মারুফ ইসলামের গল্প ‘বুড়োবুড়ি মাল্টিন্যাশনাল খিঁচুড়ি রেস্তঁরা’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১১, ২০২১

আমি বুড়ো, সে বুড়ি। আমরা বুড়োবুড়ি মিলে একটা রেস্টুরেন্ট খুলে বসলাম—‘বুড়োবুড়ি মাল্টিন্যাশনাল খিঁচুড়ি রেস্তোঁরা’। শহরের উপকণ্ঠে, বলা যায় শহর থেকে অনেকটা দূরেই আমরা দোকানটি বসালাম। আমরা চাচ্ছিলাম, জায়গাটা আমাদের বুকের মতোই নির্জন হোক। তাই শহর ছেড়ে এতটা দূরে আসা। তাছাড়া নয় বছর আগে শহরটা যত সুন্দর মনে হতো, এখন হয় না। বিষ বিষ লাগে।

ব্যবসাটাও আমাদের মূখ্য উদ্দেশ্য নয়। যদি তাই হতো, তবে শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম এলাকাতেই রেস্টুরেন্টটি দিতাম। আমরা চাচ্ছিলাম এমন একটা নিভৃত স্থান যেখানে থাকবে একটা ছায়াদায়ী বিশাল বৃক্ষ, পাখির কুজন, কুলকুল করে বয়ে যাওয়া ছোট্ট শান্ত নদী, যেন জায়গাটা দেখলেই মনে পড়ে ওমর খৈয়ামের কবিতা—এইখানে এই তরুর তলে/তোমার আমার কৌতূহলে/যেকটা দিন কাটিয়ে দিব প্রিয়ে/সঙ্গে রবে সুরার পাত্র/অল্পকিছু আহারমাত্র…।

আমাদের ইচ্ছা, এমন একটা নিভৃত নির্জন স্থানে আমরা দুজন শুধু মুখোমুখি বসে নিজেদের মতো করে দুমুঠো খেয়ে জীবনটা পার করে দেব। কস্মিনকালে যদি দু একজন কাস্টমার পাওয়া যায়, সে হবে বোনাস। জায়গা পেয়ে গেলাম। রেস্টুরেন্টও খুলে বসলাম। আমাদের খাবারের মেনু মাত্র একটাই—খিঁচুড়ি। সঙ্গে শুঁটকি ভর্তা আর ধনেপাতা ভর্তা। সেই যে আগের প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর নতুন প্রেমের শুরুর দিকে, আমাদের নিদারুণ বেকারত্বের কালে, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকার অসহ্য দিনগুলোতে, বুড়ির হাতের খিঁচুড়ি, শুঁটকি ভর্তা আর ধনেপাতা ভর্তা খেতে খেতে বলতাম—‘তোমার হাতের খিঁচুড়ি কিন্তু ভালোই, জীবনে কিছুই করতে না পারলে, একটা খিঁচুড়ির দোকান খুলে বসব, দিব্যি চলে যাবে আমাদের, কী বলো?’

সেই কথাই অবশেষে ফলে যাবে কে জানত! আশ্চর্য! জীবন বড়ই আশ্চর্য! এর চেয়েও যে বড় আশ্চর্য অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য, তা আমাদের জানা ছিল না। জানলাম খিঁচুড়ির দোকান খোলার পর। আশ্চর্য এই যে, এমন এক অতি সাধারণ খাবার জনপ্রিয় হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু হলো। কথায় বলে না, মানুষ ভাবে এক, আর ঈশ্বর ভাবেন আরেক। কিংবা শরৎচন্দ্রের ভাষায়—‘ভগবান অলক্ষে বসিয়া হাসিতেছিলেন’। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হলো। যখন রেস্টুরেন্টটি সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম তখনই সৃষ্টিকর্তা অন্যকিছু ভেবেছিলেন কিংবা অলক্ষে বসিয়া হাসিয়াছিলেন। ফলে এক মধুর বিড়ম্বনায় নিপতিত হলাম আমরা। বুড়োবুড়ির খিঁচুড়ির সুবাস সুদূর অব্দি ছড়িয়ে পড়ল। হু হু করে এর জনপপ্রিয়তা বাড়তে থাকল। প্রতিদিন দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করল খিঁচুড়ি খেতে।

আমরা বুড়োবুড়ি সারাদিন খিঁচুড়ি রান্না করি আর মানুষকে খাওয়াই। সে এক এলাহি কাণ্ড। তারপর রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কী করতে এলাম, আর কী হচ্ছে! কোথায় একটু ওমর খৈয়াম আওড়াব, বুড়ির কোলে মাথা রেখে নদীর গান শুনব, সব লাঠে উঠল! ক্রমে আমাদের খিঁচুড়ি, শুঁটকি ভর্তা আর ধনেপাতা ভর্তার জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গেল যে, এখন প্রায় প্রতিদিন রেস্টুরেন্টের সামনে হট্টগোল হয়। আমরা যতই বলি, লাইন মেইনটেইন করুন, লাইন মেইনটেইন করুন। বিশৃঙ্খলা করবেন না, সবাই পাবেন। কে শোনে কার কথা! ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি, মারামারির উপক্রম। আমরা খিঁচুড়ি সাপ্লাই দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারি না। দূর দূরান্ত থেকে ভদ্রপল্লীর ধনীকরা পর্যন্ত গাড়ি হাঁকিয়ে বুড়োবুড়ি রেস্তরাঁয় আসতে শুরু করল।

এরমধ্যে অকস্মাৎ একদিন পুলিশের গাড়ির আবির্ভাব। সিনেমার পুলিশ অফিসাররা যেভাবে স্লোমোশনে গাড়ির গেট খোলে সেভাবে গেটটা খুলে গেল। তারপর সিনেমার দৃশ্যের মতোই খোলা গেটের ফাঁক দিয়ে এক জোড়া পা নেমে এলো মাটিতে। ঝাঁ চকচকে জুতো। পুলিশ ভদ্রলোক মাটিতে পা রেখেই চোখে সানগ্লাস সেঁটে দিলেন। চুলে আঙুল চালিয়ে ব্যাকব্রাশ ভঙ্গিতে চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দিলেন। তারপর স্লো মোশনে হেঁটে এলেন আমার সামনে। আমি ক্যাশ কাউন্টারেই বসে ছিলাম।
‘আপনাকে একটু থানায় যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম পুলিশ অফিসারের দিকে। যেন তার ভাষা আমি বুঝতে পারছি না। আমাকে কেন থানায় যেতে হবে? আমার নির্বাক ও হতবিহ্বল চেহারার ভাষা হয়ত পড়তে পারলেন পুলিশ অফিসার। তিনি বললেন—‘আপনার নামে অভিযোগ আছে আমাদের কাছে। আপনি একটু থানায় চলুন’।
আমি বুড়ির দিতে তাকিয়ে বললাম, তুমি আজ একটু সামলে নাও। আমি আসছি।

২.
থানায় এসেই চেহারা উল্টে গেল পুলিশের। এক ধাক্কা দিয়ে আমাকে লকারে ঢুকিয়ে দিল। ঘরটা কেমন স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার অন্ধকার। সাপের গর্তের মতো। এই সাপের গর্তের মধ্যে কতক্ষণ থাকতে হবে, কে জানে! কেবলই মনে হচ্ছিল, চারপাশ থেকে হিসহিস আওয়াজ আসছে। আমি সুইচ খুঁজলাম বড় লাইটটা জ্বালানোর জন্য। পেলাম না।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর একজন পুলিশ অফিসার আমার সামনে এলেন। একেই সম্ভবত বলে ওসি। তিনি ঢোকামাত্র আমার মাথার উপরের আজদাহা বাল্বটা জ্বলে উঠল। কী তীব্র আলো! চোখে ধাঁধা লেগে গেল। ওসির চেহারা পরিষ্কার দেখতে পেলাম না। চোখের সামনে যেন লাল, নীল, হলুদ নানা রঙের বাল্ব উড়তে দেখলাম। বুঝলাম, চোখে ধাঁধা লেগেছে বলে এমন হচ্ছে।

‘তুই-ই তাহলে খিঁচুড়ির দোকানদার?’ (প্রথমেই তুই তোকারি। ভয় পেয়ে গেলাম)
আমি ভয়ার্ত গলায় অস্ফুট স্বরে বললাম, জি।
‘কদ্দিন হলো এই ভণ্ডামি শুরু করছস?’
আমার ভয়ের সঙ্গে এবার বিস্ময় যুক্ত হলো। যেন আকাশ থেকে পড়লাম। ভণ্ডামি! কীসের ভণ্ডামি।

আমার অবাক করা মুখের দিকে তাকিয়ে ওসি সাহেব বললেন, ‘এমনভাবে চাইয়া রইছস যেন কিছুই জানস না? ওই খানকির পোলা, তুই খিঁচুড়িপড়া বিক্রি করস না?’

আমার বিস্ময়ের মাত্রা অতিক্রম করে গেছে অনেক আগেই। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি।

ওসি সাহেব বললেন, মানুষ তেলপড়া দেয়, পানিপড়া দেয়, এগুলা শুনছি। তুই হালাই তো বিরাট ধুরন্ধর! অভিনব আইডিয়া বাইর করছস। খিঁচুড়িপড়া দিতাছস! হেইডা খাইলে নাকি বেবাকতের মনের আশা পূরণ হইতেছে। যে যেইটার নিয়ত কইরা খাইতেছে হেইডাই নাকি পূরণ হইয়া যাইতেছে?

আমি এতটাই বিস্মিত, এতটাই হতভম্ব, আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বা ধ্বণি বের হলো না।

সারাদিন পেরিয়ে গেল, কেউ আর হাজতঘরে এলো না। কেউ আমার খোঁজ নিল না। আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, কে অভিযোগ করেছে, কেন করেছে কিছুই জানতে পারলাম না। আমাকে এরা এখন কী করবে সেটাও বুঝতে পারছি না। ভীষণ অসহায় লাগছিস। বুড়ি এখন কী করছে কে জানে! আমি হাঁটুর মধ্যে মাথা গুজে স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে বসে আছি। মশার উৎপাত শুরু হয়েছে। দু’হাতে মশা তাড়ানোর চেষ্টা করছি। এরমধ্যে একজন খাকিধারী আমার সামনে এক প্লেট খাবার দিয়ে গেল।

পরদিন বুড়ি এলো থানায় খোঁজ নিতে।
‘ওকে এভাবে হাজতে ফেলে রেখেছেন কেন? কোর্টে চালান করে দেন। ও যদি অপরাধ করে থাকে আদালত শাস্তি দেবে।’

পুলিশ বুড়ির কথা কানে তুলল না। তার কোনো কথার জবাবই দিল না। প্রতিদিন বুড়ি আসতে থাকল থানায়। পুলিশের পেছনে পেছনে ঘুরতে থাকল। একজন ভয়াবহ সুন্দরী এবং আপাত যুবতী বাঙালি মেয়ে পুলিশের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ পুলিশ তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ব্যাপারটা বিস্ময়কর। একইসঙ্গে ভাবনাজাগানিয়া।

আমি ভাবতে ভাবতে হাজতঘরেই পাঁচদিন পার করে ফেললাম। শেষে ষষ্ঠ দিন দুম করে আমাকে ছেড়ে দিল। মামলা করল না, কোর্টে চালান করল না, কিছুই করল না। আশ্চর্য! জীবন বড়ই আশ্চর্য!

আমি বুড়ির হাত ধরে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে উজ্জ্বল রোদের বন্যা। আমরা রিকশা নিলাম। রোদ থেকে বাঁচতে হুড তোলা উচিত। কিন্তু আমরা প্রথম প্রেমেপড়া দিনগুলোর মতো রিকশার গুড খোলাই রাখলাম। মৃদু হাওয়া বইছে। বুড়ির খোলা চুল উড়ছে। সে ওড়না সামলাচ্ছে মাঝে মাঝেই। হাওয়া বড্ড জ্বালাচ্ছে তাকে। হাওয়া মে উড়তা যায়ে, মেরা লালা দোপাট্টা মল মল…গাইবার মতো পরিবেশ।

বুড়ি বলল, জানো একটা অদ্ভূত ঘটনা ঘটেছে।
আমি বললাম, কী ঘটনা?
‘কীভাবে কীভাবে যেন সারা দুনিয়ার মানুষ জেনে গেছে আমাদের খিঁচুড়ি খেলে মনের আশা পূরণ হয়।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী বলো এইসব? খিঁচুড়ি খেলে মনের আশা পূরণ হবে কেন?

বুড়ি বলল, সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। আমি তো খিঁচুড়ি রান্নার সময় বিশেষ দোয়া দরুদ পড়ে খিঁচুড়ি রান্না করি না। সবাই যেভাবে করে, সেভাবেই করি।
বুড়ি তারপর তার ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করল। গ্যালারিতে গিয়ে একটা ছবি দেখাল।
‘দেখ তো চিনতে পারো কি না?’

ছবিটা দেখে আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এক ধাক্কায় হার্টবিট বন্ধ হয়ে গেল। এ যে স্বর্ণা। স্বর্ণাকে কোথায় পেল বুড়ি? মাথাটা বনবন করে ঘুরতে লাগল আমার। স্বর্ণার সঙ্গে আমার সব লেনদেন চুকেবুকে গেছে সেই নয় বছর আগে। স্বর্ণাই চুকিয়েছে অবশ্য। আমার কিছু করার ছিল না। আমি গরিব, দরিদ্র, ছোটলোক। আমার দারিদ্রকে ভয় পেয়েছিল স্বর্ণা। তাই গাঁটছড়া বেঁধেছিল হাঙ্গেরি প্রবাসী এক ছেলের সঙ্গে। ছেলেটার ঢাকায় বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, আরও অনেক কিছু আছে। শুনেছি স্বর্ণা সুখেই আছে বেশ। কিন্তু বুড়ির কাছে সে কেন এসেছিল?

বুড়ি আমার কানের কাছে সজোরে ফুঁ দিয়ে সম্বিৎ ফেরাল। আমি চমকে উঠে বুড়ির দিকে তাকালাম। বুড়ি বলল, এমন ঝিম মেরে আছ কেন? চিনতে পারছ?
আমি বললাম, হুম।
বুড়ি বলল, তোমাকে যেদিন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, তার দুদিন পর এসেছিল আমাদের রেস্তরাঁয়। খুব কাতর গলায় বলল, আপনাদের খিঁচুড়ির অনেক সুনাম শুনেছি। শুনেছি, আপনাদের খিঁচুড়ি খেলে নাকি মনের আশা পূরণ হয়।
আমি কৌতুহলী হয়ে বুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী বললে তখন?

বুড়ি হাসছে। সে বলল, আমি তো তাকে দেখেই চিনতে পেরেছি। এ হচ্ছে সেইজন যার কাছে আমার বুড়োর অর্ধেক হৃদয় ঘুমিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য নিবেন? সে বলল, আমার জন্য। তারপর আমার দিকে তাকাল। তার চোখভর্তি টলটলে জল। পলক ফেললেই টপ করে ঝরে পড়বে। বলল, জানেন, নয় বছর আগে একজনকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। তাকে খুঁজছি। এই খিঁচুড়ি খেলে কী আমার মনের আশা পূরণ হবে?

আমি মাথা নিচু করে চুপ করে আছি। রিকশা ছুটছে প্রবল বেগে। বুড়ি বলে চলেছে, বুঝলাম, তুমিই যে সেই খিঁচুড়িওয়ালা সেটা সে জানে না। তার হাতে খিঁচুড়ির প্যাকেট তুলে দিয়ে বললাম, খেয়ে দেখুন, আপনার মনের আশা পূরণ হতেও পারে। সব ওপরওয়ালার ইচ্ছা। আমরা তো উছিলামাত্র!

দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলাম।