অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

অলঙ্করণ: মারিয়া সালাম

মাহবুব মোর্শেদের গল্প ‘পোস্টমাস্টার রিভিজিটেড’

প্রকাশিত : আগস্ট ৩১, ২০২০

জীবনের প্রথম কাজ শুরু করতে রতনকে ঢাকা আসতে হয়। ঢাকা বৃহৎ শহর। মিরপুরে যে বাড়িতে রতনের কাজের ব্যবস্থা তার পাশে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, এলাকার অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা অনেক জোগাড় করে নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের একটি শাখা এখানে স্থাপন করিয়েছেন।

আমাদের রতন উল্লাপাড়ার মেয়ে। পানির মাছকে ডাঙায় তুললে যেরকম হয়, এই মেট্রো শহরের মধ্যে এসে রতনেরও সেই দশা উপস্থিত হয়েছে। বারোশ’ বর্গফুটের একটি ফ্লাটের মধ্যে তার কাজের জায়গা; বাসার বারান্দা থেকে একটা মজা পুকুর দেখা যায় এবং বিল্ডিংটির চারিদিকে আরও কয়েকটা বিল্ডিং সারিবন্ধভাবে দাঁড়ানো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রতন স্কুলের শিক্ষার্থীদের দেখতে পায়, কিন্তু রতনের দিকে তাকানোর ফুসরত তাদের প্রায় নাই।

বিশেষত উল্লাপাড়ার মেয়ে ভালো করে মিশতে জানে না। অপরিচিত স্থানে গেলে, হয় উদ্ধত নয় অপ্রতিভ হয়ে থাকে। এ কারণে আশপাশের লোকের সঙ্গে তার মেলামেশা হয়ে ওঠে না। অবশ্য বাইরের কারো সঙ্গে মিশবার প্রসঙ্গ এখানে নাই। বাইরে যাবার দরজায় মস্ত তালা পথরোধ করে আছে। দিনে কাজ বেশি নাই। আপা ও দুলাভাই বাচ্চা নিয়ে বাইরে যাওয়ার পর কখনো টিভি দেখার চেষ্টা করে। একবার পশ্চিমের বারান্দায় একবার পূবের বারান্দায় গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক মনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার কল্পনার জগৎ তরুপল্লবের কম্পন এবং আকাশের মেঘ ও খোলামাঠে আচ্ছাদিত হলেও— আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য এসে সহসা এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলো কেটে পাকা রাস্তা বানিয়ে দেয় এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হতে রুদ্ধ করে ফেলে। কল্পনা থেকে জেগে উঠে চারদিকে তাকিয়ে রতনের ইচ্ছা হয় আবার চোখ বন্ধ করে সেই কল্পনার জগতে সশরীরে ঢুকে পড়ে।

রতনের বেতন অতি সামান্য। বেতনের বাইরে দু’বেলা খেতে পায়। পিতৃমাতৃহীন অনাথ তরুণীটি রাত্রে তিনজনের পরিবারের জন্য রাঁধে, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির খুঁটিনাটি সমস্ত কাজ করে। দুপুরে একলা বাসায় নিজে রেঁধে খেতে হয়। বয়স কুড়ি-একুশ। বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যায় না। সন্ধ্যার সময় যখন শহরের ভবনগুলা থেকে গরম ভাপ বের হতে থাকে, মোড়ে মোড়ে গাড়ির জট থেকে গাড়ির হর্ন ঘন ঘন বেজে ওঠে, কাছে বস্তিমতো একটা জায়গায় শহরের নেশাখোর ছেলের দল উচ্চৈঃস্বরে গুঞ্জন জুড়ে দেয়— যখন অন্ধকার বারান্দায় একলা বসে ফাঁকা রাস্তা, নীরব স্কুলঘর দেখলে রতনের নারীহৃদয়ে ঈষৎ হৃৎকম্প উপস্থিত হয়, তখন কিচেনের বাতি জ্বালিয়ে রতন ছোট করে ডাকে `ঋভু`। রতন যাদের বাড়িতে কাজ করে তাদের একমাত্র সন্তান ঋভু প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই এই ডাকের অপেক্ষা করে থাকে। এক ডাকে সাড়া দেয় না, দুইবার ডাকলে, ‘আম উম, হাম হাম’ বলে খলবল করে ওঠে।

