মাহবুব মোর্শেদের ‘অরব বসন্ত’ থেকে ৫ কবিতা

প্রকাশিত : জুন ১৩, ২০২০

২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশনা সংস্থা বৈভব থেকে প্রকাশিত হয় মাহবুব মোর্শেদের কবিতার বই ‘অরব বসন্ত’। বইটি থেকে পাঁচটি কবিতা ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশ্যে:

রিবার্থ

যেন ভেজা মাটির গা ছুঁয়ে, ঝরাপাতার ভেতর থেকে
সতর্ক মচমচ শব্দে বেরিয়ে এলাম, সন্তর্পণে
দীর্ঘ শীতঘুম শেষে।
যেন পুরনো খোলস ছেড়ে বের হলো স্মৃতিহীন অন্ধ সাপ।
যেন অরণ্যের গভীরে আবার জন্ম হলো আমার।
মাতৃগর্ভের ছায়ায় আমাকে ঘিরে ধরলো
আকাশঢাকা পত্রালি, বৃক্ষছায়া

এ কোথায় পৌঁছালাম আমি

মাটির গর্ভ থেকে পূর্ব ও পশ্চিমের সকল দাগ মুছে
আমাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে দিলো জগৎ-জননী।

এই কি নবজন্ম— রিবার্থ মানুষের?

ঘন অরণ্যের ভেতর সর্বহারা
স্মৃতিহীন বোকা হয়ে আছি

যেন পত্রালির শামিয়ানা ভেদ করে সহস্র চোখ
পর্যায়ক্রমে সূর্যের স্মারক নিয়ে দেখছে আমাকে
অভিবাদন জানাবে কি জানাবে না— দ্বিধায় বিভক্ত
ছন্নছাড়া হাজার আলোর রেখা
যেন সূর্যের, যেন পৃথিবীর গহীন অন্ধকারে
সঘন তমসার দিকে চেয়ে আছে।

আমি জেগে উঠছি
বৃক্ষের বল্কলে জেগে উঠছে গান
যেন কোনো প্রেম নিঃশর্ত জন্ম থেকে জাগিয়ে
নিঃস্বার্থ মৃত্যু থেকে জাগিয়ে শব্দহারা বাক্যহারা
জঙ্গলে আমাকে নগ্ন করে ফেলে গেছে নতুন জন্মের নামে
আমার সমস্ত চিন্তা ধ্যান আত্মা স্মৃতি ইতিহাস ছিটিয়ে
রেখেছে অরণ্যের ঘাসে ঘাসে পাতায় পাতায়
আমি যেন নিজের গরজে
আবিষ্কার করব নিজেকে
জনহীন অরণ্যে খুঁজে নেব চিন্তা আত্মা শোক ও অসুখ
কুড়িয়ে নেব দুঃখ— আকাশস্পর্শী গাছের কোটর থেকে
পেয়ে যাব হাসি তৃণগুল্মের তলে
নিজেকে গুছিয়ে নেব আবার এই ঘনবনে।
তোমারই অরণ্যে আমি তোমাকেই খুঁজে দেব
পাহাড়ি ঝরণা
বলব, নাও ভেজো, স্নান করো
যেন তুমিও হারিয়ে গেছ আমারই মতো
অরণ্য ঝরণা ঝরা নদী গাছ বৃষ্টি
তোমরাও নতুন করে জন্মেছ।

তোমরাও আমারই মতো
পথেই হারিয়ে ফেলেছ পথ।

আদর

পেয়ালায় দুধের অবশেষটুকু শুষে নিতে
যেভাবে ক্ষুধার্ত বিড়াল গুটি পায়ে
আরক্ত নয়নে, সতর্ক অথচ ভীষণ ক্যাজুয়ালি
হেঁটে আসে, খায়
অতর্কিতে, কিন্তু খুব প্যাশনেটলি
সেভাবে আমিও পান করি তোমার দুঃখ
তোমার কান্নার শেষে পেয়ালায় পড়ে থাকা
দুঃখের অবলেশটুকু

তুমি তো জানো
ওগো দুঃখজাগানিয়া
কতদিন ধরে অভুক্ত আমার আত্মা
সামান্য দানাপানিও খাইনি কতদিন
স্পর্শ করিনি একটুকু জল
মরণের ক্ষুধা নিয়ে
তোমার সমুখে পেতেছি আমার আত্মা
তোমার দুখের পেয়ালার অবশেষটুকুর দিকে
লোভি বিড়ালের মতো চেয়ে আছি

