মাসুদ পথিক

মাসুদ পথিক

মাসুদ পথিকের কবিতাগুচ্ছ

প্রকাশিত : জুন ২৪, ২০২০

আর শস্যের ভেতর ক্রিয়া অ ও অব্যয়

আর, এমন গ্রামদেশে, রাত্রি জেগে ঘুমায় হালিক
আমার প্রিয় পালক পড়ে আছে চাষের জমিনে
বাবা ও পুত্র মিলে করেছি চাষ
ক্রিয়া ও অব্যয়ের

মাঠে পণ্ডিত মশাই ঘোরে, ব্যাকরণ বই হাতে
আমার সংসারে চাল নুন আর হাভাতে
পূর্বসূত্র জমিনে বাবা চালান লাঙল
আমি টানি মই

মা, মা আমার কই? এই বাক্যের পিছন
পিছনে ছুটে চলে সামাজ ও ব্যাকরণ বই

এমন গ্রামদেশে, রাত্রি জেগে ঘুমায় কত না গুহালিকে
নির্ঘুম বলে কথা, ভ্যালুজ আর রিচ্যুয়ালে

মা গেছেন উড়ে, অতীত থেকে দূরে, দূরে
কুটুমপাখি এক
আমাদের ধানক্ষেতে নড়ে তার কালিঝুলি
কাক-মুখ

আমরা দুজন করি চাষ, কাঁদা ঘেঁটে ঘেঁটে
জন্মায় মা, পিঠের ঘাম আর পৌরুষ ফেটে
ব্যাকরণ পণ্ডিত, আলে দাঁড়িয়ে আজীবন,
যায় সম্পর্কের গা চেটে

এমন গ্রামদেশে, উঁচুনিচু মানুষের সাথে উঁচুনিচু পাখি
সুরেলা সংকেতে, বলি কথা, বই ও বাইরে থাকি
শস্যের বর্ণমালায়, চাষের অক্ষর
জড়িয়ে না-জড়িয়ে পাঠ্যের যত ভীতু স্বর
গায়, জীবনের গান,
সুরেলা মাতৃবোধে, ক্রমে জৈবপ্রিজম;
পণ্ডিতের অগোচরেই বয়
বাক্যের নদীখানি কোলাহলময়

গুহালিক দেখে তাকে, আকাশের গল্প কয়

এমন গ্রামদেশে, এমন এমন কতকিছু হয়!
আর গোলাভরা শস্যে, লুকায় ক্রিয়া ও অব্যয়

মা, খালা, খুঁদ, কুরা, এবং লাতার দুপুর

তো, কখনো কখনো রিচ্যুয়ালের শরীরের গন্ধ শুঁকে শুঁকে চলে যাই গ্রামের বাড়ি
ইথিকসের হৃদপিণ্ডের যত বাড়াবাড়ি, তা এড়িয়ে চেপে বসি চুরি করা তেঁতুলের গাড়ি
আর, জানি
এখন তেঁতুলের দখল নিয়েছে কিছু বাণিজ্যিক কোম্পানি

ভাবি, পেয়ে যাই নিজেকে, খুঁদ ও কুড়া এবং লাতার দুপুরে
মা বসে বসে কুনাঘরে অভাবের আগুনে কী নিদারুণ পোড়ে

মা চাল থেকে কুরা ঝাড়েন, খুঁদ বাছেন কুলায় খুঁটে না-খুঁটে
হঠাৎ, খালাকে দেখে, খালাকে পেয়ে তার মুখে হাসি ফোটে

দুই বোনে জড়াজড়ি, অতীতের বাড়াবাড়ি, অশ্রুতে আনন্দ মেশে
চাষার যৌথ সংসারে, কত না, তাদের কত না অভাবের দিন গেছে

যদিও, এখন মেশিনে ধান মাড়ান হয়, তবু, তাদের যৌথ গাইলরে (ঢেকি) পাড়
নিয়মিত ধান বানাতে পাড়ার সকল নারীর বাহাদুরিকে মানতো হার

এখন মেশিনের ধান বানাতে খুঁদের দেখা নাই, কি করে খাবে খুঁদের জাও?
খালা দামি টিস্যুতে ঘাম মুছতে মুচতে মায়েরে জড়িয়ে বলে, আজ খামু তোর হাতের খুঁদের জাও
কত দিন, কত দিন খাই না
বুবু তোর হাতের ছোঁয়া পাই না
দেখ, আজ দুজনে কেমন বুড়ি!
আমরা ছিলাম পাড়ার বাহুবলি ছুড়ি

আমি নাই বাড়ি, আছি এখন শহরের বন্দি কোনো আবাসে
ডাঙর লাতাটি ধরবার লোক তো কেউ নাই
মা একাই আছে কেবল মায়ের পাশে

ফলে, পাশের বাড়ির যতিন লাতাটি ধরতে এসে বলে, দাদি এখন তো ফার্মের মুগরি খাইতে স্বাদ
(যতিনের হাতে লাতাটি করে উঠে আর্তনাদ)
দেশি মুরগির মাংস খুব শক্ত
খালা এসেছে আজ, আমাদের বাড়ি দুপুরবেলার এই অক্ত
খালা বলে, হোক শক্ত, লাতার মাংস আর খুঁদের জাও খামু আজ বুবুর হাতে
আর, আমাদের অনেক হারানো দিন, তার একটি কুড়িয়ে নিয়ে যাব সাথে

দেন, মা ও খালা জাও ও লাতায় হয় বুঁদ
সারা বাড়িতে উঠে কেবল স্মৃতির বুদবুদ

ইথিকস ও রিচ্যুয়ালের নদীতীরে উড়ে উড়ে আসে অনেক বিলুপ্ত প্রায় পাখি
মানজঙ্গলে ডেকে যায় ব্যাঙমা, ফুরিয়ে যাওয়া রাত্রির বুকে জীবন, কেনো খুব একাকী?

আমি দূরে, মায়ের ডালিমকুমার, কেবল ইমাজিনেশনের পথ ধরে,
ধরে
ভার্চুয়ালের পৃথিবীতে, কঙ্কাবতীর দেখা নাই, আছে সময়ের এক রাক্ষস,
স্মৃতি-বিভ্রম মেমোরির পরে

মা ও খালার এই ছোট্ট খোকা, ভাবে জীবন এমন কেনো? মাগো জীবন এত ছোড কেনে?
অভ্যাস ও দায়িত্বের বেড়াজালে সব প্রেম, সব অনুভব তথাপি মুক্তবাজারের লোকেরা নিচ্ছে আমার আমিকে কিনে।

আমার শৈশব ৫

বস্তুত, ফুরিয়ে যাওয়া মালতী ধানের গোলায় বয়স্ক নীরবতা
কীটেরা খায় তার দেহ, খুঁটে না-খুঁটে

গোলার নিচে বসে কুনা ব্যাঙ ডেকে ডেকে ক্লান্ত
কবে আসবে বর্ষকাল

মায়ের মৃত্যুর পর বাবা হাট থেকে কিনে এনেছিল কিছু নীরবতা
তা এখনো গোলার শূন্যতা পূরণ করে চলেছে

তো, ঝড়ের পূর্বের রাতে হয়েছিল মালতীর বিবাহ
মাঠের সকল ধান এসেছিল কনে সাজাতে
কুনা ব্যাঙও গেয়েছিল গান মনের সুখে

পরের দিন ঝড় এলো গাঁ ডুবিয়ে বর্ষা
কলার ভেলায় ভেসে ভেসে আমি পৌঁছেছিলাম
অন্ধ এক গ্রহের বাড়ি

ছয় দিন ছয় রাত পর ফিরে এসে দেখি
ঘরের কোণে উবু হয়ে আছে শূন্য ধানের গোলা

বয়স্ক নীরবতাকে খুঁজতে বের হলাম তখনি, কোথাও

বস্তুত, সকল ধানের অতীত হারিয়ে যাওয়ার
আমার মা ও বাবার অপ্রাপ্ত সুখের মতো, অথবা
আমার হারিয়ে যাওয়া মালতীর শূন্যতার

ফিরে এসো তুমি করোনাকাল শেষে

ফিরে এসো তুমি, নতুন ফসলের ভোরে
বকুল রাখবো আঙিনায় থরে বিথরে
সংসারি হবো ওই বনহংস নদীটার তীরে
ফিরে এসো তুমি, সরল মনের ছোট নীড়ে

আমলকি গাছটা কেটে ফেলার অভিমান ভুলে
ফিরে এসো, দিবো না মেপে জমি, সব দিবো তুলে
জমির আল, ওই খালের মুখে বাঁধ দিবো খুলে
ফিরো এসো তুমি, বাড়িটি সাজাবো বুনোফুলে

ফিরে এসো, জীবননাশী জীবাণুরা পরাজিত হলে
সম্মতি পেলে শস্যের স্বপ্ন, ধানফুলের মালা দিবো গলে
ফিরে এসো তুমি, মনহর বিলে রাজহংসীর দল ফিরে এলে
ইচ্ছেগুলি দেখবে এসে কলমির বনে শিশিরের মতো দুলে

ফিরে এসো তুমি, ফিরে যাওয়া সবুজ ফিরে এলে সব
দূরত্ব ঘুচে গেলে পৃথিবীর সব, বনে বনে প্রাণের কলরব
ফিরে এসো তুমি, ফিরে এলে যত হারানো বনস্পতি
তোমার স্মৃতিচিহ্ন আঁকা আম জাম কাঁঠাল আর সুমতি

ফিরে এসো তুমি, ওগো প্রিয়া, মুক্ত হলে ফড়িঙের ডানা
সাধ্যমতো করবো জয়, তোমাকে দিবো গান, বাউলিয়ানা
ফিরে এসো, সংসারি হবো, দিবো এক সবুজপাতার ঘর
সব অভিমান উড়িয়ে দিবো, কবুতর উড়াবো বিহানের চর

ফিরে এসো, তারারা দিবে পাহারা, করোনা দিবেনা যখন হানা
দিয়ো সুযোগ এই নতুন চাষাকে, রাখবোই সত্য প্রেমের নমুনা
বুঝে নিবে বন, বুঝে নিও  বিল, নদী, বুঝে নিবে পাখির কলতান
ফিরে এসো তুমি, বুঝে নিবে জল, এই সজন মাটি ও ফসলের গান

মিতব্যয়ী

নিজের কান্নার জল থেকে
নুন কুড়িয়ে খেতে পারে যে; সে-ই মিতব্যয়ী