ঋভুর বয়স দেড় বছর। মুখে স্পষ্ট বোল ফোটেনি। রতনের ঢাকা আসার উপলক্ষ ঋভু। রতন ঢাকার আবহাওয়ায় থিতু হলে ঋভু দিনের বেলা তার কাছে থাকবে। বাবা-মা দুজন চাকরি করে বলে দিনে ঋভু এখন একটা ডে-কেয়ার সেন্টারে থাকে। রতন আসার পরও কিছুদিন পুরনো নিয়ম বহাল আছে। সকালে রতনকে দেখলে ঋভুর মা জিজ্ঞেস করে, তুই কী করতেছিস। রতন বলে, এখনই চুলা ধরাইতে যাব— রান্নাঘরের—

ঋভুর মা বলে, কিচেনের কাজ পরে হবে এখন— একবার ঋভুর দুধটা বানিয়ে দে তো।
অনতিবিলম্বে দুটি হাত চালিয়ে বোতল ভরা দুধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে রতনের প্রবেশ। হাত থেকে বোতল নিয়ে ঋভুর মা ফস্‌ করে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আচ্ছা রতন, তোর মাকে মনে পড়ে?’ সে অনেক কথা; কতক মনে পড়ে, কতক মনে পড়ে না। মায়ের চেয়ে বাপ তাকে বেশি ভালোবাসত, বাপকে অল্প অল্প মনে আছে। পরিশ্রম করে বাপ সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরে আসত, তারই মধ্যে দৈবাৎ দুটি-একটি সন্ধ্যা তার মনে পরিষ্কার ছবির মতো আঁকা আছে। এইরকম কথা হতে হতে ক্রমে রতন ঋভুর মায়ের পায়ের কাছে মেঝের ওপর বসে পড়ত। মনে পড়ত, তার একটি ছোটোভাই ছিল— বহু আগে বর্ষায় একদিন একটা ডোবার ধারে দুইজনে মিলে গাছের ভাঙা ডালকে ছিপ বানিয়ে মিছামিছি মাছধরা খেলেছিল— অনেক গুরুতর ঘটনার চেয়ে সেই কথাটাই তার মনে বেশি ভেসে উঠতো। কথাপ্রসঙ্গে মাঝে মাঝে সকাল ভারী হয়ে আসতো, তখন আলস্যক্রমে রতনের আর কিচেনে যেতে ইচ্ছা করত না। কিন্তু ইচ্ছা না করলেও যেতে হবে, আপা-দুলাভাইয়ের অফিসের দেরি হয়ে যাবে। ফ্রিজে রাতের রান্না থাকত এবং তাড়াতাড়ি চুলা ধরিয়ে খানকয়েক রুটি সেঁকে আনলেই— সবার সকালের খাওয়া হয়ে যেত।

এক-একদিন সকালবেলায় সেই বারোশ’ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের বিছানায় বসে  ঋভুর মা নিজের ঘরের কথা পাড়তেন— ছোটোভাই, মা এবং বোনের কথা, ঢাকায় বসে যাদের জন্য হৃদয় ব্যথিত হয়ে ওঠে তাদের কথা। যে-সব কথা সবসময় মনে হয়, অথচ কলিগ-বন্ধুদের কাছে কোনোমতেই বলা যায় না, সেই কথা একটি অশিক্ষিত ক্ষুদ্র তরুণীকে বলে যেতেন, কিছুমাত্র অসংগত মনে হত না। হয়তো ভাবতেন, বাবা-মা হারা, নিখোঁজ ভাইয়ের বোনটি তার বেদনা বুঝতে পারবে। অবশেষে এমন হলো, রতন কথোপকথনকালে তার ঘরের লোকদের মা, আপা, ভাই বলে চিরপরিচিতের মতো উল্লেখ করত। ঋভুকে যে রতনের বিশেষ পছন্দ সেটা বেশ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ঋভুর ক্ষুদ্র হৃদয়পটে রতনের জন্যও একটা জায়গা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

