মাসুদ খানের ৭ কবিতা

প্রকাশিত : জুলাই ০১, ২০২০

উপমান

তোমার মুখের ওপর ঝেঁপে নেমে আসছে বেসামাল কেশদাম, খেয়ালি হাওয়ায়।
তারই ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে এক লালচে নির্জন দুষ্টব্রণ, গণ্ডদেশে তোমার—
যেন পুঞ্জাক্ষ আনারসের ঝোপে ছোট্ট এক রূপদক্ষ গিরগিটি...

অতিদূর অতীত থেকে ভেসে আসে দূরগামী তূর্ণ ট্রেনের সিটি।

মিসিং লিংক

কালোবাজারের মর্মস্থলে বসে এতকাল
চালান করেছ দারুচিনি, ভাবাবেগ... সীমান্তের এপার-ওপার।
আজ দেখি আনাগোনা
না-কালো না-শাদা এই হৃদগন্ধা ধূসরবাজারে!

এই তো এখন চারপাশ থেকে
কানে ভেসে আসছে বকুলের গন্ধধ্বনি
নাকের ঝিল্লিতে ঝাপসা ধাক্কা খাচ্ছে
ব্রতবদ্ধ ব্যস্ত মৌমাছির বিবিধ গুঞ্জনগন্ধ।
আর কিছুক্ষণ পরে ঝোপের আড়াল থেকে
ঢুলুঢুলু চোখে তাকাবে বহুচক্ষু আনারস
তার চূড়ায় চড়ে-বসা এক মাথাগরম গিরগিটি
চেরা জিভ বাড়িয়ে দিয়ে মাপতে থাকবে
টিপটিপ রোদের সুর, ছন্নমতি উদাসী হাওয়ার গতি।
রূপসী আকন্দ ফুল, অভিনয়পটু, সখিদল নিয়ে ছিনালি-আনন্দে
মান ভাঙাবে তিরিক্ষিমেজাজ কিছু বিছুটিপাতার।

এইবার মেলাও তো দেখি হে গুনিন
ওপরের দুই স্তবকের মধ্যকার মিসিং লিংক?

স্বভাব

শ্রেয়তে বিরাগ যথারীতি,
অনুরাগ হেয়তে আমার।
অব্যাপারে আগ্রহ অধিক, যথাব্যাপারে সন্ন্যাস।
অকাজে উদ্ব্যস্ত।

বারবার আড়াল হয়ে দাঁড়ায় এক বেঢপ পাহাড়।
পাহাড় ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে তাই
হেলান দিয়ে রেখেছি দিকচক্রবালে,
গোল হয়ে নেমে আসা আকাশের গায়ে।

এদিকে তারার ভস্মে ভরে যায় খটখটে গিরিপথ।

তদন্ত

কী ঘটেছে ওইখানে, ওই ছায়াপথে,
রাতের আকাশে ফুটে-ওঠা
ওই চেরি-ব্লসমের পুষ্পসমাবেশে?

যেন এক মহাজাগতিক অপরাধপট,
তদন্ত চলছে, নেমে পড়ছে বাঘা-বাঘা সব
জ্যোতির্গোয়েন্দা ও মহাকাশীয় পুলিশ
অকুস্থলে খোঁজা হচ্ছে ক্লু, মোটিভ, সাক্ষী ও সাবুদ,
কিংবা অ্যালিবাই...

ওই যে ওখানে একটি তারা ছিল,
লাপাত্তা হঠাৎ। মেরে ফেলেছে কি কেউ?
কোথায়ই-বা লুকালো সে-ডেডবডি?

হঠাৎ হাউৎ করে ডুকরে ওঠা, গায়ে-হিম-ধরানো কসমিক কান্না...

আর কারাই-বা, কোন ধীর বিষপ্রক্রিয়ায়,
আস্তে-আস্তে হনন করছে প্রিয় এই গ্যালাক্সিকে!

দীর্ঘ তদন্তের পর জানা গেল—
ওই যে আবর্তমান তারা-ফোটা মহাজাগতিক চাকতি,
কল্পনাকে ক্লান্ত-করে-ফেলা ওই মহাকায় যমজাঙাল,
মর্মদেশে বসে আছে তার
সে-এক ভাবগম্ভীর, রাশভারী, ঘনীভূত কালামামা।

এইসব নাকি তারই কাজ।

রসায়ন

কুমির যা-কিছু খায়, সেসবও কি পরিণত হয় কুমিরে?
—জালালউদ্দিন রুমি

মন-মেদুর-করা সুর তুলত এক রাখাল।
বাঘে খেয়েছিল তাকে, বহুদিন আগে।
দিনে-দিনে সেই বাঘ কেমন উদাস, আনমনা, অহিংসপ্রায়
গোলপাতার আড়ালে আড়ালে...

দুর্ধর্ষ এক দস্যু— লুটেরা, নৃশংস, খুনি ও ধর্ষক।
খেয়েছিল তাকে এক বাচ্চা বাঘে, বহুকাল আগে।
বড় হয়ে সেই বাঘ এখন বনের সবচেয়ে আগ্রাসী, সবচেয়ে হিংস্র শিকারি।

তারপর একদিন
উড়ন্তপ্রায় হরিণের হলকুম কামড়ে ধরার ঠিক তুঙ্গ মুহূর্তে
দপ করে নিভে যাবে দাউদাউ নৃশংস হৃদয়,
শূন্যের মধ্যেই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে-ওঠা উন্মত্ত বাঘের।

জাদু

কে যে কার আগে চলে যাব
তুমিও জানো না, আমিও তো তা-ই।

যদি আমি আগে যাই, থাকবে না কোত্থাও কোনো অনুতাপ
আমার তো আজন্ম স্বভাব, শখ, ছড়িয়ে পড়ার!
কণা-অনুকণা হয়ে ছড়িয়ে যাব ধীরে ধীরে
মনোরম জলবায়ু হয়ে ঘিরে থাকব তোমাকে।

আর যদি তুমি আগে যাও,
প্রকৃতিশাস্ত্রের সব বিধি ব্যর্থ করে দিয়ে
তোমার বেরিয়ে যাওয়া অভিমানী প্রাণবায়ু স্নিগ্ধ পরমায়ু
মুহূর্তের মধ্যে আমি ফিরিয়ে আনব
ঠিকঠিক তনুতে তোমার।

আমি জন্ম-জন্মান্তর সাধনায়
আয়ত্ত করেছি এই প্রাণ-ফেরানোর জাদু, করণকৌশল।

পরমা কথা বলে ওঠে প্রকৃতির ভাষায়

তোমাকেই নিগড়িত করবার সমস্ত কৌশল
ভানুমতি ভোজবাজি সব রপ্ত করেছে মানুষ।
আর মেয়ে, নিগড়কে তুমিও নূপুর ভেবে
মাঝে মাঝে পরে ফেলছ পায়ে।

বলো মেয়ে, মন খুলে আজ বলে যাও সব,
চুপচাপ শুনে যাব, প্রতিবাক্য করব না কোনো।
আমি কথা বলব মুদ্রণপ্রমাদে-ভরা খরখরে গদ্য-জবানে
প্রত্যুত্তরে তুমি বলে যাবে অনর্গল
বরফ-গলানো এক পরিস্রুত প্রকৃতি-ভাষায়,
সরলসার, সুললিত চারুপদ্যে—

‘নারীরূপে আসতে যদি ভবে
বুঝতে তুমি দুঃখজ্বালা তবে।
পেতে যদি ভূমিকা নারীর,
বুঝতে কী দায় কাঁধে প্রকৃতির!

বলতে পারো কোথায় তোমার থেকে
পিছিয়ে ছিলাম কখন এবং কবে?
হাজার বছর ধরে
জঞ্জাল সাফ করে
গড়েছি এই মানবসমাজ তবে।

দিনে দিনে করেছ তা জটাজটিল কাঁটাবহুল
আগাছা-সংকুল।
তাই তো দিতে হচ্ছে এখন নিত্যনতুন ভুলের মাশুল
আরো অধিক ভুল।

উজিয়ে এলাম হাজার বাধা, হাজার দমন দলন
আবার বাধা, আবার দমন, আবার পদস্খলন
এমন করেই এগিয়ে গেছি, আজও আগুয়ান
ধারণ-সহন-প্রাণশক্তি প্রকৃতির সমান।
প্রকৃতি যা, এক অর্থে পরমা-ও তো তা-ই
বিভেদ ছেড়ে এই আমরাই অভেদটা শেখাই।

প্রাণকে ফোটাই। স্তন্য দিয়ে, অন্ন দিয়ে করি বিকশিত
তাপ ছায়া আর মায়া মেখে, জীবন ঘষে করি উজ্জীবিত।
একাধারে প্রজায়িনী, প্রাণপালিনী, এবং প্রশিক্ষক
অন্নদা ও স্তন্যদায়ী, প্রাণশক্তি-আয়ুর উদ্বোধক।
স্নেহশাসন, প্রীতিবাঁধন, পালনপোষণ... সবই অবিরত
সাধন করি। সর্বোপরি পালন করি ব্যবস্থাপন-ব্রত।

পরমাকুল আমর্মমূল নিজেই তো প্রকৃতি।
প্রকৃতিকেই শেখাচ্ছ আজ স্বভাব, সংস্কৃতি?
দায়িত্বজ্ঞান, রীতিনীতি, প্রেম, প্রজ্ঞা, প্রীতি?

কালে কালে ঘোর সংকট ঘুরে-ফিরে আসে
আজ ফের সেই দুঃসংকেত ভঙ্গুর সমাজে।
মর্দানি-ভাব দমিয়ে রেখে জাগাও নারীভাব
ভেতর-বাহির বোধন ঘটাও প্রকৃতি-স্বভাব।
জেনে রেখো, চিড়-ধরা এই সমাজ-সারাই কাজে
হন্যে হয়ে ফিরবে শেষে নারীভাবের কাছে।’

এ-নিস্তারহীন ক্রূর কাঠ-ফাটা কঠোর রোদ্দুরে
এক মহাচ্ছায় গাছের গোড়ায় ঠেস দিয়ে
কিছুটা থতোমতো খেয়ে, হতভম্ব হয়ে
চুপচাপ অনুভব করে যাব প্রকৃতির এই কণ্ঠস্বর, এই পরিস্রুত ভাষার আগুন।