মাসুদার রহমানের গদ্য ‘বর্ষা, বড়ুচণ্ডিদাস ও রাজহংসী’

প্রকাশিত : জুন ১৯, ২০২০

সেবার ঠাকুরের সঙ্গে প্রথম দেখা। দেখাও ঠিক নয়; উনার কথা শুনছিলাম মাত্র। আমাদের গ্রামদেশে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি, পথঘাট ধুলোয় ধূসর কিংবা কাদায় কর্দমাক্ত— কাঁচা। একজন অপরিচিত লোক অন্ধকারে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালেন। সময়টা নিশ্চিত রাত্রি। আমরা হারিকেনে টিমটিমে আলো জ্বেলে বসে আছি অন্দরে। বাইরে থেকেই উনি বলছেন, শুধু তার কথাটুকু পাচ্ছি। তাকে দেখছি না। উঠোনে; অন্ধকারের মধ্যে তার জলদগম্ভীর কণ্ঠ। ভালো লাগছে। তার কথার চিত্রপট ফুটে উঠছে মনের ভেতর। ওই যে বলে না, মনের ক্যানভাস; ছবিগুলো যেন ওখানেই ফুটতে থাকলো। মেঘ করে এলো। অজস্র মেঘ। নীল আকাশ বলে কিছু নেই; শুধুই মেঘাকাশ। বজ্র ও বিদ্যুৎ ভর্তি। বৃষ্টি ও বাতাস ভর্তি। সৈয়দ হক তার একটি গ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন ‘মেঘ ও মেশিন।’ সেই সূত্র ধরেই মেঘকে যদি মেশিন ভাবি তা হলে কী কী উৎপাদিত হচ্ছে সেই মেঘমেশিনের মধ্যে? মেঘমেশিন প্রডাক্টশনে যা উল্লেখযোগ্য তা হলো রং। কত বিচিত্র রং আর রূপ মেঘের। আর বৃষ্টির কথায় তো আসতেই হয়। কত কত স্টাইলে তার ঝরে পড়া। ঝিরি ঝিরি। রিমঝিম। ঝর ঝর। ইলশেগুড়ি। ঝমঝম। এই বৃষ্টিজ্ঞান বর্ষাজ্ঞান পেয়েছিলাম তো ওই ঠাকুরের কাছেই। কে এই ঠাকুর? ঠাকুর কী তিনিই যাকে আমি ঠাকুর ভাবি, না স্বযং বর্ষাই ঠাকুর? ভাবনার হ্যাঁ ও না-গুলো একাকার হয়ে যায়।

সকালে জানালা খুলেই চোখ চলে যায় কাছের কামিনীঝোপে, দূরের বৃষ্টিগাছের মগডালে; তার উপরের আকাশ গাইছে আহৈর ভৈরবী। ঝুঁকে আসছে মেঘ। রাশি রাশি মেঘ। অন্তহীন মেঘ। বেশ ভোরে ঘুম ভাঙার অভ্যেস; দীর্ঘদিনের। তাতে করে ঘুম ছাড়বার পৃথিবীর কত গোপনীয় কস্ট্যিউম দেখা জানা হয়। আরও একটি দিন তার ঘুলিঘুলি অন্ধকারের ড্রেসিংরুমে পোশাকআশাক পড়ে নিতে থাকে। পড়ে নিতে থাকে তার অন্তবাস; ব্রা ও পেন্টি। রোদের পোশাক, মেঘ ও ছায়ার পোশাক। কোন কোন দিন তার হাওয়ার বাইকে চড়ে যাত্রা করে। কোন দিন মেঘের বিমানে। পাখিরা আড়মোড়া ভেঙে জাগে। পাখিরা গতরাতে তাদের দেখা স্বপনের বিবরণ বলে চলে তার সঙ্গি ও সঙ্গিনীকে। আমাকেও বলে কিছু। পাখিদের স্বপ্নের কথা শুনতে ভালো লাগে। এই মেঘ করে আসা ভোর, এখনও পর্যাপ্ত আলো না আসা ভোর একটা পুরনো পৃথিবীর সাথে দেখা করিয়ে দেয়। সেখানে আমার পরিচিত কেউ নেই। এই সারি সারি গাছগুলো। উধাও ধানমাঠ। বর্ষার জলে থই থই বিলঝিল। প্রতিদিনের আমার দেখা যে পৃথিবী; এই পৃথিবী যেন সে পৃথিবী নয়। ঘুমের খোলস ভেঙে হাওয়ায় পাখা ভাসিয়ে সবার আগে যে রাজহংসি আসে, ওই রাজহংসিকে নিশ্চয় দেখেছিল বড়ু চন্ডিদাস। তাহলে কি দাঁড়ালো? ওই রাজহংসি বড়ুচন্ডিযুগীয়। তার সাথে আমার এই ভোরবেলা দেখা হয়ে গেলো। তাহলে ওর কণ্ঠে যা গীত হচ্ছে নিশ্চয় বৈষ্ণবপদাবলি থেকে? আমি ঠিক বুঝি না।

কেবল মনে করি, রাজহংসিটি বৈষ্ণবসম্বনধীয় পদ গাইছে। আসলে এমন ভোরবেলা যা যা মনে করা হয় যেন তাই হতে থাকে। তার উপর এই মেঘ ঝুকে থাকা ভোর। মেঘের পটভূমিকায় সাদা বকপাখির উড়ে যাওয়া। এমন দৃশ্য কত দেখেছি কিন্তু কখনও সে দৃশ্য আমার হয়নি। যতবার দেখি সে দৃশ্যে ঠাকুর এসে দেখা দিয়ে যান। ঠাকুর থেকে কালিদাস পর্যন্ত। সেখানে পৌঁছিবার রাস্তা এক একটি বর্ষাদৃশ্য। এক একটি আষাঢ় শ্রাবণ কিংবা ওই মেঘের বিমান।

কে যেন একবার বলে উঠে, ‘তোমার প্রিয়ঋতু যদি বর্ষাই হয়ে থাকে তবে তো তুমি ব্যাঙ গোত্রীয় হে’! ভাবি ব্যাঙ-ই হয়তো আমার স্বাভাব। পুনশ্চ ভাবি; বর্ষা বলতেই তা কেবল ব্যাঙের? পরে সপ্রতিভ হই, ‘একদম-ই না।‘ কিন্তু ওই যে সঠিক সময়ে সঠিক জবাবটি কখনও দিতে পারি না। মনের আকাশে মেঘ ঝুকে থাকে। ভোরবেলাকার আলো আধাঁর কাটতে দেরি হয়। যে রাজহংসিটির সঙ্গে দেখা হয় তাকে আমার নিজের করে ভাবতে দেরি হয়ে যায়। বেলা হয়ে আসে। ফলে, যা হয়; হংসিটি বড়ু চন্ডিদাসের হয়েই পদাবলিকীর্তনে গলা হাঁকে। সাদাবক বৃষ্টিআসন্ন মেঘের পটভূমিকায় উড়ে যায় জোড়াসাঁকোর দিকে।

লেখক: কবি