আমাকে সুযোগ দিয়ে একটু আড়ালে
ওইঘরে চলে যাও

পার্টি ও প্রেম

শ্রেণিসংগ্রাম নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে তোমার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মিশে যাচ্ছে আমার দৃষ্টিপাত। মার্কসবাদের কী অবাক মহিমা! ব্যক্তিগত জীবনের কথা অনুক্ত রয়ে গেল, তবু প্রোলেতারিয়েত, পার্টিলাইন, অক্টোবর বিপ্লব এইসব সংকেতের আড়ালে নীরব গেরিলার মতো বেড়ে উঠছে আমাদের প্রেম।

মার্কসবাদ তোমার দৃষ্টির শুভ্রতার নাম
তোমার গোপন হিংসার নাম পুঁজিবাদ
বসে থাকবার বিষণ্ণ ভঙ্গির নাম লেনিন
দীর্ঘকৃষ্ণ কেশের নাম নারীর ঐতিহাসিক পরাজয়
প্রতিটি কটাক্ষের নাম রাশিয়া, চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম

পুরুষেরা বিপ্লব ভেবে যাতে ঝাঁপ দেয় তার নাম পুঁজিবাদ
আর প্রেম ভেবে যাকে আলিঙ্গন করে তার নাম প্রতিবিপ্লব।
তবু বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব, প্রেম ও পুঁজিবাদে মাখামাখি হয়ে থাকে আমাদের সান্ধ্যঅবসর। তোমার দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে আমার প্রতিনিঃশ্বাস, উত্তাল দৃষ্টিকোণের গভীরে আমার উৎপ্রেক্ষার আবরণ।
আর আমাদের প্রেম বেড়ে উঠছে বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের দ্বন্দ্ব ও দ্বিধায় দোদুল্যমান,
অনভ্যস্ত, দীর্ঘকাল পর পার্টি অফিসে ঘুরতে আসা লুম্পেন প্রোলেতারিয়েতের মতন।

মিডিয়া

দু’হাত প্রসারিত করে আলিঙ্গনে যাবার প্রাকমুহূর্তের ভঙ্গিমায় যাকে আস্বাদন করে যেতে হয়— ব্যগ্রব্যাকুল অভিনিবেশের সাথে; সেরকম একটি নিউজ পেপারের ছেঁড়া টুকরো খেতের ওপর পড়ে আছে। পার্কের বেঞ্চিতে, কাগজ কুড়ানো ছেলেদের হাত ঘুরে, হোটেলে— পিঁয়াজুর মতো সুস্বাদ খাবারকেও মুড়ি দিতে পেরে, এক সফল, চাঞ্চল্যকর দৈনিকের টুকরা তার অক্ষর সর্বস্ব হলদেটে হৃদয় নিয়ে অক্ষরহীন এক চষা ক্ষেতের ওপর এসে পড়েছে।
উড়ে এসে জুড়ে বসা এইসব খবর কাগজ— খণ্ডিত, অর্ধসত্য, ধুলোমলিন। তবু তার সুসভ্য ছাপার হরফ— ব্যক্তিত্ব ও বিজ্ঞতা নিয়ে হ্যান্ডসাম।
সভ্যতার এক আজব প্রতিনিধি ভেবে বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় দূরে, তার মিথ্যা জ্ঞান, তথ্যবিভ্রাট, হলুদ বর্ণ সহকারে— লোকালয়ের দিকে হাওয়ায় হাওয়ায়।

ইমরুল কায়েস

উপত্যকায় উপত্যকায় অপ্রয়োজনে অনাকাঙ্ক্ষায়
ঘুরে বেড়াও তুমি; আমি তোমার চিন্তাকে স্পর্শ করেছি
এবং এও জানি— কীসের লোভে বৃষ্টি-বঞ্চিত মরুতে
ঘুরে ঘুরে উদভ্রান্ত হয়ে গেলে

চিরদিনই ইহজীবনের কাছে অবোধ্য রয়ে গেল
উপমা ও উৎপ্রেক্ষার ঠার, ধ্বনির মাদকতা আর
পঙক্তির ঝাঁঝ। ততোধিক কবিদের উদভ্রান্তি ও চিৎকৃত মোহনীয়তা।

তোমার কবিতা মরুর বালুতে বিলুপ্ত,
চন্দ্রমাকে ঢেকে দিয়েছে সূর্যস্পর্শ— তবু, ইমরুল কায়েস, জানি,
মস্তিস্কের গোপন পদ্মের রসক্ষরণে তুমি মাতাল,
বিপন্ন ও ঈশ্বর-বঞ্চিত। প্রদক্ষিণ করছো বেদুঈনদের তাঁবু
আর সুখময় রাতগুলি—
করুণ উষ্ট্রের পিপাসার্ত হৃদয়ে মিশে গিয়ে...