মায়ামি

সজীব দে

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৫

স্বপ্নের যুগে মায়ামি যখন অভিসারের ফুল কুড়াতে যেত, সেদিন সে ভারত সাগরের উপকণ্ঠে কুঁড়েঘরে বাতাবি লেবুর সুবাস নিয়ে শুয়ে থাকতো। গোধূলির গোলকধাঁধায় মায়ামি ধ্যানরত। সাগরের উপকণ্ঠের লোকজন মনে করে, এই নারীটিই তাদের সাগরদেবি। ওই সময়ে উপকণ্ঠের লোকজন ফলফুল নিয়ে এসে বাইরে অপেক্ষা করত, কখন দেবির ঘুম ভাঙবে। কিন্তু মায়ামির ধ্যান ভাঙে না দেখে লোকজন হতাশ হয়ে কুঁড়েঘরের সামনে ঘুমিয়ে পড়ত।

একশো বছর যখন পার হয়ে যায়, অনেক মানুষ তখন মারা যায়। আর মায়ামির ধ্যান শেষ হলে সে দ্যাখে, হাজারও মানুষের কংকাল তার ঘরের বাইরে পড়ে আছে। তবে ফুলগুলো আগের মতোই তাজা। মায়ামি ঘর থেকে বের হয়ে এলে একটা ভোর মাত্র শেষ হয়। ভোরটা মায়ামির কাছে মনে হয় সমুদ্রের জলের মতো নীল। আর নতুন প্রজন্মের মানুষগুলো নীল মায়ামিকে দ্যাখে। সবল পুরষগুলো তাকে পাবার জন্য যুদ্ধ শুরু করে দ্যায়। যুদ্ধটি পাঁচ বছর ধরে চলে। এ যুদ্ধটাকে ইতিহাসবিদ সুধানন্দ নাম দেন মায়ামির যুদ্ধ। আপনারা হয়ত অনেকেই সুধানন্দের এ বইটি পড়ে থাকবেন।

এ যুদ্ধ প্রায় এক লাখ পুরুষ মারা যায়। আর নারীগুলো পুরুষহারা হয়ে মায়ামিকে অভিশাপ দ্যায়, তার মৃত্যু হবে ভয়ংকর এক সাপের দংশনে। অথচ যেদিন সাপটি মায়ামির কুঁড়েতে ঢোকে, তখন মায়াবি ডাবের জলে স্নান করছিল। সাপটি তন্ময় হয়ে মায়ামিকে দ্যাখে। সাপটির দিকে মায়ামির চোখ যায়। সাপটি তখন অবনত স্বরে বলে, এই সাগরের উপকণ্ঠের নারীদের প্রার্থনায় আমি তোমাকে দংশন করতে এসেছি।
মায়ামি বলে, আমি তোমার জন্যই এতসবের আয়োজন করেছি। এই যুদ্ধ, লাখ লাখ পুরুষের মৃত্যু, কংকাল সবকিছু তোমার অপেক্ষায়। এবার তুমি তোমার রূপ ধারণ করো।
সাপটি তখন ধীরে ধীরে তার খোলস খুলে ফেলল।
মায়ামি বলল, এবার পুরুষ হও।
সাপটি বলল, আমি কৃষ্ণ।

মায়ামি বলে, আমি জানি। তোমার হাজারও সখি ও রাধা সবাই আমার ধ্যানের কাছে পরাজিত হয়েছে। তুমি আজ আমার একান্ত পুরুষ।
কৃষ্ণ বলে, তুমি এমনটা কেন করলে?
আমি যখন জন্ম নিই, আমার মা বলেছিল, তোর জন্য একটা যুদ্ধ হবে। তুই মানুষ, কোনো দেবি না। পৃথিবীতে এমন যুদ্ধ আর কোনো নারীর জন্য হবে না। তোর কোনো দৈব শক্তিও নেই। আমাকে যা দেখছ, তা একান্তই আমি। আমার ভেতর অনেক সুর তৈরি হয়েছে। তুমি যে বাঁশি বাজাও, সেসব সুরই আমার কাছ থেকে পেয়েছ। আর পৃথিবীতে ধ্রুপদী যে সুর শুরু হবে, তাও আমারই।
মায়ামি বলে, পৃথিবীতে এ সুরই মানুষকে সুন্দর করে তুলবে। এজন্য একটা যুদ্ধ কিছু নয়।

শুনে কৃষ্ণ অবাক হয়। মায়ামীর পায়ের কাছে এসে বসে। বলে, চলো, তোমাকে স্বর্গে নিয়ে যাই।
আমি তো স্বর্গ বিশ্বাস করি না। আর তুমি তো মায়া। তোমার তো কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু আমার অস্তিত্ব তোমাকে তৈরি করেছে।
তবে উপকণ্ঠের নারীদের কী হবে? ওরা তো পুরুষ ছাড়া।
ওরা সবাই পুরুষের খোঁজে অন্যত্র চলে যাবে।
আর তুমি?
কেবলমাত্র একটা গল্পই প্রতিদিনের গল্প হয়ে যাবে। মানুষগুলো ওইসব গল্পই লিখবে। সাধারণ মানুষ পড়বে, তাদের কল্পনা বাড়বে। ওরা সুন্দর হয়ে উঠবে। তখন আর কোনো যুদ্ধ হবে না। মানুষ থেকে যাবে।
কৃষ্ণ বলে, তোমার হাতটা দাও।
এ হাত তো তোমার জন্য নয় কৃষ্ণ।
তবে?
এ হাত-বুক-যোনি গোধূলির সাথে মিলিত হবে। এবার তুমি ফিরে যাও।
তবে আমাকে কেন আহ্বান করলে?
এ প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।

কৃষ্ণের মন খারাপ হয়ে গেল। বলল, একটা বেলিফুলের নৈবেদ্য অন্তত দিতে দাও।
আচ্ছা দাও।
কৃষ্ণ একটা বেলিফুল মায়ামির পায়ের কাছে রাখে। মায়ামি বলে, এবার তুমি যাও। আমাকেও গোধূলির কাছে যেতে হবে।
কৃষ্ণ ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নারীগুলো এদৃশ্য দ্যাখে। উপকণ্ঠের নারীদের সুখে গান শুরু হয়ে যায়। কৃষ্ণ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। আর নারীরা তার পিছু পিছু গান গাইতে গাইতে সাগরের কাছে এসে থামে। তখন ভোর। নারীরা আবার কুঁড়ের সামনে আসে। কিন্তু তারা মায়ামিকে দেখতে পায় না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক