মারিয়া সালামের গল্প ‘ঝাঁসির রাণী’

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৩, ২০১৯

প্রতিমা থানে উঠতে আর দেরি নেই। রাত পোহালেই হবে দূর্গা বরণ। গলির মাথার মণ্ডপে পুরোদমে কাজ চলছে। অজন্তা এই পথে রোজকার মতো আজও ওড়নায় মুখখানা ভালো করে আড়াল করে মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে। এই এলাকায় ও উঠেছে তাও বছর ঘুরে এলো। নতুন নাম নিয়েছে জুলেখা। এই দেশে একা একটা মেয়েকে কেউ ঘর ভাড়া দিতে চায় না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গলির ভেতরে স্যাঁতস্যাঁতে একটা রুমে সে উঠতে পেরেছে। যদিও ভাড়াটা বেশি, তবু মাথা গোঁজার ঠাই বলে কথা, অজন্তা এককথায় রাজি হয়ে গেছে।

পাড়ার বাচ্চাদের পড়িয়ে আর পাশের মহল্লায় নতুন কলম ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করে যা পাচ্ছে, বেশ টেনেটুনে চলে যাচ্ছে। যদিও মাসের শুরুর দিকের এই সময়টাতে খুব টানাটানি চলে। ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগই গরিব পরিবারের। তাদের বেতন পেতে পেতে মাসের পনের তারিখ। তাতে ওর খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু এবারের কথা ভিন্ন, পূজা বলে কথা। অজন্তার অনেকদিনের শখ, ঘরে ঠাকুরের প্রতিমা নিয়ে আসবে। সেটা এই মুসলমান পরিচয়ে সম্ভব নয়। তবে কিছু না হলেও একটা লালপেড়ে শাড়ি অন্তত নেয়া দরকার। এবার সেটাও হবে না বলে মনে হচ্ছে।

কতদিন পূজার সময় মণ্ডপে যাওয়া হয় না। কতদিন নাড়ু-মুরকি খায় না ও। এই সময়টায় বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে অজন্তার। অনেক ইচ্ছা করে লালপাড় শাড়ি পরে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরবে, ঠাকুরকে প্রণাম করবে। এখন সেসব দূরে থাক, দূর থেকেও ঠাকুর দেখতে ভয় হয়। এখনতো ও অজন্তা না, এখন ও জুলেখা, মুসলমানের পরিচয়ে এপাড়ায় উঠেছে। এছাড়া ওর আর কিছুই করার ছিল না। অনেক কষ্টে এই পরিচয়পত্রটাই জোগাড় করা গেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, হাজার পাঁচেক টাকা ঢেলে তবেই মিলেছে পরিচয়পত্র।

মফস্বলের উচ্চবংশের মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারে জন্ম অজন্তার। বাবা-মায়ের শখ ছিল মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে বড় করবে। অজন্তাও পড়ালেখাতে বেশ ভালোই ছিল, সাথে খেলাধূলাতেও কম যেত না। বাবা-মায়ের আহ্লাদে বেশ একরোখাও হয়ে উঠেছিল বটে। মফস্বলের এইসব পরিবারগুলোতে মেয়েদের স্কুল মাধ্যমিক পাশই যথেষ্ট। তারপরেই ভালো পাত্র খুঁজে বিয়ে। এইসব এলাকায় কেউ মেয়েকে শিক্ষিত করতে চায় না বললেই চলে।

