মারুফ ইসলামের আত্মগদ্য ‘ভারসাম্যহীনতার গল্প’

প্রকাশিত : মার্চ ১৯, ২০২১

ভাবছি, আজ বইমেলায় যাব। যেতে যেতে অনেক কিছু মনে পড়বে আমার। সেসব মনে পড়াকে অগ্রাহ্য করব। হয়ত চোখের জল আলপনা আঁকবে গণ্ডদেশে। তা আঁকুক। সবকিছু চাইলেও অগ্রাহ্য করা যায় না। যে রিকশাওয়ালা আমাকে টেনে নিয়ে যাবে তার সঙ্গে নিছক গল্প জুড়ে দেব।

বাড়ি কই?
অংপুর বাহে।
ঢাকায় কতদিন?
চার বচ্ছর তো হলো হয়।
হুমম। থাকেন কোথায়?
আয়ের বাজার।
পরিবারের সাথে?
নহায় নহায়। মুই একলা থাকি বাহে।
আয় রোজগার কেমন হয়?

রিকশাওয়ালার নাম মজিদ। তিনি পিছন ফিরে মুখ ঘুরিয়ে হাসবেন। কোনো উত্তর দেবেন না। দিনে কত রোজগার হয় বলবেন না। আবার রিকশা চালানো শুরু করবেন। আমি তার পিঠ দেখব। ঘামের রেখা আলপনা আঁকবে তার ভেজা শার্টে।

মজিদ মিয়া না বললেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৫ সালে বলেছে, একজন রিকশাচালকের দৈনিক আয় ৪৪৬ টাকা। মাসে ১৩ হাজার ৩৮০ টাকা। পাঁচ বছর পর তাদের আয় বেড়েছে নাকি কমেছে তা আর জানায়নি পরিসংখ্যান ব্যুরো। তবে, আমার যে বন্ধুটি দিন কয়েক আগে মেডিকেল প্রমোশন অফিসার হিসেবে চাকরিতে ঢুকল তার চেয়ে এই রিকশাচালকের আয় পাঁচ বছর আগেই এক হাজার ৩৮০ টাকা বেশি ছিল। মনে পড়বে আমার।

তারপর আমি মজিদ মিয়াকে বিদায় দিয়ে টিএসসির কোণায় নেমে এক কাপ চা খাব। তখনও হয়তো অনেক কিছু মনে পড়বে। আমি অগ্রাহ্য করে চাওয়ালা জসিমের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেব।

বেচাবিক্রি কেমন চলে?
আল্লাহ পাকের রহমত আর আপনাদের দোয়া, মামা।
দোয়া তো অনেক করি। বেচাবিক্রি ভালো হওয়ার কথা।
হেহেহে। তা হয় আর কি। ওই ধরেন দিনে হাজার বারো শ ট্যাকার বিক্রি হয়।
মাশাল্লাহ! ভালো তো। খারাপ কি? মাসে তিরিশ বত্রিশ হাজার টাকা ইনকাম করো, মিয়া। শুকরিয়া করো।

জসিম উদ্দিন লজ্জা পাওয়া নতুন বউয়ের মতো হাসবে। তখন রাস্তা দিয়ে একদল তরুণ হইহই করে হেঁটে যাবে বইমেলার দিকে। তাদের প্রত্যেকের হাতে অ্যাডমিট কার্ড। জসিম সেদিকে তাকিয়ে বলবে, আইজ নাকি বিসিএস পরীক্ষা আছিলো?
আমি বলব, হ্যাঁ।
বিসিএসের বেতন নাকি ২২ হাজার ট্যাকা, মামা?
হা হা হা! কে বলেছে তোমাকে?
আমি হুনছি।
ঠিকই শুনেছ। বাইশ হাজার টাকা স্কেল। সাথে আরও কিছু যোগ হয়। এই ধরো বাসা ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি।
কত যোগ হয় মামা?
বেশি না। সামান্য কিছু।
হের চেয়ে তো আমিই বেশি কামাই। হা হা হা!

টিএসসির চাওয়ালারাও অনেক জ্ঞান রাখে। তাদের দোকানে বসে অনেক শিক্ষিত তরুণ নিশ্চয় এসব হতাশার গল্প করে। বঞ্চনার গল্প করে। বৈষম্যের গল্প করে। ভারসাম্যহীনতার গল্প করে। সেসব শুনে শুনে জসিম অনেক কিছু জেনে গেছে।

সমাজে সত্যিই ভারসাম্যহীনতা বেড়েছে। শুধু বেড়েছে বলা ভুল হবে, প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই সমাজে যারা নিম্নবর্গের মানুষ, তাদের আয় বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু সেই তুলনায় জীবনযাত্রার মনোন্নয়ন ঘটেনি। ফলে তাদের খরচ বাড়েনি। তারা আগে যেমন বাসা ভাড়া দিয়ে থাকত, এখনও তেমন বাসাতেই থাকে, আগের মতোই খাবার খায়, রোগ ব্যধিতে খুব একটা চিকিৎসা করে না, করলেও সরকারি হাসপাতালের বাইরে যায় না। এসব কারণে তাদের খরচ আগের মতোই আছে। কিন্তু মাঝখান থেকে আয় বেড়ে গেছে অনেক।

বিপরীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে বহুগুণ। তাদের বাসা ভাড়া বেড়েছে, রেস্টুরেন্টে খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, নিত্যনতুন গেজেট কেনার বাতিক বেড়েছে, বাইরে ঘুরতে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। তাদের ছেলেমেদেরকে ভালো স্কুল কলেজে পড়াতে হয়, ভালো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাইক কিনতে হয়, ফ্ল্যাট কিনতে হয় ইত্যাদি। এত এত খরচ বাড়লেও তাদের আয় বাড়েনি। বরং কমেছে। মাস্টার্স পাশ করে ছেলেমেয়েদেরকে ঢুকতে হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরিতে। কিংবা বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে। অথচ শিক্ষার আলোবঞ্চিত জসিমের আয় ৩০ হাজার টাকা!

এসব কারণে সমাজে অশিক্ষিত শ্রেণি ও শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এই আয়বৈষম্য, এই ভারসাম্যহীনতা আখেরে দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে! আমার এই ছোট্ট শ্যামল সুন্দর দেশটাকে নিয়ে আমি আর আশাব্যাঞ্জক কিছু দেখতে পাই না।

এসব অর্থহীন ভাবনা ভাবতে ভাবতে আমার চা শেষ হয়ে আসবে। তারপর কী করব? বইমেলায় ঢুকব? আমার ইচ্ছে করবে না। আমার অনেক কিছু মনে পড়ে যাবে। আমি প্রাণপণে মনে পড়াগুলোকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করতে থাকব। আমার দুচোখ তবুও জলের নকশা আঁকবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক