মারুফ ইসলামের আত্মগদ্য ‘দহনদিনের লিপি’

পর্ব ২

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৯, ২০২১

একটা মন ভালো করা দৃশ্য দিয়ে সকাল শুরু হয়েছে আজ। অফিসের গাড়ি ধরব বলে যথারীতি হেঁটে যাচ্ছিলাম আড়ংয়ের সামনে দিয়ে। সেদিন যেখানে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানে আজও থমকে দাঁড়াতে হলো। তবে সেদিনের মতো বিষাদাক্রান্ত মন নিয়ে চোখ নামাতে হয়নি আজ। দেখলাম, সেদিনের মা ও তিন শিশু দারুণ পরিপাটি হয়ে আরাম করে ঘুমুচ্ছে। আজ তারা এলোমেলো, অগোছালো, দলাপাকানো ভাঙারির মতো উচ্ছিষ্ট নয়। তাদের গায়ের উপর কাঁথার মতো কিছু একটা, মাথার উপর মশারি। হ্যাঁ, কেউ একজন মশারি দিয়ে গেছে, দেখে কী যে ভালো লাগলো! সকাল সকাল মনটা ভালো হয়ে গেল।

তবে বিকেল হতে হতে মন খারাপ হওয়া শুরু হলো। অফিস থেকে বেরুবার আগে খবরে দেখলাম, চব্বিশ ঘণ্টায় করোনায় মারা গেছে ৭৪ জন! শনাক্ত হয়েছে ছয় হাজারের বেশি। আমার দুজন ডাক্তার বন্ধু দুটি কোভিড স্পেশালাইজড হসপিটালে ডিউটি করছে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে। তারা জানালো, এই মুহূর্তে ঢাকার কোনো হাসপাতালে কোভিড বেড খালি নেই। নায়িকা কবরী নাকি আইসিইউ বেড পাচ্ছেন না এমন খবর দেখলাম প্রথম আলোতে। অবস্থা আসলে কতটা ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগোচ্ছে আমরা সম্ভবত কিছুই আঁচ করতে পারছি না।

এক কলিগ বললেন, আমরা কি ভাই ব্রাজিলকে ফলো করছি? আরেকজন বললেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ব্রাজিলের কাতারে গিয়ে দাঁড়াতে আর খুব বেশি সময় লাগবে না। এই ধরেন, মাস খানেক।
আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন ভাই? কেন এমনটা মনে হচ্ছে আপনার?
`আপনি তো ভাই লেখক মানুষ, থাকেন ভাবের জগতে, দিন দুনিয়ার খবর কিছু রাখেন?`
আবারও বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, দিন দুনিয়ার আবার কী হইছে ভাই?
`কাল থেকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সমস্ত শপিংমল, মার্কেট সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকবে, জানেন?`

ওও... আচ্ছা, বলে আমি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চুপ হয়ে গেলাম। কলিগরা দেশ, জাতি, সরকার ইত্যাদি নিয়ে বাহাসে মেতে উঠলেন। আমি চুপ করেই থাকলাম। এই দেশ নিয়ে কথা বলা আমার কাছে ভীষণ অর্থহীন মনে হয়।

আসাদ গেটে আজ প্রজাপতি বাসের জন্য দাঁড়াতে হয়নি। আমি দাঁড়ানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা বিআরটিসির দোতলা বাস এসে দাঁড়ায়। টুক করে সেটায় উঠে পড়ি। কিন্তু বাস আর নড়ে না। গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ড্রাইভার চিৎকার করে বলতে থাকে, ওই রনিইইই...। ধাক্কা দে ধাক্কা দে ব্যাটা। ধাক্কা দেওন লাগব।

যাত্রীরা বেশির ভাগই রেগে আগুন। ভুরুতে গিট ফেলে বসে থাকল। কেউ কেউ অবশ্য স্বপ্রণোদিত হয়ে নেমে গিয়ে বাস ঠেলতে লাগল। আর মুহূর্তেই স্টার্ট হয়ে গেল ইঞ্জিন। মোহাম্মদপুর নেমে আরেক দফা মন খারাপ হলো। সঙ্গে মেজাজও। কাঁচা আম দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কেজি কত?
`১০০ ট্যাকা মামা।`
`এত! একটু কম টম রাখেন।`
`আচ্ছা, ৮০ টাকা দিয়েন। কয় কেজি দিমু।`
`আরে বেশি না। অল্প। অল্প। আধা কেজি দেন আমারে।`
তিনি ওজন করে পলি ব্যাগের ভেতর তুলে দিলেন। আমি একশো টাকার নোট দিলাম, তিনি চল্লিশ টাকা ফেরত দিলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, মামা ৬০ টাকা রাখলেন যে? আধা কেজির দাম রাখবেন না?
`আধা কেজির একটু বেশি আছে মামা।`
`ও। কত বেশি?`
`ষাট গ্রামের মতো বেশি হইছে।`
ও আচ্ছা। ঠিক আছে, বলে আমি হাঁটা দিলাম। কিছুদূর আসার পর মনে মনে মনে হিসাব কষলাম, ৮০ টাকা কেজি হলে আধা কেজির দাম হওয়া কথা ৪০ টাকা। কিন্তু উনি রেখেছেন ৬০ টাকা, কারণ হিসেবে বললেন ষাট গ্রাম বেশি আছে। তার মানে, ষাট গ্রামের দাম ২০ টাকা? মানুষটা এভাবে ঠকালো আমাকে!

এরপর কিনলাম ডাব। ডাবের সাইজ অমুকের অমুকের সাইজের চাইতেও ছোট, কিন্ত দাম আশি টাকা পিস! কোনো দামাদামির সুযোগ নেই। বললাম, পানি বেশি আছে এরকম দুটো দেন, নারকেলওলা দিয়েন না।
`এই দুইডা লইয়া যান। একেবারে কচি।`
ঠিক আছে দেন, বলে বাসায় এলাম।
বাসায় এসে ডাব কাটার পর পানি বেরুলো এক চউল! ভেতরটা ভর্তি নারকেল দিয়ে।
নিজের প্রতি অশ্রদ্ধা সীমা অতিক্রম করল। এত বোকা কেন আমি? সবাই শুধু ঠকায়। একটা জীবন ঠকতে ঠকতে নিঃশেষ হয়ে গেল।
এখন একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুমাতে যাচ্ছি।

৮ এপ্রিল ২০২১