মারুফ ইসলামের চিলতে গল্প ‘ইচ্ছা-অনিচ্ছার কিস্সা’
প্রকাশিত : জুন ২৩, ২০২০
রাত। রান্না শেষ করে খেয়েদেয়ে মশারি টাঙাচ্ছি শোব বলে। হঠাৎ দরজায় শব্দ— ঠক ঠক! আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। এগারোটা বেজে ৩৫ মিনিট পেরিয়ে আরও খানিকটা সামনে এগিয়েছে মিনিটের কাঁটা। এত রাতে আবার কাহার আগমন?
দরজা খোলার পর আমার অবস্থা হলো শীতের দিনের ঝরা পাতার মতো। বনবন করে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ যেমন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তেমন আর কি। দেখি, মুখে মাস্ক চোখে চশমা হাতে দস্তানা—পুরো শরীর রেইকোর্টে মোড়ানো এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে উঁচু মগডাল থেকে যেন ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। মুখের মাস্ক খোলার পর চিনতে পারলাম—আঞ্জু আপা! আপা বললেন, গর্ধবকূল শিরোমনির মতো হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? ঘরে যেতে দে।
আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। আপা ভেতরে ঢুকে সোজা স্নানঘরে অন্তরীন হলেন। আমার বিস্ময় কাটে না। লকডাউনের ভেতর এত রাতে আপা এলেন কী করে? পুলিশ টুলিশ ধরল না? আবার আমার বাসার সদর দরজা পেরিয়ে একেবারে দোতলায় আমার ঘরের সামনে চলে এলেন, দারোয়ান কিছুই বলল না? সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে এলেন আপা? আপাকে আমার মাঝেমধ্যে জিনপরি বলে মনে হয়। আপার পক্ষে সবই সম্ভব।
মিনিট কুড়ি পর আপা বের হলেন স্নানঘর থেকে।
এত রাতে কী মনে করে আপা? কোনো সমস্যা হয়নি তো? জিজ্ঞেস করলাম।
আমার কোনো সমন্যা নাই। সমস্যা তো তোর।
বলো কি! আমার আবার কী সমস্যা?
সপ্তাহ দুয়েক হলো আমি ফেসবুকে ঢুকি না। একটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি। এরমধ্যে একজন ফোন করে বলল, আপনার ভাই তো মারা যাচ্ছে। আমি বললাম, মারা যাচ্ছে মানে? সে বলল, আপনি ফেসবুক দেখেন না? আপনার ভাই তো সুইসাইড করার অ্যাটেম নিচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি ফেসবুকে ঢুকলাম। তোর টাইমলাইনে গিয়ে দেখলাম, ঘটনা সত্য। তাই তখনই বাসা থেকে বের হয়ে চলে এলাম। তো, এসবের মানে কী?
আমি বললাম, কোনো মানে নাই।
বলি, এসবের মানেটা কী? হুংকার দিয়ে উঠলেন আপা।
আমি মৃদুস্বরে বললাম, দেখ আপা, জীবনটা আমার। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে দাও।
সোফায় বসলেন আপা। ভেজা চুলে তোয়ালা পেঁচাতে পেঁচাতে বললেন, দুই কলম লেখাপড়া শিখে নিজেকে বিরাট পণ্ডিত ভাবতে শিখেছিস। যেটাকে নিজের জীবন বলে ভাবছিস সেটা তোর জীবন হয় কেমনে রে মুর্খ? তুই কী এই জীবন চেয়ে নিয়েছিলি? নাকি দুনিয়ায় পাঠানোর আগে তোকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল? হয়নি তো। আব্বা আম্মা ইচ্ছা পোষণ করেছে তোকে পৃথিবীতে আনার, আর সৃষ্টিকর্তা জীবন দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। এই তো। এখানে তোর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো মূল্য আছে? কেউ তোর কাছে জানতে চেয়েছিল তুই পৃথিবীতে আসতে চাস কি না? কেউ জানতে চায়নি। না আব্বা আম্মা, না আল্লাহ। কাজেই নিজের ইচ্ছাতে যেহেতু জীবনটা পাসনি, নিজের ইচ্ছাতে শেষও করতে পারিস না। এই অধিকার তোর নেই।
ভয়ংকর ভয়ংকর যুক্তি দিচ্ছেন আপা। এখন তার বিপক্ষে পাল্টা যুক্তি দিলেই এই বাসা কুরুক্ষেত্রে পরিণত হবে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম মাথা নিচু করে।
আপা আবার শুরু করলেন। দুনিয়ার কোনো কিছুই আমাদের নিজের না, বুঝলি? এই যে আমরা যে বাড়িতে বড় হয়েছি ওই বাড়ির ভিটে তো ছিল দাদার। দাদার কাছ থেকে পেয়েছে আব্বা। আব্বার কাছ থেকে পাব আমরা। আমাদের কাছ থেকে আবার পাবে পরের প্রজন্ম। এভাবেই হয়ে আসছে। আমাদের গ্রামের কথাই ভাব। একদল মানুষ এই গ্রামে বসবাস করে। তারপর তারা মরে যায়। আবার আরেক দল বসবাস করে। তারাও মরে যায়। শুরু হয় আরেক দলের বসবাস। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস চলতে থাকে। কাজেই এই পৃথিবীর আলো, বাতাস, বৃক্ষ, নদী, পাহাড়, জমিজমা, ঘরবাড়ি, শয়সম্পত্তি কোনোকিছুই আমাদের নয়। আমরা এর ব্যবহারকারীমাত্র। আমাদের আগেও মানুষ ব্যবহার করে গেছে, আমাদের পরেও করবে। আজ থেকে নিজের বলে কোনো কিছু দাবি করবি না। মনে থাকবে?
জি আপা, থাকবে। মিনমিন করে বললাম।
আপা বললেন, খিদা লাগছে। ভাত-টাত কিছু আছে?
আমি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
