একদিন বর্ষাকালে মেঘমুক্ত দুপুরে কিছুটা তপ্ত সুকোমল বাতাস বইছিল; রৌদ্রে ভেজা পিচঢালা রাস্তা এবং ইটে তৈরি ভবনগুলো হতে একপ্রকার গন্ধ বের হচ্ছিল; মনে হচ্ছিল, যেন ক্লান্ত শহরের উষ্ণ নিশ্বাস গায়ের ওপর এসে লাগছে, এবং কোথাকার এক নাছোড়বান্দা কাক একটানা কা-কা-কা কথা সমস্ত দুপুরবেলা প্রকৃতির দরবারে অত্যন্ত করুণস্বরে বার বার আবৃত্তি করছিল। রতনের হাতে কাজ ছিল না— সেদিনের বৃষ্টিধোয়া মসৃণ কালো রাস্তার পরিচ্ছন্নতা এবং পরাভূত বর্ষার ভগ্নাবশিষ্ট রৌদ্রশুভ্র স্তুপাকার মেঘস্তর বাস্তবিকই দেখার বিষয় ছিল; রতন তা দেখছিল এবং ভাবছিল, এই সময়ে ঋভু তার একান্ত আপনার লোক— মাঝে মাঝে বিছানায় ঘুমন্ত শিশুটিকে উঁকি দিয়ে দেখছিল। ঋভুকে পেয়ে পরিণত বয়সের তরুণীর মনে মাতৃভাবের উদয় হয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল, ঋভু যেন তার নিজের সন্তান। চাকুরিজীবী বাবা-মার অনুপস্থিতিতে শিশুটি যেন তাকেই মা ভেবে নিজের করে নিয়েছে। তার সমস্ত কথা, আভাস এখন রতন স্পষ্ট বুঝতে পারে। রতন শিশুটিকে অক্ষর জ্ঞান দেয়ার কথাও ভাবছে।

ঋভু জাগলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রতন ‘ঋভু’ বলে ডাকলো। ঋভু তখন নিজে থেকে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করছে; রতন ছুটে গিয়ে তাকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলে ঋভু রাঙা পা দু’টি মেঝেতে ছুঁইয়ে আলতো করে হেঁটে এসে তার কাছে এলে সে তাকে খুব যত্ন করে কোলে তুলে নিলো। রতন বলল, “আমাদের ঋভু বাবুর আজকের পড়া হয় নাই তো, নাকি?” ঋভু উত্তরে কিছু আজগুবি শব্দ উচ্চারণ করলো। রতন সমস্ত দুপুরবেলা তাকে কোলে নিয়ে ‘স্বরে অ’ ‘স্বরে আ’ করলো। রতনের প্রাণান্ত চেষ্টার ঋভুর অক্ষরজ্ঞান কিছু বাড়লো কি না কিছুই বোঝা গেল না।

শ্রাবণমাসে ঢাকা শহরেও এবার বর্ষণের অন্ত নাই। রাস্তাঘাট পানিতে ভরে উঠল। বাসা থেকে বৃষ্টিতে অচল হয়ে যাওয়া সিএনজি অটোরিক্সাগুলোর করুণ আর্তনাদ শোনা যায়। অনেক সময় রাস্তায় চলাচল প্রায় একপ্রকার বন্ধ— রতন ভেবে পায় না এ শহরে নৌকার ব্যবস্থা নেই কেন। নৌকার কথা মনে হতেই রতনের মন বাড়ির জন্য হাহাকার করে উঠলো। একদিন সকাল হতে খুব বাদলা করেছে। দুপুরে রতনের ছাত্রটি অনেকক্ষণ তার আদর পাওয়ার জন্য ঘুম হতে উঠে উন্মুখ হয়ে বসে ছিল, কিন্তু অন্যদিনের মতো দৌড়ে না এসে রতন ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে ঢুকলো। দেখল, ঋভু ঠোঁট ফুলিয়ে খাটের ওপর বসে আছে— হয়তো রতনের মনের জলোচ্ছ্বাস তার শিশুমনেও ঢেউ ফেলেছে। রতন ডাকলো “ঋভু”। তাড়াতাড়ি তাকে বুকে টেনে নিল। অনেকক্ষণ তাকে না দেখতে পেয়ে উৎকণ্ঠিত ঋভু কান্না জুড়ে দিল।

এই নিতান্ত নিঃসঙ্গ বিদেশে ঘনবর্ষায় রতনের শুধু বাইরে যেতে ইচ্ছা করে। এখানে বদ্ধ ঘরের মধ্যে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এই দূর বিদেশে নিজের ভবিষ্যত চিন্তা করতে গেলে রতন আর কোনো কূল পায় না। দিনের খাবার জুটছিল না বলে একটা কাজ চেয়েছিল। কাজ জুটেছে— আপা-দুলাভাই, ঋভু মিলে কাজের জায়গাটি খারাপও না। তবু আত্মীয়-স্বজনহীন, সহায়-সম্বলহীন উল্লাপাড়াকেই তার আপন জায়গা মনে হয়। ঢাকার আকাশ-বাতাস তার কাছে হঠাৎই অতিরিক্ত অচেনা মনে হয়। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠলে গোপনে রক্ষিত নম্বর টিপে একদিন উল্লাপাড়ায় ফুপাতো ভাইকে ফোন দিল রতন। বহুদিন ভেবে ঠিক করেছে- আর নয়, এখান থেকে চলে যাবে। ফুপাতো ভাই যেন ফুপুকে বলে তাকে নিতে আসে।

ঋভু এখন বাবা-মার উপস্থিতিতেও রতনের সঙ্গেই সময় কাটাতে পছন্দ করে। বাবা-মাকে পায় দিনের অল্প কয় ঘণ্টা। ঘুমের সময় বাদ দিলে সেও খুব সামান্য। ফলে, ঋভুর শিশুমনে রতনের ছায়াপাতই গভীর হচ্ছিল। তার বাবা-মা মাঝে মাঝে বিষয়টা নিয়ে ভাবলেও, ভাবনাকে বেশি এগুতে দিতেন না। রতনের কাছে সন্তান না রেখে তাদের আর বিকল্পই বা কী? শহরের কঠিন-কঠোর জীবন, সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে দু’জনকে চাকরি করতেই হবে। আর রতন যেভাবে পরিবারটির সঙ্গে মিলে গেছে তাতে তারা অনেকটা স্বস্তিই বোধ করতেন। কিন্তু রতন যে মনে মনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে সে খবর তারা ঘুণাক্ষরে টের পাননি। কিন্তু ঋভুর ছোট্ট শিশুমনে কোথা থেকে একটা খটকা এসে উপস্থিত হয়েছিল। হয়তো জানার, দেখার, শোনার সীমাবদ্ধতার কারণে শিশুদের অনুভূতি প্রখর থাকে। সে অনুভূতি দিয়ে ঋভু বুঝতে পারছিল রতন চলে যাচ্ছে। তাই সে রতনকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরছিল। ওইটুকু মন দিয়ে রতনের মন জয় করার চেষ্টা করছিল। রতন যখন তার আহবানে সাড়া না দিয়ে বারান্দায় থির দাঁড়িয়ে থাকতো কিংবা তার পাশে বসেও কথা না বলে চুপ করে থাকতো তখন ঋভু আপনমনে অবোধ্য ভাষায় তার সঙ্গে নানা আলাপ পাড়তো। রতন সে কথার অর্থ কিছু বুঝতো না। কিন্তু কথাগুলোর মর্ম চাইলে সে ভেদ করতে পারতো।

একদিন সকাল বেলা ঋভুর মাকে রতন বলে বসলো, আপা, কালই আমি যাচ্ছি।
ঋভুর মা। কোথায় যাচ্ছিস, রতন।
রতন। বাড়ি যাচ্ছি। আমার ফুপাতো ভাই আজকে নিতে আসবে।
ঋভুর মা। আবার কবে আসবি।
রতন। আর আসব না।

ঋভুর মা আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলেন না। রতন আপনিই তাকে বললো, বাড়ি যাওয়ার জন্য ফুপাতো ভাইকে ফোন করেছিল। সে নিতে আসছে। এখানে তার ভালই লাগছিল। বাসার সবাই ভাল। বিশেষ করে ঋভুর জন্য তার মন পুড়বে। কিন্তু শহরের বদ্ধ ঘরে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বড় কথা, নিজের ভবিষ্যত চিন্তা করে অন্ধকার দেখতে পায়। বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে জানে না উল্লাপাড়ায় গিয়েই বা কী করবে। ঋভুর মা-বাবা রতনকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু রতন ক্রমাগত কাঁদতে লাগলো। প্রথমে নিরবে পরে কান্নার আওয়াজ বাড়তে থাকলো।

