প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

মাহমুদ শাওনের স্মৃতিগদ্য ‘আমাদের আড্ডারঙা দিন’

প্রকাশিত : মে ০৩, ২০২০

ছোট্ট অথচ কী সাজানো একটা শহর বগুড়া! সে শহরে কখনো কখনো রাত নামতো না। বিশেষত আমাদের কাছে, যখন সে রাত আড্ডারঙা হতো। সে আড্ডা পথে, ফুটপাতে, এলেবেলে। আজ আবার বহু বহু দিন পর বিবর্ণ ধুলোর আবরণ মুছে কী ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে! নয়ের দশকের মাঝামাঝি আমার, এমরান কবির ও অনন্ত সুজনের কাব্যযাত্রা শুরু হয়। আমাদের উন্মুল, উন্মত্ত কবিতার দিন ও রাতের সঙ্গগুলো ভাগাভাগি হতো আমাদের সাথেই। সে সময় সবচে বেশি আড্ডা হতো গল্পকার অরণ্য প্রভার (আমাদের আপলু ভাই) গালাপট্টিস্থ ‘এম আর কম্পিউটারস্’-এ।

খুবই বেদনার যে, আমাদের প্রিয় সেই আড্ডাস্থল ‘এম আর কম্পিউটারস্’ আর নাই। আপলু ভাইয়ের সে দোকান থেকেই বের হতো আমাদের কাগজগুলো। তার মধ্যে আমার সম্পাদনায় ‘সুতরাং’, অনন্ত সুজনের ‘সুবিল’, এমরান কবিরের ‘থার্ডম্যাগ’ উল্লেখযোগ্য। এর বাইরে কবি জয়ন্ত দেব সম্পাদিত ‘দ্যুতি’, ইসলাম রফিক সম্পাদিত ‘দোআঁশ’ ও অরণ্য প্রভার গল্পবিষয়ক কাগজ ‘পুন্ড্র’কেন্দ্রিক আমাদের লেখালেখি ও আড্ডা চলছিল সমান তালে। প্রথম দশকের আমার মতো কারও কারও কবিতা ছাপা হয়েছিল সরকার আশরাফ সম্পাদিত ‘নিসর্গ’ লিটলম্যাগে। ‘নিসর্গ’-তে লেখা ছিল আমাদের কাছে অনেক বেশি সম্মানের।

কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, এটা তখন এক ধরনের সমীহ জাগানো স্বীকৃতি ছিল আমাদের কাছে। যাহোক, তখন এম আর কম্পিউটারস্ এমন একটি জায়গা ছিল যে, কলেজ শেষ করে, কেউ টিউশনি থেকে ফেরার পথে, হঠাৎ চায়ের নেশা পেয়ে বসলে কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই যে কোনো সময় উপস্থিত হতেই হতো সেখানে। সেসব আড্ডায় সুজন ভাই, এমরান ভাই ও আমি ছাড়াও আমাদের সমসাময়িক সময়ের প্রয়াত শিল্পী-কবি লিটন সাহা, অনিন্দ্য আকাশ, চমৎকার ছড়াসাহিত্যের কাগজ ছন্দর সম্পাদক ইন্দ্রজিৎ সরকার, ঈশান সামী, প্রান্তিক অরণ্য, বিধান সাহা, তালাশ তালুকদার নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন।

কবিতা, গল্প, ছোটকাগজ, শাহবাগ, কলকাতা আর অগ্রজদের লেখা নিয়েই হতো যত আলাপ। কবি মামুন রশীদ মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে এসে যোগ হতেন। তবে তার বেশি বিচরণ ছিল বগুড়ার নয়ের দশকের কবিদের সাথে। আমাদের শহরের অগ্রজ কবিদের সান্নিধ্য আমরা পেয়েছি অনেক পরে। তবে কবি জয়ন্ত দেব ও ইসলাম রফিক ভাই বরাবরই খুবই স্নেহ করতেন আমাদের। কোনো একটি লেখা ভালো লাগলেই সেটা নিয়ে কথা বলতেন। আমাদের মতো অতিশয় তরুণদের কবিতা, মনে আছে, জয়ন্তদা অনেক যত্ন নিয়ে ছাপাতেন ‘দ্যুতি’তে। অগ্রজদের মধ্যে পরে কবি ফখরুল আহসান, শিবলী মোকতাদির ও আমীর খসরু স্বপন ভাইও কখনো কখনো আমাদের আড্ডায় যোগ দিতেন।

তবে কবি অমিত রেজা চৌধুরীভাইকে খুব একটা পাইনি আমরা। তবে এখন যারা লিখছে, তাদের সাথে প্রায়ই অমিত ভাইয়ের আড্ডার ছবি দেখি! কবি, ছোটকাগজ ‘বিপ্রতীক’ সম্পাদক প্রয়াত ফারুক সিদ্দিকী ভাইয়ের সান্নিধ্যও আমরা পেয়েছি। একেবারে সজ্জন, নিপাট ভদ্রলোক ফারুক ভাইয়ের বাসায়ও আমরা যেতাম। তার সংগ্রহে থাকা বই, ছোটকাগজে হাত বুলাতাম। কিন্তু নেয়ার অনুমতি ছিল না। একবার কবি ঈশান সামী এসে জানালো, ফারুক ভাইয়ের সংগ্রহের বই, পত্রিকার কিছু কিছু মাঝে মাঝে তার ছেলে পুরনো বইয়ের দোকানে বিক্রি করেন! তো, আমরা সেসবও কেনার অপেক্ষায় থাকতাম। আর একজন ছিলেন কবি-সম্পাদক-প্রদর্শক আন্ওয়ার আহমদ। তার জীবনের শেষ ৪ বছর (১৯৯৯ থেকে ২০০৩) কাটিয়েছিলেন আমাদের সাথেই, এম আর কম্পিউটারস্-এ। আমাদের আড্ডারঙা দিনের গল্প পূর্ণ হবে না তার ‘রূপম’ ও ‘কিছুধ্বনি’ পত্রিকার কথা উল্লেখ না করে।

‘সুতরাং’, ‘সুবিল’ ও ‘থার্ডম্যাগ’-এ আমরা লিখতাম আমাদের মতো করে। হোক তা ভুল বাক্যে, ভুল বানানে। আমরা মনে করতাম (এখনো করি), ভুল করতে করতেই একদিন অনেক ভুলে আমরা শুদ্ধ হব। যদি ‘শুদ্ধ’ না-ও হই, এ অশুদ্ধ জীবনের আনন্দও তো কম নয়! আমাদের সাহিত্যযাত্রা শুরুর দিনের আড্ডার মুখগুলো এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ফারুক ভাই, আন্ওয়ার ভাই পরপারে। আমার আড্ডার শহর বগুড়া এখন কেমন আছে?