মেয়েকে এরকম ঘরে বসিয়ে রেখে পড়ানোর জন্য অজন্তার বাবা-মাকেও কম কথা শুনতে হয়নি প্রতিবেশীদের কাছে। মুখ বাঁকিয়ে অনেকেই বলেছে, ওরাতো মেয়েকে ঝাঁসির রাণী বানাবে। অজন্তা নিজেও তাই হতে চেয়েছিল। ঝাঁসির রাণীর মতো সাহসী। সেভাবেই শক্ত হাতে ভাঙতে চেয়েছিল সমাজের গড়ে দেয়া ফালতু সব ধ্যান-ধারণা। ঝাঁসির রাণী হবে বলেই, জাতপাতের তোয়াক্কা না করে ভালোবেসেছিল দেবেশকে। দেবেশরা ওদের মতো উচ্চবংশীয় না। ব্যাপারটা জানাজানি হলে বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে, খুনখারাবিও হতে পারে। সেই ভয়েই কলেজের গণ্ডি না পার হওয়া অজন্তা একদিন দেবেশের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল। সে এগারো বছর আগের কথা। তখন অজন্তার ছিল বড়জোর সতের বছর, এখন চলছে আটাশ।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই গলির মোড়ের মণ্ডপের সামনে এসে রোজকার মতো একটু দাঁড়ালো অজন্তা। ঘর থেকে বের হয়ে এটুকু আসতেই ওর হাঁফ ধরে। তার উপরে বেশ গরম পড়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে কড়া রোদ। এখানে সেই ব্রিটিশ যুগের একটা ঢোপকল আছে। অজন্তা ব্যাগ থেকে খালি বোতল বের করে পানি পুরে আবার ব্যাগে রাখে। ওড়না দিয়ে মুখটা মুছে সামনে এগোতেই ওর চোখ আটকে যায় ঢোপকল আর ড্রেনের গাঘেঁষে ময়লা ফেলার জায়গাটার কাছে। সাত-আট বছর বয়সি একটা মেয়েকে শুইয়ে রাখা হয়েছে রাস্তায় চট পেতে। মেয়েটার নড়াচড়া করার ক্ষমতা নাই। গায়ে কোনও কাপড়ও নাই, একটা কাপড়ের প্যান্ট পরা কেবল। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে এদিক সেদিক দেখছে। এই কড়া রোদে কেবল অর্ধেক শরীর দেয়ালের ছায়ায়, ঊরু থেকে পা অবধি কড়া রোদে পুড়ছে মেয়েটার।

এদিক সেদিক তাকিয়ে মেয়েটার সাথে কেউ আছে কিনা বুঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নিজেই চটের মাথা ধরে মেয়েটাকে মণ্ডপের কাছে ছায়ায় টেনে এনে রাখল। বোতল থেকে পানি খাইয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আলতো করে। এতদিন এপাড়ায় আছে, একে এর আগে কোনোদিন দেখেনি অজন্তা। মনে মনে ভাবল, দেবি থানেই উঠলো না, এরা চুক্তিতে এখন থেকেই ভিক্ষুক বসানো শুরু করে দিয়েছে। যদিও বহুবছর পূজাপার্বণে ওকে ওই ছোট্ট ঘরটার মধ্যেই নিজেকে কাটিয়ে দিতে হয়েছে। তারপরেও পূজাকমিটির এইসব বাণিজ্যে ও বরাবরের মতোই বিরক্ত। আরেকবার বিরক্তি নিয়ে মেয়েটাকে দেখল অজন্তা, অমনি ওকে অবাক করে হেসে উঠল মেয়েটা।

হা ভাগবান, এইভাবে রোদের মধ্যে ড্রেনের পাশে শুয়েও তুই এমন হাসতে শিখলি কিভাবে? প্রশ্নটা করে উত্তরের অপেক্ষা করতে হলো না ওকে, তার আগেই বুঝে গেল মেয়েটা কথাও বলতে পারে না। নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে গেল ওর। মেয়েটার মাথায় আবার হাত বুলিয়ে নিজের পথে হাঁটা দিল। ফ্যাক্টরিতে পৌঁছাতে হবে বেলা এগারোটার মধ্যেই। বুকের ভিতর থেকে লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর। মনে মনে ভাবল, আমার চেয়েও ঢের বেশি কষ্টে আছে কেউ কেউ। নিজের জীবন নিয়ে আবার একবার ভাবতে শুরু করল অজন্তা।

ঝাঁসির রাণী হতে চেয়েছিল বলেই হয়তো সমাজের নিয়ম ভেঙে দেবেশের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল, অনেক সাহসী কাজ করেছে ও। নিজের জন্য খুব ভালো লাগতো ওর। নিজের ভুল বুঝতে পারে একমাসের মাথায়, যখন দেবেশ ওকে একা ফেলে লাপাত্তা হয়। বাড়ি ফিরে যাবার পথ খোলা ছিল না অজন্তার। সত্যিকার জীবনযুদ্ধের পাঠ তখনই হয় ওর। বুঝতে পারে, সত্যিকার ঝাঁসির রাণী হবার মানে। জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে কিছু হয় না, নিয়ম পাল্টাতে চাইলে বরং নিয়মের ভেতরে থেকেই সেটা পালটে ফেলতে হয়। বাড়ি না পালিয়ে সমাজের এই ভেদাভেদ যদি দূর করতে পারতো সেটাই হয়তো সত্যিকার সাহসের কাজ হতো।

