মাহবুব মোর্শেদের গদ্য ‘প্রসঙ্গ সলিমুল্লাহ খান’

প্রকাশিত : জুন ১২, ২০২১

এদেশে প্রগতিশীলদের দার্শনিক বলতে দুজন। আরজ আলী মাতুব্বর ও সরদার ফজলুল করিম। এই দুজনের বাইরে গোবিন্দ চন্দ্র দেব দার্শনিক হিসেবে কিছুটা খ্যাতি পেলেও তাকে নিয়ে তেমন কথা শোনা যায় না। গ্রামে বসে স্বশিক্ষিত আরজ আলী মাতুব্বর কীভাবে প্রগতিশীলদের মতো চিন্তা করতে পারলেন, এই নিয়ে শহুরে প্রগতিশীলদের বিস্ময়ের শেষ নাই। আবার সরদার ফজলুল করিম কীভাবে গ্রীক দার্শনিকদের লেখাপত্র বাংলায় অনুবাদ করতে পারলেন, তা নিয়েও বাঙালি বিস্মিত। এছাড়া ঊনিশ শতকের কলকাতার কাউকে কাউকে দার্শনিক হিসেবে পরিচিতি পেতে দেখা যায়।

কিন্তু বাঙালির দর্শন চিন্তায় যার অবদান কোনোভাবে অস্বীকার করার জো নাই, সেই লালনকে প্রগতিশীল টেক্সটগুলোতে দার্শনিক হিসেবে স্বীকৃতি পেতে দেখা যায় না। স্বাধীন বাংলাদেশে দার্শনিক বলতে সাকুল্যে আরজ আলী আর সরদার ফজলুল করিম। ফরহাদ মজহার যে দীর্ঘদিন দর্শনচর্চা করে গেলেন, তার স্বীকৃতি দিতে লোকজন বড়ই কুণ্ঠিত। আহমদ ছফাকে চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবী বলা হলেও দার্শনিক বলা হয় না। এখন দেখছি, বহুদিন দর্শনচর্চা করার পরও সলিমুল্লাহ খানকেও দার্শনিক বলতে অনেকেই চান না।

যারা বলতে চান না তাদের বক্তব্য হলো, সলিমুল্লাহ খানের নিজের কোনো কথা নেই। তিনি অন্যকে উদ্ধৃত করে কথা বলেন। ইউরোপীয় দার্শনিকদের লেখাপত্র ব্যাখ্যা করেন মূলত। এখন প্রশ্ন হলো, প্লেটো তো সারা জীবন সক্রেটিসের কথাবার্তা উদ্ধৃত করে গেলেন। তাকে আপনারা কোন যুক্তিতে দার্শনিক বলেন? আবার বার্ট্রান্ড রাসেল সারা জীবন ইউরোপীয় দার্শনিকদের লেখাপত্র বিশ্লেষণ করে গেলেন। ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস লিখলেন। তাকেই বা আপনারা দার্শনিক কিভাবে বলেন?

সলিমুল্লাহ খানের বিরুদ্ধে আরেকটা গুরুতর অভিযোগ হলো, তার লেখা বই কম। থাকলেও তাতে তার নিজের মনোভাব খুব একটা প্রকাশিত হয় নাই। এই যুক্তিটা পেছনে কিছু সারবস্তু থাকলেও থাকতে পারে। আমার মতে, সলিমুল্লাহ খান কথক হিসেবে একরকম, লেখক হিসেবে আরেকরকম। তিনি লিখতে বসলে খুঁটিনাটির দিকে এতই অভিনিবেশ দেন যে, লেখার বিষয়বস্তু হারিয়ে যায়। মূল বিষয় থেকে মনোযোগ হারিয়ে সাধারণত গুরুত্বহীন কোনো বিষয় তার বিশেষ মনোযোগ পায়। উদাহরণ হিসেবে কি ও কীর কথা বলা যায়।

আলমগীর কবীর নিয়ে তার অতি উচ্ছ্বাস শেষপর্যন্ত কোনো মানে তৈরি করে না। সলিমুল্লাহ খান যে মানের বুদ্ধিজীবী, তাতে হুমায়ুন কবির নিয়ে তার এত চিন্তার কোনো কারণ দেখি না। অমর্ত্য সেন নিয়ে তিনি যথেষ্ট শক্তিক্ষয় করেছেন। আমি বলব, অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও জসীমউদদীন নিয়েও তিনি যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছেন। বরং কাজী নজরুল ইসলাম ও আহমদ ছফার ওপর তার কাজগুলো আরো সংগঠিতভাবে হওয়া দরকার ছিল। সেটা বোধহয় খুব কঠিন। কেননা সলিমুল্লাহ খান লেখার জন্য যে ভাষা বেছে নিয়েছেন, তা তামাদি হয়ে গেছে। এ ভাষায় লেখা তো দূরে থাক, লেখার চিন্তাও করা দুরূহ।

তার মতো একজন লেখক কেন সাধুভাষার পাকচক্রে পড়লেন, তা বোধগম্য নয়। সলিমুল্লাহ খানের লেখা পড়লে মনে হয়, সাধু ভাষাকে তিনি জীবন দিয়ে দিয়েছেন। এ ভাষায় না লিখলে তার পেটের ভাত হজম হওয়ার নয়। মুক্তচিন্তার একজন বুদ্ধিজীবীর এমন আচরণ শুধু অসহনীয় নয়, নিন্দাযোগ্য। যেদিন তিনি সাধু ভাষাকে গদ্য লেখার জন্য অবলম্বন করেছেন, সেদিন থেকেই লেখক হিসেবে তার সর্বনাশ ঘটে গেছে। ফলে সলিমুল্লাহ খানের বইপত্র নিয়ে কিছু বলার নেই। বই পড়ে সলিমুল্লাহ খানকে পাওয়া যাবে না।

বরং গ্রীক দার্শনিকদের মতো ওরেটর বা কথক হিসেবে তাকে বিশেষ মর্যাদা দিতে হবে। ইউটিউবে তার বক্তব্যগুলো থেকে দার্শনিকতা বুদ্ধিজীবিতা ও চিন্তার বহু উপাদান সংগ্রহ করা যায়। কোনো প্লেটো যদি সেগুলো সংগ্রহ করে বই করেন, তবে সলিমুল্লাহ খানের বই থাকবে। তাতে তার নিজস্ব মতামতও পাওয়া যাবে। সলিমুল্লাহ খানের বলার মধ্যে চঞ্চলতা আছে, জ্ঞান প্রকাশের জাঁক আছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে তিনি যা বলতে চান বা বলেন তা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বইপত্র ছাড়াই আমি তাকে দার্শনিক বলতে রাজি।

আমরা এখন নতুন একটা যুগের সামনে দাঁড়িয়ে। কথোপকথন ও মুখে বলার  মধ্য দিয়ে জ্ঞানের যে চর্চা অতীতে শুরু হয়েছিল তা ক্রমশ লেখালেখির মধ্যে প্রবেশ করেছিল এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে ছাপা কাগজের বই হয়ে দাঁড়িয়েছিল শেষ কথা। এখন অডিও ভিজুয়ালের দৌরাত্ম্যে আবার কথোপকথন ও বলার যুগ ফিরে এসেছে। কেউ বই না লিখে শুধু ইউটিউবে বক্তব্য দিলেও তাকে দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে মেনে নিতে হবে। সামনের দিনে এমন ঘটনা আরো বাড়বে। আবার শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েও কেউ বুদ্ধিজীবী হয়ে যেতে পারবেন। ছাপা কাগজের বইয়ের দিকে না তাকিয়ে যিনি কথা বলছেন সমাজে তার কথার প্রভাবের দিকে তাকালেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক