মারুফ ইসলামের চিলতে গদ্য ‘বিদায় খান সাহেব’

প্রকাশিত : মে ০২, ২০২০

আজ তাহলে ইরফান খানকে নিয়ে আলোচনা করা যাক। ইরফানকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে কি? মনে হয় না। আমার বিশ্বাস, আপনারা সবাই তাকে চেনেন। আর যারা এখনও চেনেন না, তাদের নতুন করে আর চেনার প্রয়োজন নেই। ইরফান খানকে না চিনলে জীবনের খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।

তো এই যে ইরফান খান, লম্বা, ঢ্যাঙা, আটপৌরে, অতি সাধারণ, ছাপোষা, মধ্যবিত্ত, সরল চেহারার এক মানুষ; যাকে দেখলেই আপন আপন মনে হয়, কাছের মানুষ মনে হয়, পাশের মানুষ হয়, প্রতিবেশি মনে হয়, বন্ধু মনে হয়, বড় ভাই মনে হয়— সেই ইরফান ২৯ এপ্রিল মুম্বাইয়ের এক হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর সারা দুনিয়ায় শোরগোল পড়ে গেল, সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে যেতে থাকল ইরফানের ছবি আর ভিডিও ক্লিপের বন্যায়, তা কি শুধু তিনি সেলিব্রেটি ছিলেন বলেই?

সেলিব্রেটি তো অনেকেই থাকেন। সবার মৃত্যুতে কী এমন শোকের চাদরে মুড়ে যায় চারপাশ? রোনাজারি শোনা যায় ফেসবুকের নীল দুনিয়ায়? আমরা সেলিব্রেটি দেখি সাধারণত দুই ধরনের। এক ধরনের সেলিব্রেটি দেখবেন, তারা ততক্ষণই আলোচনায় থাকেন যতক্ষণ তারা পারফর্ম করতে থাকেন। পারফরমেন্স শেষ, পাবলিকের আলোচনাও শেষ। উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলা সাহিত্যে প্রণব ভট্ট নামে একজন লেখক ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদের সমসাময়িক। যতদিন লিখেছেন ততদিন ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। যখনই তার লেখালেখি বন্ধ হলো, মানে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন, প্রায় সাথে সাথেই তাকে নিয়ে আলোচনাও বন্ধ হলো। তিনি হারিয়ে গেলেন বিস্মৃতির অতলে।

এ গেল প্রথম শ্রেণির সেলিব্রেটিদের কথা। এবার দ্বিতীয় শ্রেণির সেলিব্রেটিদের কথা বলি। এরা পারফর্ম না করলেও মানুষের আলোচনা থেকে হারান না। মানুষের মন থেকে বিস্মৃত হন না। এটা হয় সাধারণত ইমপ্যাক্টের কারণে। আপনি আপনার কাজের মাধ্যমে যদি সোসাইটিতে ইমপ্যাক্ট ক্রিয়েট করতে পারেন, তবে সোসাইটির মানুষ আপনাকে আলোচনায় রাখবেই। ইরফান খান ছিলেন এই দ্বিতীয় ঘরনার সেলিব্রেটি। তিনি তার অভিনয় দিয়ে মানুষের মনে ইমপ্যাক্ট ফেলতে পেরেছিলেন বলেই গত কয়েক বছর কার্যত কোনো ধরনের অভিনয় না করেই, কোনো ধরনের পারফর্ম না করেও তিনি ছিলেন মানুষের আলোচনায়। মানুষ তাকে ভোলেনি।

উদাহরণ খুঁজতে গেলে এরকম আরো অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। আমাদের আসাদুজ্জামান নূরের কথাই ধরুন। ভদ্রলোক বিগত পনের-বিশ বছর ধরে রাজনীতির মঞ্চে পারফর্ম করছেন। এমপি হয়েছেন। মন্ত্রীও ছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু তারপরও মানুষ তাকে রাজনীতিবিদ হিসেবে মনে রাখেনি, মনে রেখেছে একজন অভিনেতা হিসেবে, একজন বাকের ভাই হিসেবে। কারণটা খুবই সহজ। তিনি অভিনয় দিয়েই মানুষের মনে ইমপ্যাক্ট ফেলতে পেরেছেন, রাজনীতি দিয়ে নয়।

ইরফানের কথায় ফিরে আসি আবার। গতকাল নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ এনডিটিভির ওয়েবসাইটে যখন দেখলাম ইরফান খানের মৃত্যুর খবর, তখন এক ঝটকায় আমার স্মৃতি আমাকে ফেলে দিল বারো তের বছর আগের এক দিনে। দিনটা কী বার ছিল মনে নেই। রাত্রিবেলা। মেসে তখন আমরা প্রায়ই রাত জেগে মুভি দেখতাম। মনে পড়ছে সে রাতে আমার বন্ধু রানা ছিল। আরও কেউ কেউ ছিল হয়ত, নাম মনে পড়ছে না। আমরা সবাই মিলে একটা মুভি দেখছিলাম। মুভির একটা দৃশ্য এখনো আমার চোখে লেগে আছে। একজন যুবক কোনো এক নাইট ক্লাবে ঢুকে দেখে, সেখানে ব্যাপক নাচ গান চলছে। স্বল্পবসনা নারীরা উদ্দাম ভঙ্গিতে নাচছে। ওই যুবক দেখতে পায়, নৃত্যরত এক নারীর, যাকে এখন সবাই বলে আইটেম গার্ল, তার উন্মুক্ত বাহুতে, ঊরুতে আর নাভির কাছে লেগে আছে একটা বিচ্ছু। যুবক ভাবল, সর্বনাশ! এখনই তো বিচ্ছুটা কামড় দিবে মেয়েটাকে। নাচের তালে এমনই উন্মাদ হয়ে গেছে মেয়েটা যে তার শরীরে বিচ্ছু উঠেছে, সেটা সে টেরই পাচ্ছে না?

যুবক এবার তড়িঘড়ি করে নাচের মঞ্চে উঠে যায় এবং নৃত্যরত ওই নারীর কোমর জাপটে ধরে তার নাভীর কাছ থেকে বিচ্ছুটাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করে। যুবক আসলে বুঝতেই পারেনি যে, ওটা সত্যিকারের বিচ্ছু নয়, ওটা একটা ট্যাটু মাত্র। আইটেম গার্লরা সহসাই তাদের শরীরে এসব ট্যাটু এঁকে থাকে। এরপর যা হবার তাই হয়। ক্লাব সংশ্লিষ্ট লোকজন এসে ততক্ষণাৎ যুবকটিকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্লাবের বাইরের রাস্তায় ফেলে দেয়। যুবকটি তখন রাস্তা থেকে উঠে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বিপুল বিস্ময়ভরা চোখ মেলে তাকিয়ে ওই ক্লাবের সমবেত সকলের উদ্দেশে বলে— পাগল হ্যায়!

অর্থাৎ তারা সকলেই পাগল নাকি রে ভাই? সে তো গিয়েছিল মেয়েটার উপকার করতে, তাকে বিচ্ছুর কামড়ের হাত থেকে বাঁচাতে। আর তাকেই কিনা পাগল উন্মাদ বলে ফেলে দিল রাস্তায়? ওই যুবকটি ছিলেন ইরফান। সিনেমার নাম ক্রেজি ফোর। এভাবেই আমার প্রথম পরিচয় ইরফানের সঙ্গে। সেই যে তার সরল মুগ্ধকর বিস্ময়ভরা চাহনি, ডায়ালগ থ্রোয়িং, ইমপ্রেশন তা আজও চোখে লেগে আছে। তাই তার মৃত্যুর খবর দেখামাত্র আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওই দৃশ্য। একেই বলে ইমপ্যাক্ট।

ক্রেজি ফোর এমন কোনো উল্লেখযোগ্য সিনেমা নয়। ইরফানের এরপর মনে রাখার মতো আরও অনেক সিনেমা দেখা হয়েছে— যেমন লাঞ্চ বক্স, মকবুল, পিকু, লাইফ ইন আ মেট্রো ইত্যাদি। সবটাতেই অনবদ্য। ইমপ্যাক্টফুল। ইরফানকে আমার বরাবরই মনে হয় আটপৌরে রোদের মতো একটা কিছু। বিশেষত্বহীন, কিন্তু উজ্জ্বলতায় প্রখর। আমাদের যে দেখনদারি জীবন, সেই জীবনে তিনি ছিলেন ভনিতাহীন আরাম।

সবশেষে বলি, ইরফানের সবচেয়ে শক্তির জায়গা ছিল তার চোখ। শুধু চোখের অভিব্যাক্তি দিয়ে দু-তিন ঘণ্টা দর্শককে বশে রাখার এক দানবীয় ক্ষমতা ছিল তার। আপনার পারলৌকিক জীবন শান্তির হোক। বিদায় খান সাহেব!