অলঙ্করণ: সারাজাত সৌম
মিছিল খন্দকারের বাছাই ২৫ কবিতা
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৮
মায়ের কবর
গাঢ় শীতরাতে আমি কবরস্থানের দিকে বয়ে যেতে থাকি।
ভাবি, যে কোনো ভাঙা কবরে ঢুকে দেব নিরীহ ঘুম,
কিংবা আদতে ঘুমাতে পারি কিনা; দেখি।
পথে ভাবনার দিক বদলায়।
আর পরিজন হাওয়া— কেমন ঠাণ্ডা হাত তার,
যেন ইয়ার্কি করে তার ভেজা হিম করতল
শরীরে ঢুকিয়ে দেয়।
গাছে গাছে শরশর করে ওঠে পাতা।
এসব গাছ সব মৃতদের সুহৃদ
কবরের আশপাশে সন্ত ভূমিকায় দাঁড়ানো।
যে কোনো কবরের পাশে গাছের লাইনে দাঁড়িয়ে আমি
পাঠ করি নিজের কিংবা পছন্দসই যে কারও কবিতা।
কার যে কলধ্বনি আমার ভেতরে তখন হু হু করে বাজে,
সামান্য পরিচিত লাগে কিংবা লাগে না,
নাকি বাতাসের কারসাজি
দূরাগত যে কোনো সংকেত?
যে কোনো কবরকে আমার আসলে
মায়ের কবর মনে হয়!
মৃত্যুর পরে লেখা
নিজের কবর আমি নিজেই খুঁড়েছিরে মিথুন।
আর শরীরে আগুন ধরিয়ে তাতে
ঢুকে পড়েছি,
শীতে মানুষ যেভাবে ঢোকে লেপের ভেতরে।
তখন হয়তো শ্রাবণ মাসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে
জলে ও পিতলে, গির্জার ঘণ্টাধ্বনিতে,
সাবলীল সন্ধ্যার টিনে,
বর্ষার আঁচে গলে যাওয়া উঠানে,
ভেসে ওঠা আনত কোনো গ্রামে।
পানিতে পূর্ণিমা চাঁদ খুটে খাচ্ছে মাছ,
বৃষ্টির তবলা ধ্বনি মিশে যাচ্ছে মোয়াজ্জিনের আজানে।
আর এদিকে, অভ্যাসবশত বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে
জ্বর বাধিয়েছে আমার কংকাল।
আমাদের জাগতিক স্মৃতি জ্বলে উঠছে
মেঘের মলাটে, বিদ্যুতে।
জীবনের ঝাল হাসছে
বজ্রপাতের নিনাদে।
তখন অত রাতে,
বৃষ্টিতে একা একা তুই বোকা
কী করছিস ছাদে!
দুঃখ থেকে সটকে পড়ার কৌশল
যে কোনো মেঘলা সন্ধ্যায় আমি পৃথিবীর সব থেকে দুঃখী কবিতাটি লিখব নিশ্চিত! যা পাঠে বৃক্ষরা বনভূমি ছেড়ে ছ’মাইল হেঁটে এসে উঁকি দেবে, কবির তন্দ্রাভুখ জানালায়। দুঃখকে জলের খনি ভেবে শুকনো নদীরাও ছুটবে, হৃত যৌবন পুনরুদ্ধারের আশায়। সমুদ্র পা টিপে এসে ঠাঁয় বসে থাকবে অদূরে; দরজার কাছে। চাটগাঁয়ের ছোট ছোট টিলা, রাঙামাটি ও বান্দরবানের পাহাড়— এ খবরে দ্রুত রওনা হবে বাসে।
চাঁদ এসে বসবে উড়ে বারান্দার গ্রিলে। প্রিয় সব বন্ধুরা দুঃখকে বদপাখি ভেবে, তাড়িয়ে দিতে চাইবে ঢিলে। এবং দুঃখ দেখতে দলে দলে উৎসুক নারীর দঙ্গল এসে, উঁকি মারবে বাড়ির পাঁচিলে।
আমি তখন দুঃখ রেখে ফাঁক বুঝে সটকে পড়ব, এত সবের মিছিলে।
হৃৎপিণ্ড
যতটা নীল ভাব, ততটা নীল নয়
কিছুটা বিভ্রম, চোখেতো লেগে রয়।
দূরেরও চাওয়া থাকে, দেখবে কাছ থেকে
অতটা বাঁকা নয়, যতটা গেছি বেঁকে।
সে ভালো বেঁকে যাওয়া, বৃত্ত হতে গেলে
ঘুরব চারপাশে, কেন্দ্রে তাকে পেলে।
সে ঠিক আমি নয়, আমিও নয় সে
এ টান চোরাটান, বুঝেছি বয়সে।
যা দেখি আসলে তো সবটা দেখা নয়
আমি যা ঠিক দেখি, তার তা ভুল হয়।
ভুলকে ভুল বলা, কতটা ভুল-ঠিক?
আমার গভীরে সে চলছে টিকটিক।
বায়বীয় ছায়া
আমাদের বাগানের স্কুলে
যে সব সুদর্শন গাছ
দুই যুগ ধরে
শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত—
পুকুরের আয়নায় তাদের ছায়া
বাতাসে যখন দোল খায়;
অবাক চোখে তাকায় মাছেরা
ছায়ার রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে—
প্রকৃত অর্থে, গাছকে তখন তারা
বায়বীয় ছায়া মনে করে!
নৌকা
মাকে আমার আদতেই
এক শব্দের বিচ্ছিন্ন বকুল ফুল
মনে হয়নি।
যেমন বাবাকে
মনে হয় না
সাঁকোহীন মায়ের ওপাড়।
বরঞ্চ তাদের দুজনকে মিলেই
আমার মনে হয়েছে
একটা নৌকা—
মা যার ছই আবৃত পাটাতন ও গলুই
বাবা যার পাল এবং বৈঠা।
মন খারাপ
সুহৃদ তুলসী পাতা, লেবু ফুল
বারান্দায় ঢুকে পড়া ঘ্রাণ,
নির্ভুল বাতাসে ঝরা আমলকি —
কেউই মানো বা না মানো,
নিশ্চয়ই কোথাও মানুষ
খুব কষ্টে আছে,
না হলে আজ আমার এত
মন খারাপ হবে কেন!
সম্পর্কের মিথ
যার সাথে যার মেলে,
তার সাথে তার দেখা হয়
কদাচিৎ!
বাড়ি ফেরা
তারপর
সরের মতোন ছড়িয়ে পড়বে রোদ।
বিনা বাক্য ব্যয়ে ভোর কাঁচুলি খুলে দেবে,
নামাজ ফেরত মুসল্লিরা দেখার চেষ্টা করবে
আমি আদতেই সেই আমি কিনা।
চকিত সালাম বিনিময়ে
তাদের উৎসুক দৃষ্টির সুরাহা না করে,
প্রকৃত কাঙ্ক্ষার নিকটে পৌঁছে গেলে
আমার আভাস
রিকশার টুংটাঙে কড়া নাড়ার আগেই,
অভ্যস্ত হাতে
খুলে যাবে পরিচিত দরজার কবাট।
ও পাশের প্রতীক্ষিত মুখে তখন শিশুর বিস্ময়!
যেন আমি না জানিয়েই এসেছি চলে
সেই খুশিতে মুখে নেই কোনো রা!
অথচ সে জানতই—
সকালের প্রথম কড়া নাড়াটা হবে কার।
আব্বা, আমাকে তখন বাবা মনে হবে আপনার!
জীবন
অধরা মণির লোভে
যে নিয়েছে ঠোঁটে তুলে
সাপুড়ের বীণ,
তার কাছে জীবন আসলে কঠিন।
প্রদীপ নিভায়ে দিয়ে
কোথায় পালাল আলাদিন!
বেড়াতে গিয়ে সৈকতে
শখবশে কুড়িয়ে ঝিনুক,
যে পেয়েছে মুক্তার খোঁজ
তার কাছে জীবন আসলে সহজ।
খরাদগ্ধ মুখ
১.
কৃষাণির কুলা হাতে
ধান থেকে উড়িয়ে দিতে দেখেছি চিটা।
চিটার মর্মমূলে কোন সে ব্যথা
কার দোষে
মাটিতে লুটালে মন টের পাবে কি?
তুমিও তো মাটির সন্তান।
কুটিলতা বড় ভয় পাই,
যুবা বয়সী আধাপাকা বুদ্ধিতে।
সরলের সংজ্ঞা খুঁজি
ও সরল, কীভাবে বুঝব তুমি কে?
তবে কি ফিরে যেতে হবে শৈশবে,
সুপারির খোলে চড়ে?
