
মারুফ ইসলামের আত্মগদ্য ‘দহনদিনের লিপি’
পর্ব ৭
প্রকাশিত : এপ্রিল ২৪, ২০২১
২১ এপ্রিল ২০২১ বুধবার
এই তো সেদিন আমার দহনদিনের লিপিতে শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতার লাইন ব্যবহার করলাম—
আমার দুঃখের দিন তথাগত
আমার সুখের দিন ভাসমান
এমন বৃষ্টির দিন পথে পথে
আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।
আবার সুখের মাঠ জলভরা
আবার দুঃখের ধান ভরে যায়
এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে
আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।
আজ শুনি, কবি নেই। কোভিড কেড়ে নিল তাঁকে। আজ অব্দি যতবার আমি আকাশ ভাঙা বৃষ্টিতে হেঁটেছি ততবার মনে পড়েছে, এমন বৃষ্টির দিন পথে পথে...। এখন থেকে হয়তো আরো বেশি বেশি মনে পড়বে। শঙ্খর কবিতার মধ্যে একটা মন হু হু করা ব্যাপার আছে। একটা বিউগলের সুরের মতো করুণ কান্না আছে। বিকেলের থমকে যাওয়া রোদের মতো একাকিত্ব আছে। এই সবকিছু আমার ভালো লাগে। ভালো লাগে শঙ্খর নরোম, কোমল, পেলব ভাষা। কাশফুলের মতো স্নিগ্ধ, সুন্দর। কিন্তু স্ফটিকের মতো দৃঢ়।
মনে পড়ছে, আমার প্রথম বইয়ের শুরুর পৃষ্ঠায় ব্যবহার করেছিলাম শঙ্খর এই চার লাইন—
যে লেখে সে কিছুই বোঝে না
যে বোঝে সে কিছুই লেখে না
দুজনের দেখা হয় মাঝে মাঝে ছাদের কিনারে
ঝাঁপ দেবে কিনা ভাবে অর্থহীনতার পরপারে!
কী দারুণ বোধ! কী অসাধারণ উপলব্ধি! এর মধ্যেও একটা হু হু করে বয়ে যাওয়া মন খারাপের ইঙ্গিত আছে, না? এমনকি আমরা যখন শঙ্খর কোনো প্রতিবাদী কবিতা পড়ি তখনও এই মন হু হু করা ব্যাপারটা থেকেই যায়।
এইসব বিবিধ বিষণ্ণতাকে বুকে নিয়ে রাস্তায় নেমে দেখি, আজও বেশ কয়েকটি রিকশা চিৎ হয়ে পড়ে আছে। হয়তো এসব জায়গাতেও খানিক আগে ১২০০ টাকা জরিমানার দৃশ্য মঞ্চস্থ হয়েছে। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, একজন মধ্যবয়ষ্ক মানুষের মুখ। মানুষটা চারদিন ধরে কাজে বেরুতে পারেনি। ঘরের খাবার ফুরিয়ে গেছে। আজ তাকে বেরুতেই হবে। না হলে পেটে দানা পড়বে না। ঘরে তো তিনি একা নন। হয়তো শিশুর করুণ চাহনি আছে, অসহায় স্ত্রীর মলিন মুখ আছে, সম্মিলিত ক্ষুধার কান্না আছে।
মানুষটার পা খোঁড়া। তবু তিনি রিকশাটা নিয়ে বের হলেন। চাইলেই ভিক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি রিকশা চালানোর মতো কঠিন পরিশ্রমের কাজ বেছে নিয়েছেন।
এমন একজন মানুষকে আমরা পা ঠুকে সালাম না জানিয়ে ১২০০ টাকা জরিমানা করলাম! তার রিকশাটা উল্টে দিলাম! কি দুর্দৈব! কী নীচতা! কী হীনতা! কী অমানবিকতা! কী নিষ্ঠুরতা! এরপরও আমরা নিজেদেরকে মানুষ বলে পরিচয় দিয়েই যাচ্ছি! কী আশ্চর্য!
লোকটার কান্না এখনো আমার চোখে ভাসছে। এমন কান্নার সুরে বেতের ফলের মতোন ম্লান চোখ মনে আসে না আমার। তাঁর কান্নাভেজা মর্মভেদী উচ্চারণ এখনো আমার কানে বাজছে, আমরা রাস্তায় কাম হইরা খাই, হেইডাই তো করবার দেয় না। আবার নাকি বাড়ি গাড়ি হইরা দিবো!
আহারে! আহারে! রাষ্ট্রের যদি সত্যিই লজ্জাবোধ থাকত তবে এই মানুষটার প্রতিটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের সমস্ত কাপড়চোপড় এক এক করে খুলে পড়ে যেত। ভেজা মন নিয়ে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু কেন মানুষ হয়ে জন্মালাম, সেই লজ্জাবোধ আমার গেল না। চলবে