কিছুক্ষণ পরে রতন আস্তে আস্তে উঠে রান্নঘরে রুটি বানাতে গেল। অন্যদিনের মতো তেমন চটপট্ হল না। বোধহয় মধ্যে মধ্যে মাথায় অনেক ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ঋভুর মা-বাবার খাওয়া শেষ হলে রতনকে  বললেন, “আর ক’টা দিন ঋভুকে দেখে রাখ, অন্তত একটা ডে-কেয়ার ঠিক করি। মাসের মাঝখানে যাবো বললে হয়?”
রতন বললো, “অনেক অনুরোধ কইরা ফকরুরে আনতেছি। এইবার ফিরা গেলে আর সহজে আসবে না”। এ কথা শুনে মাসের মাঝখানে ডে-কেয়ার পাওয়ার ঝামেলার কথা রতনকে বোঝানোর সম্ভাবনা তারা বাতিল করে দিলেন। বিশেষ যোগাযোগ করে একটা সিটের ব্যবস্থা করার কথা ভাবলেন।

সমস্ত রাত তারা ভাবলেন রতন চলে গেলে ঋভুর কী হবে। আবার-ডে কেয়ারের অনির্ভরশীল যত্নে ঋভুকে ফিরতে হবে। কীভাবে সন্তানের সঠিক বিকাশ হবে। ভোরে উঠে রতন দেখলো, আপা তার গোছানো ব্যাগের ওপর কিছু পুরাতন কাপড় ও একটা শাড়ি রেখে দিয়েছেন। রতনকে ডেকে তার পাওনা টাকা বুঝিয়ে দিলেন। গোসল করে খেয়ে প্রস্তুত হতে হতে রতনের ফুপাতো ভাই উপস্থিত হলো। রতন ঋভুকে কোলে করে পাশের ঘরে গেল। বললো, “বাবুসোনা, আমার জায়গায় যে মেয়ে আসবে সেও তোমাকে খুব ভালবাসবে। আমি দোয়া করে দেব।” ঋভুকে কোলে করে যখন এ ঘরে ফিরলো তখন রতনের চোখ আর্দ্র।

ঋভুর জন্য মেয়েটির ভালোবাসা দেখে বাবা-মা অবাক হয়ে গেলেন। রতন ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে রওয়ানা হওয়ার পর ঋভুর বাবা-মাও সন্তানকে প্রস্তুত করে বাসা থেকে বের হলেন। আটমাস পর আবার পুরনো রুটিন চালু হলো। রতনের বিদায় উপলক্ষে আজ একটু দেরিই হয়ে গেল। নতুন উৎকণ্ঠায় তাদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।

রতন ও তার ফুপাতো ভাই একটা ফোলানো ব্যাগ নিয়ে রিকশায় চেপে বসলো। তারা রিকশা করে প্রথমে গাবতলী যাবে। সেখান থেকে সিরাজগঞ্জ। সিরাজগঞ্জ পৌঁছে উল্লাপাড়ার বাস ধরবে। যখন রিকশায় উঠলো এবং রিকশা ছেড়ে দিল, আবর্জনাকলুষিত কালোরাস্তার দিকে তাকিয়ে রতন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত গভীর একটা বেদনা অনুভব করতে লাগলো—  আশপাশের জনসমাগমের দিকে তাকিয়ে, মানুষের কর্মব্যস্ত মুখ তার মনে আর একটি ছোট্ট মুখের ছবি মনে করিয়ে দিল। একটি সামান্য শিশুর করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করতে লাগল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হল, ‘ফিরে যাই, মাতৃ ক্রোড়বিচ্যুত সেই অবুঝের কাছে। তাকে দেখে রাখি’— কিন্তু তখন যানজট ছেড়ে রিকশা গতি পেয়েছে, বাসগুলো গতিতে পাশ কেটে চলে যাচ্ছে, মার্কেটগুলো অতিক্রম করে রাস্তার পাশে কবরস্থান দেখা দিয়েছে— এবং বাহনে চলমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হলো, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরে ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।

কিন্তু ঋভুর মনে কোনো তত্ত্ব জাগলো হলো না। সে ডে কেয়ার সেন্টারের ছোট কটে অশ্রুজলে ভেসে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বোধহয় তার মনে ক্ষীণ আশা জাগছিল, রতন যদি ফিরে আসে— হায় বুদ্ধিহীন শিশুহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করে মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বেঁধে বুকের ভেতরে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কেটে হৃদয়ের রক্ত শুষে সে পালায়, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়ার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠে।