মারুফ ইসলামের আত্মগদ্য ‘দহনদিনের লিপি’

পর্ব ৬

প্রকাশিত : এপ্রিল ২২, ২০২১

২০ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার
ছোট্ট একটা সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সিদ্ধান্তটি দেবেন একজন ডাক্তার, যে ডাক্তারের কাছে প্রায় ছয় বছর ধরে চিকিৎসা নিচ্ছি। বিকেল তিনটার মতো বাজে তখন। জানি এসময় ডাক্তার নেই। আমার উদ্দেশ্য, ডিউটি ডাক্তারকে অনুরোধ করে মূল ডাক্তারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে পরামর্শটি নেয়া। সবমিলিয়ে ৪২ সেকেন্ডের মামলা। তিনি শুধু `হ্যাঁ` অথবা `না` বলবেন।

ঢুকলাম ডিউটি ডাক্তারের রুমে। ছোটখাটো অল্পবয়ষ্ক এক ফর্সা রমণী বসে আছেন। গায়ে অ্যাপ্রন, গলায় স্টেথোস্কোপ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ইন্টার্ন ডক্টর অথবা সদ্য ইন্টার্ন শেষ করেছেন। এরা সবসময় গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে রাখেন।

সালাম দিয়ে রোগীর বর্তমান অবস্থা জানালাম। তারপর বললাম, রোগী এখন যেখানে ভর্তি আছেন সেখানকার ডাক্তার এই ইনজেকশনটা (প্রেসক্রিপশনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম) এক মাস পর পর দিতে বলছেন, যদিও আমরা এটা ছয় মাস পর পর দেই। এখন ম্যাডামের পরামর্শ ছাড়া তো আমরা এই ইনজেকশন হুট করে দিতে পারি না, যেহেতু তাঁর কাছেই দীর্ঘদিন ধরে ট্রিটমেন্ট করছি। আপনি কি ম্যাডামকে ফোন করে একটু শুনবেন, ইনজেকশনটা দেব কি দেব না?
ওই হসপিটালের কথা তো আমরা জানি না। ওরা কীভাবে দেবে কে জানে। আপনি পেশেন্টকে আমাদের এখানে নিয়ে আসুন।
এখন লকডাউনের মধ্যে মুভমেন্ট করা টাফ ম্যাডাম। যেহেতু ওখানে ভর্তি আছে, তাই চাচ্ছিলাম ইনজেকশন যদি দিতেই হয় তবে ওখানেই দিয়ে দিতে।
ওখানকার অবস্থা তো জানি না। কীভাবে দেবে কে জানে!
কিন্তু আপনারাই তো ওখানে রেফার করেছেন।
সেটা তো রেডিও থেরাপির জন্য। ইনজেকশানের জন্য নয়। রেডিও শেষ হলে আপনি পেশেন্ট নিয়ে আসুন।
তবুও আপনি যদি একটু ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে দেখতেন!
না, আমি কথা বলব না। আপনি রোগী নিয়ে আসুন।
আপনারা রোগীকে শুধু রোগী হিসেবেই দেখেন। মাঝে মাঝে তো মানুষ হিসেবেও দেখতে পারেন। একজন মানুষ এই লকডাউনের মধ্যে কড়া রোদ মাথায় নিয়ে পুলিশের কি পরিমাণ হ্যাসেল সহ্য করে মিরপুর থেকে ধানমন্ডি পর্যন্ত এসেছে, আপনি তা একবারও রিয়ালাইজ করার চেষ্টা করলেন না। একবাক্যে বলে দিলেন পেশেন্ট নিয়ে আসুন। এরকম সিচুয়েশনে পেশেন্ট নিয়ে মুভমেন্ট করা কী এতই সহজ? অথচ আপনি ইচ্ছে করলে একটু হেল্পফুল আচরণ করতেই পারতেন। আপনি ম্যাডামকে জাস্ট একটা ফোন করলে উনি হ্যা অথবা না একটা জবাব দিতেন। আফটার অল আমরা ছয় বছরের পুরনো পেশেন্ট, উনি পেশেন্টকে বাই নেমে চেনেন, নাম বললেই চিনতে পারতেন, কিন্তু আপনি ফোন করলেন না। এতটুকু হেল্পও করলেন না।

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ডিউটি ডাক্তারের রুম থেকে দমকা হাওয়ার মতো বেরিয়ে এলাম। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ মনে হলো, ও হো! একটা ভুল করেছি। আবার ফিরে গেলাম, এক্সকিউজ মি, প্যান্ডামিক শুরু হওয়ার পর ম্যাডাম অনলাইন কনসালটেন্সি শুরু করেছিলেন। এখনো কি করেন?
হ্যাঁ, করেন।
হটলাইন নাম্বরটা দেয়া যাবে, প্লিজ?
তিনি একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দিলেন।

কার্ড নিয়ে বিষণ্ণ মনে বাসার দিকে রওনা দিলাম। রোদের তেজ একটুও কমেনি। আকাশভরা সূর্য। কোথাও একটু মেঘ নেই। মনে মনে চাচ্ছিলাম, খুব করে বৃষ্টি হোক। এখনই। এই মুহূর্তে। আকাশ ভেঙে ঢল নামুক। আমার ভেতরের বর্ষণের সঙ্গে প্রকৃতির বর্ষণ একাকার হয়ে মিশে যাক। এমন একটা দেশ গড়ে তুলেছি আমরা যে দেশের ডাক্তাররা আজও `পেশেন্ট স্যাটিসফেকশন` শব্দটার মানে আত্মস্থ করতে পারল না। আফসোস!

রিকশা নেব কি না ভাবছি। রাস্তা অসম্ভব ফাঁকা। নির্জন। আসলে রিকশাই তো নেই! দূরে একটা রিকশা দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে। চালক বসে বসে ঝিমুচ্ছে। কী হলো এদের? কাল দেখলাম একজন রিকশাতেই ঘুমুচ্ছে।

আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রিকশাওলাদের ডেকে ডেকে পাবলো নেরুদার কবিতা শোনাই। কখনো কখনো মনে হয় চাওয়ালাদের সঙ্গে ফ্রয়েড নিয়ে আলাপ করি। মুটে মজুর ডে-লেবারদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই আমার লাঁকা ফুকো দেরিদার দর্শন কপচাতে ইচ্ছে করে। কে জানে, ওদের দর্শন হয়তো আরো উন্নত। আমরা তো কোনোদিন ওদের সঙ্গে শিল্প সাহিত্য দর্শন নিয়ে কথাই বলিনি। জানবো কী করে?

রানীক্ষেত রোগাক্রান্ত রিকশাওয়ালাকে ডেকে তুললাম, যাবেন?
তিনি চমকে উঠে বললেন, যামু না মানে? ওডেন। কই যাইবেন?
বাইরে ভীষণ রোদ আর ভেতরে ভীষণ বৃষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরলাম। চলবে