মাশরাফির মাস্তানি, ব্যারিস্টার সুমনের পাগলামি চলুক

শামীমা জামান

প্রকাশিত : মে ০১, ২০১৯

ছোট্ট একটা ভিডিও। জনপ্রতিনিধি মাশরাফি কর্তব্যে অনুপস্থিত চিকিৎসককে জবাবদিহি করছেন। দেখে সাবাশ ফাটা কেস্ট ফিলিং হলেও ‘‘ফাইজলামি করেন?’ শব্দগুলো কানে লাগলো। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা চিকিৎসক ভদ্রলোক বয়স্ক নন তো? আচ্ছা, বয়স্ক লোকেরা অন্যায় করলে কমবয়সীরা সেটা ধরিয়ে দিলে বেয়াদবি হয় কেন? অন্যায় তো অন্যায়ই। সেটা চিকিৎসকই করুক আর বয়স্ক লোকই করুক। একজন দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক বিনা নোটিশে চারদিন অনুপস্থিত থাকবেন সেটা ব্যাপার না কিন্তু একজন সাংসদ হয়ে মাশরাফির কেন এত বেয়াদব হতে হবে? কেন তিনি সেটা নিয়ে চিকিৎসক মহোদয়কে যা তা বলবেন? তাও আবার ভিডিও করে ভাইরাল করবেন? কথা হচ্ছে, মাশরাফি যা তা বলেননি। নড়াইলের আঞ্চলিক টানে ’ফাইজলামি করেন? আপনাকে এখন কি করব?’ এই কথাগুলো উক্ত চিকিৎসকের অপরাধ অনুযায়ী তেমন কোনো খারাপ কথা নয়। এর চেয়েও কঠিন কথা শুদ্ধ ভাষায় কিম্বা ইংরেজিতে কোনো জনপ্রতিনিধি তার অধিনস্তকে বলেননি, এমন নয়। মাশরাফি নিজস্ব ভঙ্গিতে বলায় আপনাদের খুব কানে লাগছে। তাকে অশিক্ষিত এইট পাশ বলে গালি দিতে আপনাদের মুখে আটকালো না। বাহ! একজন জাতীয় ক্রিকেট দলের কাণ্ডারি হয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনতে হবে তাকে আবার পিএইচডি করে আপনাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণও দিতে হবে। নয়তো আপনারা সুযোগ পেলেই শিক্ষার বাপ মা তুলে তাকে হেয় করতে পিছপা হবেন না। মাননীয় শিক্ষিতরা ভুলে যান কেন আপনারা শিক্ষিত হন অশিক্ষিত রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে পড়ে পড়ে। আপনারা বিনোদিত হন এইট পাশ জেমসের কনসার্টে নেচে। আর ভিডিও করা বা ভাইরাল করার ব্যাপারে যে মাশরাফির নিজের কোনো হাত নেই সেটা মানুষ মাশরাফিকে না চিনলে কারো বোঝার কথা নয়। মাশরাফির মতো বড় তারকা অফিসিয়ালি আনঅফিসিয়ালি হাঁচি কাঁশি দিলেও সেগুলো ভিডিও হয়, ভাইরাল হয়।

আমাদের দেশের চিকিৎসা খাতকে ঢেলে সাজাতে কোনো এক্টিভিজমে কস্মিনকালেও কোনো চিকিৎসকদের ঐক্য জাতি দেখেনি। কিন্তু ব্যক্তি চিকিৎসক স্বার্থে আঘাত লাগে বা উনাদের ছুঁয়ে কোনো কথা বা কাণ্ড ঘটলে ফেসবুকের চিকিৎসক সমাজ ঢাল তলোয়ার নিয়ে পাগলা সেফুদা হয়ে যান। সেরকমই এক মহিলা ডাক্তার সাহেবান সাবেক আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুল জলিলের কন্যা। তিনি মাশরাফিকে ‘কুত্তার বাচ্চা’ সম্বোধন করে তার মহান বিবৃতি প্রদান করেছেন। এই সামান্য একটা ব্যাপারকে বাংলার তাবৎ ডাক্তার সাহেবগণ জাতীয় ইস্যু বানিয়ে মাশরাফিকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে জনসম্মুখে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছেন। মাশরাফি যদিও উক্ত চিকিৎসকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন তার স্বভাবগত মানবিক মন থেকে। কথা হচ্ছে মাশরাফি কেন চিকিৎসক সমাজের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবেন?

মাশরাফি কি রোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিল থেকে দালালি খান? মাশরাফি কি মাত্র পাঁচ মিনিট ব্যয় করে এক হাজার টাকা উপার্জন করেন? মাশরাফি কি লাশের উপর ভেন্টিলেশন দিয়ে মৃতকে জীবিত বলে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করেন? মাশরাফি কি টাকা খেয়ে কোনো বিশেষ কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন? টাকার লোভে মাশরাফি অহেতুক সিজার, অতিরিক্ত ওষুধ লেখেন? মাশরাফি কি রোগিনীর শ্বাস প্রশ্বাস পরীক্ষা করতে গিয়ে বিশেষ বিশেষ স্থানে হাত চালিয়ে নিজের শ্বাস প্রশ্বাস ঘন করে ফেলেন?

এগুলো খুব ছোট কিছু উদাহরণ। কাহানি হাসপাতাল কি লেখতে গেলে ‘কসাইনামা’ উপন্যাস এক হাজার পৃষ্ঠা হয়ে যাবে। চিকিৎসা পেশা খুব কষ্টের, নিঃসন্দেহে মহৎ পেশা। পাশ্চাত্যে চিকিৎসকদের অত্যন্ত মহৎ ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়, এত বিরক্তিকর কাজটি তারা করেন বলেই সমাজে তাদের অবস্থান সম্মান ও প্রাচুর্যের ইন্স্যুরেন্সের আওতায় থাকা চিকিৎসা সেবাটিও তারা এতটাই আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করেন যে, টেক কেয়ারের যন্ত্রণায় রোগীরই অতিষ্ট হবার দশা। এটা কেউ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসকদের বেলায় কি এ কথা খাটে?

প্রতিটি মানুষেরই রয়েছে নিজ নিজ ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতা। ডাক্তারদের (সবাই নন) গাফিলতি, আম রোগীর ক্ষেত্রে দুর্ব্যবহার, হাই প্রফাইল রেফারেন্সের ক্ষেত্রে ভাল ব্যবহার ইত্যাদি নানাবিধ ভোগান্তি যা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। তো ফেসবুকের তেড়ে আসা চিকিৎসকরা সর্বদা আত্ম অহংকারে ভোগেন এই ভেবে তারা যেহেতু মহৎ পেশার মানুষ তাই তাদের ছুঁয়ে কথা বলা যাবে না। বস্তুত এ ঘটনায় নিজেদের ফাঁকিবাজি চরিত্রটি তারা উন্মোচন করে দিলেন। কি সুন্দর ভয় দেখাতে পারেন তারা ধর্মঘট এর হুমকি দিয়ে।

তারা কি ভুলে গেছেন ১৯৯৪ সালের সেই যুগান্তকারী হাইকোর্টের রায়ের কথা? ১৯৯৪ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা। খুব তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু ব্যক্তিস্বার্থ  উদ্ধারের জন্য দেশের সব চিকিৎসক একযোগে ধর্মঘট শুরু করেছিলেন। হাসপাতালগুলোতে শুরু হয়েছিল নারকীয় পরিস্থিতি। শত শত রোগী মারা গিয়েছিল বিনা চিকিৎসায়। চিকিৎসকেরা সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সেইসব ভাগ্যহত মানুষকে জিম্মি করে তাদের সুবিধা উদ্ধারের ঘৃণ্যতম পথ বেছে নিয়েছিল। সেই সময় ড. মোহিউদ্দিন ফারুক (আমাদের মেজ ভাইয়া) অসহায় মানুষগুলোর মর্মান্তিক অবস্থার কথা ভেবে সর্বাত্মক চিকিৎসক ধর্মঘট চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। এ ধরনের ধর্মঘটকে অবৈধ বলে দাবি করেছিলেন। হাইকোর্ট থেকে জনসার্থে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্তভাবে চিকিৎসকদের অবৈধ ধর্মঘট প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সেদিন।

হাইকোর্টের সেই নির্দেশের পর এ দেশের চিকিৎসকেরা আর কখনো এমন ঘৃণ্য পথে পা বাড়াতে সাহস করেনি। ডাক্তার নন অথচ ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো ছালে ছুতায় মাশরাফির পিছে লাগা প্রাণীগুলো, মাশরাফি কি আলহাজ ইয়াবা বদি? না সাতখুন মামলার আসামি? না দশ ট্রাক অস্ত্রকাণ্ডের নায়ক? কই, এইসব সাংঘাতিক মানুষগুলো যারা ইয়াবা দিয়ে একটা প্রজন্মকে শেষ করে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তো এমন জনমত গড়ে তোলেন না আপনারা। তোপের মুখে ফেলেন সত্যিকারেই সমাজ বদলাতে আসা মাশরাফিকে। দল মেলে না বলে গালি দেন ব্যারিস্টার সুমনের মতো সহজ সরল সমাজ সেবকদের। অথচ এই দুজন মানুষের মতো সবগুলো মানুষ হলে দেশ বদলে যেত।

মাশরাফি, ব্যারিস্টার সুমন অসুস্থ বাংলাদেশের প্রতিষেধক টীকা। এদের সূঁচের ব্যথা সহ্য না হলে বাংলাদেশ সুস্থ হবে না। তাই মাশরাফির মাস্তানি, ব্যারিস্টার সুমনের পাগলামি চলুক।