এই বুঝ সে বুঝেছে যখন জুলেখা নাম নিয়ে একা একা পথ চলা শুরু করেছে তারও বেশ পরে। মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবে, জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করার সুযোগ হলে ঠিকঠাক ঝাঁসির রাণী হয়ে উঠবে ও।

বিকেলে ঘরে ফেরার সময় অজন্তা দেখলো, মেয়েটা এখনও সেভাবেই পড়ে আছে পথে। সারাদিনের ধকলে খুব নেতিয়ে গিয়েছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সকালে যেরকম হাসিমুখ ছিল, এখন সেরকম না, কেবল কেঁদে চলেছে। চোখের নিচের কালি আর ভেতরে ঢুকে যাওয়া পেট দেখে অজন্তার বুঝতে বাকি নেই, সকাল থেকেই বাচ্চাটা অভুক্ত।

পূজা কমিটির লোকদের উপরে খুব রাগ হচ্ছে ওর। তবে রাগ দেখানোর আগে জরুরি বাচ্চাটাকে কিছু খেতে দেয়া। মুদির দোকানে কলা আর পাউরুটি কেনার সময় জানতে চাইলো, ভাই এই বাচ্চাটার সাথে কাউকে দেখেছেন?

না, সকালে দোকান খোলার পর থেকেই দেখছি পড়ে আছে এখানে। সাথে কাউকে তো দেখিনি। মুদির কথায় খুব রাগ হচ্ছিল অজন্তার। কথা না বাড়িয়ে খাবার নিয়ে ছুটলো বাচ্চাটাকে আগে খাওয়াবে বলে। ঠিক করলো যা আছে কপালে পূজা কমিটির লোকদের সাথে আজ কথা বলেই ছাড়বে।

রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে। অজন্তা ঠাঁই মেয়েটির কাছে বসা, কারো কোনও খবর নাই। পূজা কমিটির লোকেরা বলেছে, তারা এর ব্যাপারে কিছুই জানে না। অজন্তার এখন এরপাশে বসে স্বজনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নাই। রাত এগারোটা বেজে গেল। কারো দেখা নাই। বাধ্য হয়ে অজন্তা উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটা সারাদিন বাদে খাবার পেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। অজন্তা ঘরে ফেরার আগে নাইট গার্ডকে বারবার অনুনয় করে বলে এসেছে, মেয়েটির কাছে কেউ এলে ওকে যেন শেষ খবরাখবর অবশ্যই জানানো হয়।

সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরেও চিন্তা আর মন খারাপের জন্য অনেকক্ষণ জেগে রইলো অজন্তা। মেয়েটা কোথায় থেকে আসলো? কারা রেখে গেল? এভাবে রাস্তায় একা ফেলে আসা ঠিক হলো কিনা? মা বলত, দেবি কার কাছে কি রূপে ধরা দেয়, বলা মুস্কিল। তাই, জীবে সেবা করতে হবে, জীব ঈশ্বরের রূপ। মেয়েটাকে রাতে পথে না রেখে ঘরে আনতে পারত অজন্তা।

এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুম আসল বেশ রাতে। ঘুমটা কিছুটা গাঢ় হয়েছিল, তখনই হঠাৎ বাড়ির উঠানে বেশ একটা হৈচৈ শুনে চোখটা খুলে গেল ওর। ধড়ফড় করে উঠে এতটাই হতবিহ্বল হয়ে গেছে, বাতি জ্বালানোর কথাই ভুলে গেছে। অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে দরজাটা খুলেই দেখে, সেই নাইট গার্ডকে ঘিরে উঠানে বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের জটলা।

অজন্তাকে দেখেই লোকটা বলে উঠল, এই যে আপা, ওই মেয়ের কাছে তো কেউ আসেনি সারারাত। মেয়ের ঘুম ভেঙেছে একটু আগে। তখন থেকে কেবলই কেঁদে চলেছে। উপায় না দেখে আপনাকে ডাকতে এসেছি।

কয়েক সেকেণ্ড স্থির দাঁড়িয়ে থেকে অজন্তা খালি পায়েই এক দৌড়ে গলির মাথায় এসে মেয়েটির পাশে বসে পড়ল। ততক্ষণে আকাশের গা ফর্সা হয়ে আসছে। দেবির থানে ওঠার সময় হয়ে এলো বুঝি। চারদিকে ঢাকের আর উলুর আওয়াজ ছাপিয়ে অজন্তা চিৎকার করে মেয়েটাকে বলল, ঝাঁসির রাণী হবি?