কে তবে টেনে টেনে নেবে?
খোল তো গাছের দান, যন্ত্রে চলে না।
আর শৈশব—
একটা স্মৃতি ছাড়া সবই বিস্মৃত।
সেটা বড় ভয়ানক!
তখনও মাছ হতে শিখিনি
কেননা জানি না সাঁতার।
নৌকায় চড়েছি দুজন—
বন্ধু আর আমি,
যখন মাঝনদীতে
দেখি, নৌকা ফুটা
যত সেঁচি তারও চেয়ে বেশি ওঠে পানি!
সে যাত্রায় কীভাবে বেঁচেছি
তা আজ বাদ থাক।
শুধু বলি—
ইদানীং সে রকম ভয়ানক আতঙ্ক নিয়ে চলি!
কেনইবা নয়,
যতটা জেনেছি তাতে
পাঁজরের ইঁদুরে কাটে
প্রত্যেকের নিজস্ব হৃদয়!
(পাদটীকা:
আমার সে বন্ধু এখন
আস্ত মৃগেল,
চাতুর্যও শিখেছে ঢের!
প্রায়শই বলে শুনি,
মাছ হলে হতে হয়
গভীর জলের।)
২.
অগ্নি উদ্গীরণ কালে
কোনো অগ্নিগিরির জ্বালামুখে,
বৃত্তাকার পরিভ্রমণ করে
হিংস্র-কুটিল লাভায় হয়েছি উজ্জ্বল।
আমার দারুণ অভিলাষ
তোমাকে দেখাই এই মুখ,
কতটা প্রাত সূর্যের মতো লাল!
পরিশিষ্ট সময়ে সে আগুন
চর্ম-মাংস খুলে
আমাকে করেছে নরকংকাল।
এবার হাড়ের ঝংকারে
দীর্ঘপথ পদব্রজের শেষে
যদি তোমার,
তোমাদের নিকটে ফিরে আসি,
তুমি বা তোমরাও তো চিনবে না।
আঁতকে উঠবে, ভূত! ভূত!!
তবে কি আমার স্বতন্ত্র পরিচয়
ডাকাতি করবে অগ্নিগিরি?
তুমিই তো প্রকৃত সুহৃদ, রে নারী!
কতবার তুলেছো আলতো
আদিবাসী ঘুম থেকে,
টেনে নিয়েছ আরণ্যিক প্রেমে।
অনাহূত মেঘে হারিয়ে গেলে চাঁদের চেরাগ,
ছুঁয়ে ছুঁয়ে চিনেছ সঠিক!
যে সময় আমাকে ঠেলে দিয়েছে আগুনে
করেছে গোত্রহীন,
তুমিতো নও তার দলে, প্রতিনিধি।
তাই বলি—
যে কোনো প্রবাহে নিকটে ফিরে এলে
পাশে দাঁড়িও।
সময়কে বিবাদী করে
নিয়ো মামলার প্রস্তুতি।
আর একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে জেনে নিয়ো,
রক্ত-মাংসজুড়ে করে দিতে পারবে কি না সার্জারি!
ঢেঁকি
নিশাকে
নদীর ঢেউকে আমরা তবলার আত্মীয় বলে
স্বীকৃতি দিতে সম্মত হলাম।
পাখির গান শুনতে ছুটলাম স্মৃতিতে।
ঘাতকের দুঃখের মতো ভালোবাসলাম বাঁশিকে।
নীরবতাকে ঈর্ষা করলাম শত্রুর খ্যাতির মতো।
সন্ধ্যার বিষণ্ণতাকে পাঠাতে চাইলাম নরকে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল।
আর মেঘলা ঘরে মনে হচ্ছিল আমি আজন্ম বধির।
অথচ তার বুকের ঢেঁকির পাড়
শুনতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট।
যেন মৌসুমের সব ধান
চাল হয়ে উঠবে বলে
পণ করে
ওই বুকের মধ্যে ঢুকে পড়েছে,
দূর করতে নানা পৃথিবীর অনাহার!
পারাপারহীন সাঁকো
ফুলের বাগানে এত এত ফুল ফোটে
আমার তো তবু লাগছে না ভালো মোটে।
চারপাশ থেকে প্রাণ ধরে টানে কারা?
কিন্তু বিকেলে নিসঙ্গ ছিল পাড়া!
কেউ যেন ডাকে, ইশারায় বলে, আয়।
যাব কিনা ভাবি, অন্যরা চলে যায়।
কে যে ফিসফিস, কার সাথে করে রতি!
জামগাছ হলো শিরিষ গাছের পতি।
চাকা পাংচার, থেমে আছে গাড়ি মোড়ে—
কার ছেঁড়া ঘুড়ি ভিনছাদে গিয়ে ওড়ে!
ছিঁড়ে ফেলা চিঠি বাতাসে উড়ছে, দেখি—
কোন বুকে ধান ভেনে চলে কার ঢেঁকি!
ঘরে নেই সাড়া, ঝুলে আছে তালা দ্বারে—
সবাই কয়েদি, সকলেই কারাগারে।
মৌচাক থেকে মধু নিয়ে যাও তুলে,
রেখে আসো মাছি সেইসব ফুলে ফুলে।
আ-মরি কবিতা
কী যে সমীরণ, বাঁকা বায়ু বয়, আহা!
যাহাই কুহেলী, কুয়াশাও নাকি তাহা!
সতত সে তপে; ভ্রান্তি-ছলনে ফেলে
যেন মোরা কোনো সাগরদাঁড়ির ছেলে!
আজি শ্যাম হিয়া উথলি পরানে মেশে
জোড়াসাঁকো থেকে বজরা এসেছে ভেসে?
রণে যবে মম ক্লান্ত বাঁশরি দেখো,
একা পড়ে আছি আসানসোলের সাঁকো।
ঢের দিন হায় কাটিয়ে চিলের দলে
হয়তো মরব যে কোনো ট্রামের তলে!
সম্মুখে হেরি মাস্তুলে পাঞ্জেরি—
শীতে-কুয়াশায় নোঙরে রয়েছে ফেরি।
নাঙা পদধ্বনি, দিগন্তে চলে উট—
ধ্বস্ত নীলিমা লিখে গেছে চিরকুট।
ওদিকে আয়শা মক্তব থেকে ফেরে
চুল খোলা রোদে ঘাঁই মারে মাছ ঘেরে।
যে স্মিত দৃশ্যে রক্তিম হলে ফল,
রসালো ভুট্টা বসে পড়ে চঞ্চল।
দুপুর নীরবে তাকায় হালিক টোনে
‘নাও, মেগ খাও’, বলে কালিদাস ফোনে।
আমি কিনা সব খুঁটিয়ে খাওয়ার কূলে—
প্যারাসুট তেল মাখি কুন্তলে-চুলে।
বিপন্নতা তাড়া করে
জীবনানন্দ দাশকে
আকাশ মেঘহীন, নীলাভ হয়ে আছে
সোনালি ডানা মনে করে,
দুপুর ধীর পায়ে— খাঁ খাঁ খাঁ প্রান্তর
হাওয়ার অভিঘাতে নড়ে।
হৃদয় খোঁড়ে কারা? পায় না খুঁজে কিছু—
ব্যথা-বেদনার গা ঘেঁষে!
কোথাও কেউ নেই, মধ্যে না থাকার
শালিক একজোড়া এসে—
আবার উড়ে যায়। কোথাও পুড়ে যায়
মাঠের শরীরের খড়,
পাতারা সরসর বাতাসে কাঁপে আর
অপরিচিত কোনো স্বর।
দৃষ্টি থেকে দূরে, চালতা গাছে ঠেস
একাকী বসে কেউ তবে—
বছর কুড়ি কুড়ি, চলে তো গেছে বহু
কে আর মুখোমুখি হবে!
ধূসর সন্ধ্যায়, তাহার দেখা পেলে
সাভার রাস্তার পাশে
সে যদি শোনে তবে, কিংবা না-ই শোনে
না বলা কথা ভেবে হাসে।
তাকে কি বলা যায়? বলব, ভাইসাব
বিপন্নতা তাড়া করে—
ভাবছি যাব কি না, যে কোনো কলকাতা
ট্রামের তলে পড়ে মরে!
ভাঙাবাড়ি
পুরনো বাড়ির জীর্ণ দেয়ালে
ইট দিয়ে লেখা ‘পাখি’।
কারো পোষা ছিল? ছেঁড়া ঘটনায়
উড়ে গিয়েছিল নাকি?
তার পাশে যোগ চিহ্নের পর
‘মিনার’ লেখার শেষে
ছোবলের ভয় ফনা তুলে আছে
প্রশ্নবোধকে এসে।
কবে এক পাখি কোন মিনারের
চূড়ায় বসিয়া যেন
উড়ে-পুড়ে গেছে, দূরে দূরে গেছে—
জানা যাবে না তো, কেন!
তার বিষাদের চিহ্ন বহন
করা দেয়ালের পেটে,
জন্ম নিয়েছে নামহীন গাছ
ইট আর কংক্রিটে।
বাম দিকে এক বন্ধ জানলা
একপাশে নেই কাচ,
বাতাসে বাতাসে ফোকরের মুখে
উঁকি দেয় সেই গাছ।
কার খোঁজে তার আঁধার কক্ষে
নিয়মিত রাখা চোখ—
ঘরে কেউ নেই, না থাকা জুড়িয়া
ডেকে ওঠে তক্ষক।
বাপের টাই
সারাটা দিন মানুষজনে ঠাসা
বাসটা মধ্যরাতে ফাঁকা ফেরে,
গাছপালারা বলছে, না না একি
বাতাস রোজ নিচ্ছে ঘুম কেড়ে!
হাঁটতে থাকা পথের অতিথিরা
গানের সাথে যাচ্ছে চলে মেসে,
হাসপাতালে রোগীর আত্মীয়
জানলা দিয়ে দেখতে তাকিয়েছে।
পর্দা টেনে লুঙ্গি পরা লোক
নিজ নারীকে বুকের কাছে ডাকে,
বিছানাজুড়ে তাদের আলোড়ন
অন্য ছাদে কেউ দেখতে থাকে।
নির্বিকার টহল পুলিশেরা
খুঁজছে কোনো দোকান খোলা কি না—
আস্তে-ধীরে চলতে থাকা পৌঢ়
থুথুর সাথে ছিটকে ফেলে ঘৃণা।
মাঝ পুকুরে ঘুম না আসা মাছ
ঘাঁই মারায়ে জানাতে চায় কিছু?
নিজের মতো হাঁটতে গিয়ে পথে
তিনটা দেশি কুকুর নেয় পিছু।
চার ভাইয়েতে ঘুরতে থাকি ক্রমে
সড়ক রেখে গলিতে ঢুকে যাই,
ফাঁস নেওয়ার ভাবনা থেকে রোজ
পকেটে নিয়ে ঘুরি বাপের টাই।
বহুমাত্রিক কলহ
ভরা কলসি, খালি কলসি
ভরা কলসি খালি—
ফ্যাসাদ ডেকে মীমাংসা তা
করুক বনমালী।
অসীম হতে নদীর স্রোত
খেয়ে ফেলছে পাড়,
দুই বলছে, দুইয়ের সাথে
হবে না আর চার।
পথ নাখোশ সাঁকোর সাথে
পথের সাথে সাঁকো
আমি বলছি, কী দরকার—
একত্রিত থাকো।
এক বিছানা বাধ সাধলে
স্বভাব দোষে-গুণে;
দেয়াল বলে, ভাবনা থেকে
ফেলছি কথা শুনে।
চোরের সাথে পাহারাদার
নাঙের সাথে স্বামী,
বৃক্ষ ভাবে, হারামজাদা
পক্ষী বহুগামী।
বৈশাখের দুপুরে বাগানে গাছেদের কাণ্ডকারখানা
সমুদ্র থেকে বহুপথ পাড়ি দিয়া
এসছেন কি না যৌনকাতর হাওয়া,
পাতায় পাতায় জাগছে উত্তেজনা
এক গাছ ভাবে তার বুঝি আজ বিয়া।
ফলে সোনালুর গায়ে হলুদের দিনে
ফুরফুরা থাকে জামরুল গাছ পাশে—
বিবাহবিমুখ শিরিষের বিদ্রুপ,
ঢঙ ছাড় মাগী; টের পাবি চৈত মাসে।
বন্ধ্যা তালের মাথাব্যথা নাই তাতে
আকাশের দিকে তাকায়ে দেখছে মেঘ,
সুপারি গাছটা মাতাল চিত্তে দোলে
যেন তিনি আজ গিলছেন সাত পেগ।
বিধবা আমের আগ্রহহীন মুখ
তথাপি বাতাসে দেহ করে শিরশির,
চুপে; দূর থেকে দেখে স্বভাবের দোষে
ঘরসংসার ভাঙল রেইনট্রির।
ক্রেজি পারাবার
বিনয় মজুমদারের প্রতি
আরো ভোর হয়ে আসে প্রাইভেটকারে
সাগরে বেড়াতে গিয়ে ঘুরি পাড়ে পাড়ে।
চেয়ে দেখি কাছে এসে দূরে ছোটে পানি,
কোন ঢেউ রাজা আর কোনটা যে রানি!
