
স্বকৃত নোমান
মহাকালে রেখাপাত
পর্ব ২৪
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : জুন ১২, ২০২০
শৈশবে এমন একজন মানুষকে দেখেছিলাম, যে কিনা চল্লিশ বছর বাঘের পেটে ছিল। চল্লিশ বছর পর বাঘ তাকে উগরে দেয়। মানুষ কি চল্লিশ বছর বাঘের পেটে থাকতে পারে? কোনো যুক্তিতেই পারে না। কিন্তু মানুষ তাই বিশ্বাস করত। এখনো করে। যেমন বিশ্বাস করে ইউনুস নবি চল্লিশ দিন মাছের পেটে ছিলেন, শাহজালাল জায়নামাজে চড়ে সুরমা নদী পাড়ি দিয়েছিলেন, শাহ মাখদুম কুমিরের পিঠে চড়ে রাজশাহী গিয়েছিলেন, সুন্দরবনের বাঘেরা বড়খাঁ গাজীর কথা শোনে, তার কথায় উঠবস করে। মানুষের বিশ্বাসের কত যে রকমফের! এসব বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে বিচার করা চলে না। বিচার করতে গেলে তল খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাঘের পেটে থাকা সেই মানুষটি ছিল আমার কাছে বিস্ময়। একটা সুতাও ছিল না তার গায়ে। সবসময় উলঙ্গ থাকত। শীত-গ্রীষ্ম সবসময়। একটা সময় আমার মনে হলো, আচ্ছা, এই যে সবাই বিশ্বাস করে মানুষটি চল্লিশ বছর বাঘের পেটে ছিল, চল্লিশ বছর পর বাঘ তাকে উগরে দিল—এটা কীভাবে সম্ভব হলো? মানুষ কোথায় পেল এই গল্প? কীভাবে সৃষ্টি করল এই মিথ? মিথ কীভাবে সৃষ্টি হয়? মিথ কীভাবে শাসন করে মানুষের মনোজগৎ? এই ভাবনা থেকেই মানুষটিকে মূল চরিত্র করে একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। আমি জানতাম না, উপন্যাসটি কোথায় নিয়ে যাব, কোথায় শেষ হবে।
আমি লিখতে থাকি। লিখতে লিখতে ঢুকে পড়ল আরো বিস্তর চরিত্র, বিস্তর ঘটনা। সীমান্তবর্তী একটি জনপদ ও সেই জনপদের মানুষজন, মিথের ক্ষমতা, সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও আধিপত্য, সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, ধর্মের নানা ধারা-উপধারা এবং লোকবিশ্বাসের ভাঙা-গড়া ইত্যাদি ঢুকে পড়ল উপন্যাসটির বিশাল পরিসরে। প্রায় দেড় বছর লেগে গেল উপন্যাসটি লিখে শেষ করতে। শব্দসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল এক লাখ পঁচিশ হাজার প্রায়। করোনাকালের দীর্ঘ ছুটিতে আমি উপন্যাসটিতে পূর্ণ মনোযোগ দিলাম। টানা দুই মাস লেগে ছিলাম এটির পেছনে। সম্পাদনা করতে করতে প্রায় ষোল হাজার শব্দ বাদ পড়ে গেল। এখন শব্দসংখ্যা দাঁড়াল এক লাখ নয় হাজার প্রায়। অর্থাৎ প্রায় চারশো পৃষ্ঠার উপন্যাস। বাইশটি পর্বে বিভক্ত উপন্যাসটির প্রতিটি পর্বের শুরুতে ব্যবহার করার জন্য একটি চমৎকার রেখাচিত্র এঁকে দিয়েছেন শ্রদ্ধাভাজন শিল্পী মাসুক হেলাল।
উপন্যাসটির নাম নিয়ে ভুগছিলাম খুব। বইয়ের নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আর্থার শোপেনহাওয়ারের সেই কথাকে গুরুত্ব দিই। বইয়ের নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘গ্রন্থের নামকরণের বিশেষ সাবধান হওয়া কর্তব্য। কারণ, চিঠির ঠিকানার মতোই ওই নামের দ্বারা তাকে পাঠকবর্গের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। নাম যদি খুব দীর্ঘ হয়, বা অর্থহীন হয়, কিংবা দ্ব্যর্থপূর্ণ হয়, তবে তেমন নাম ভালো নয়; যদি তা মিথ্যা বা ভিন্নার্থবোধক হয়, তবে তো কথাই নেই―তেমন গ্রন্থ ভুল ঠিকানাযুক্ত চিঠির দশা প্রাপ্ত হয়। আর যদি চুরি করা নাম হয়, অর্থাৎ অপর কোনো বইয়ের নাম হয়, তবে তার মতো মন্দ আর কিছু হতে পারে না। কারণ প্রথমত, তা একরূপ সাহিত্যিক চৌরকর্ম। দ্বিতীয়ত, তার দ্বারা নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয় যে, ওই লেখকের লেশমাত্র মৌলিকতা নেই।’
তাই বইয়ের নামকরণের বিষয়ে আমি সতর্ক থাকি। কিন্তু উপন্যাসটির কোনো নামই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি নাম রাখি, আর গল্পকার মোজাফ্ফর হোসেন সেই নাম বাতিল করে দেন। কোনো নামই তার পছন্দ হচ্ছিল না। একদিন পেয়ে গেলাম একটি নাম। মোজাফ্ফর এবার পছন্দ করলেন। কথাশিল্পী হামীম কামরুল হক খুব উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, ‘অসাধারণ নাম! এটিই রাখুন।’ রেখে দিলাম। উপন্যাসটি প্রকাশিত হবে আগামী বই মেলায়। যদি ততদিনে এই করোনা দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা যায়। যদি আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি।
১১.৬.২০২০