করে ধাওয়া। পুলিশকে বুঝি তারা গজবের ফেরেশতা ভাবল মানুষজন! গজবের আতঙ্কে তারা ঘরে ফিরে গেল। রাত বারোটা বেজে যায়, অথচ কেয়ামত হয় না। একটা বেজে যায়, কেয়ামত হয় না। দুইটা বেজে যায়, তাও হয় না। কেয়ামতের বদলে পৃথিবীতে নামে নৈঃশব্দ্য। সেই নৈঃশব্দ্যে সমর্পিত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মানুষজন।

সহসা আমার কাল নিয়ে আমার মধ্যে সংশয় তৈরি হলো। আমি কি একুশ শতকের মানুষ? নাকি হাজার বছর আগেকার? এই শতকের দ্বিতীয় দশকে, বাংলাদেশ যখন প্রযুক্তির ডানায় ভর করে এক নবযাত্রা শুরু করল, যাকে বলা হলো ডিজিটাল যাত্রা, আমরা ভেবেছিলাম এই দেশ থেকে অশিক্ষার অন্ধকার বুঝি এবার নির্মূল হবে। মানুষ বুঝি বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে উঠবে। কিন্তু না, কদিন যেতেই আমরা দেখলাম প্রযুক্তির এই প্রদীপকে ঢেকে দিয়েছে অশিক্ষার অন্ধকার। ফেসবুক ব্যবহার করে কোরান অবমাননার গুজব ছড়ানো হলো। হাজার হাজার মুসলমান গিয়ে পুড়িয়ে দিল রামু বৌদ্ধবিহার। একইভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ভোলায় কোরান অবমাননার গুজব ছড়ানো হলো ফেসবুকে। হাজার হাজার মুসলমান মেতে উঠল ধ্বংসকাণ্ডে আরো গুজব ছড়ানো হলো ছেলেপিলেদের কল্লা কেটে নাকি পদ্মাসেতুর পিলারের গোড়ায় দেওয়া হচ্ছে। ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মরতে লাগল মানুষ। প্রযুক্তিকে ব্যাবহার করে আরো কত কত গুজব যে ছড়াল তার তো কোনো শুমার নেই।

এ কারণেই বারংবার একই কথা বলি যে, উন্নয়ন করতে হলে মানুষের মননের উন্নয়নও করতে হবে। অর্থনীতি ও মনন―পাশাপাশি দুটোরই উন্নয়ন দরকার। বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে মননের ঘাটতি। এই ঘাটতি বহুকালের পুরনো। মাঝেমধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে। এই ঘাটতি কি আদৌ দূর হবে? কে করবে দূর? কোথাও তো কেউ নেই। কোথাও তো আলো নেই। যাদের প্রদীপ জ্বালানোর কথা তারা ‘সকলকে আলো দেবে মনে করে অগ্রসর হয়ে/তবুও কোথাও কোনো আলো নেই বলে ঘুমাতেছে।’

আমি আনোয়ারায় জন্ম নেওয়া সেই শিশুটির কথা ভাবি, জন্মের কুড়ি মিনিটের মাথায় করোনা ভাইরাস দূর করতে যে একইসঙ্গে আজান ও উলুধ্বনি দিতে বলেছিল। সে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়েরই বার্তাবাহক। আর ভাবি মজিদের দেশ নোয়াখালিতে জন্ম নেওয়া শিশুটির কথা, যে কিনা শুধু আজান দিতে বলেছে। সে শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের বার্তাবাহক। দুই শিশুর চেহারা দুটি কল্পনা করি। তাদের কথা বলার ধরণ কল্পনা করি। আর ভাবি আকাশ থেকে মাটির গভীরে ঢুকে পড়া ‘আলিফ’-এর কথা। হরফটা দেখতে বুঝি পারমানবিক বোমার মতো! হয়ত। আমার মনে হলো, এগুলোও গল্প বটে। মানুষের মুখে মুখে তৈরি হওয়া গল্প। পৃথিবীতে এখনো গল্পের শাসন চলছে। এসব গল্প থেকেই বুঝি জন্ম নেয় ম্যাজিক রিয়েলিজম। এসব গল্প থেকেই বুঝি জন্ম নেয় ইলিয়াদ, ওডিসি, ইনিড কিংবা রামায়ণ, মহাভারতের মতো মহাকাব্য।

২৭.৩.২০২০