কোথায় টোথায় যায় জেলে ও ট্রলার!
রাতে ভালো শোনা যায় সাগরের গলা।
তাগড়া স্রোতের টান রক মেটালের—
চারপাশে নীল নীল পানির আখের।
তারা থৈ থৈ করে আর ওঠে, নামে, ওঠে
ভয়ে কাকে যে জরায়ে ধরি স্পিডবোটে!
বোটের ঠোঁটের কাছে প্রকৃত সারস,
মানুষ নিকটে তুই কিছুক্ষণ বস।
দুলে দুলে দেখ, আয়, শোন শীৎকার—
কার সাথে সেক্স করে ক্রেজি পারাবার!
বর
তাহলে আংশিক হৃদ্যতা রেখে
দৃশ্যত ফিরে যাওয়া—
যেভাবে বন্ধুর মুখ
সন্দেহে
অংশত শত্রুর ছায়া হয়ে ভাসে
ঋতুর প্রবাহে।
বেল বাজাচ্ছে হেমন্ত,
আলগোছে পথ করে দিচ্ছে
শরতের কাশবন।
একটা ছোট্ট পুতুল তাও
আকাঙক্ষায় বসে আছে সোকেসে নীরব।
তাকে যাও, নিয়ে যাও
আংশিক ধবধবে বনে—
হৃদয়ে বিবাহ এলে বর জেনে নেবে।
অ্যালার্ম ঘড়ি
একদিন নিজের পানীয়ে মিশিয়ে রাখব বিষ; কৌশলে।
তারপর ভুলে যাব। ঘণ্টাখানেক বসব বারান্দায়।
আধখাওয়া পাউরুটি ঘিরে
পিঁপড়ার হামাগুড়ি দেখতে দেখতে
বিতৃষ্ণায়
পিপাসা নাড়বে কড়া।
তখন কোজাগরী।
নদীতে ঝুঁকে দেখে নেবে নিজ মুখ
চন্দ্রকুসুম।
বাড়ির নিকটে এসে নাম ধরে চিৎকার করবে ঢেউ।
ঘুমের মধ্যে শব্দ করবে কারো রুগ্ন ফুসফুস।
হিম হাওয়ায় শীতে কাঁপতে থাকবে জানালার পর্দা।
মসজিদের মাইকে ‘আল্লাহু আকবর’ বাজতে বাজতে
উধাও হবে বিদ্যুৎ—
ডানা নিয়ে হাজির হবে নিস্তব্ধ সুবেহ সাদিক!
আহা ভোর! ডাকতে থাকবে অ্যালার্ম ঘড়ি!
কথা বলো তার সাথে
নোঙর করে রাখা একা এক বালুর জাহাজ
কী প্রত্যাশা করে তোমার কাছে;
সন্ধ্যায়—
যখন নদীতে হাহাকারের মতো কুয়াশা নেমে আসে।
একটা গাঙচিল ডানা না ভিজিয়েই
নদীর পানি ঘেঁষে
ঠিক সমান্তরালভাবে উড়ে যায়।
অথবা সে যায় না কোথাও,
ফিরে আসে।
যখন মাগরিবের আজানকেও
মোয়াজ্জিনের নিরুপায় কান্নাধ্বনি মনে হয়।
বিদ্যুতের সুইচ টিপে হতাশ হয়ে
কাঁপা কাঁপা হাতে মোম ধরায় আমাদের মা।
আর এক বন্ধুর নির্জন সেলুনে বসে
পুরনো পত্রিকা পড়ে
গ্রাজুয়েট বেকার বন্ধুটা।
পেটে প্রেমিকের অযাচিত ভ্রুণ নিয়ে
তোমার পছন্দ যখন
বর্ষাকবলিত চোখে
ছাদে বসে গোপন সুরাহা খোঁজে।
তখন তুমি যাও—
গিয়ে বসো ওই বালুর জাহাজে
পা ঠুকে ঠুকে মৃদু, কথা বলো তার সাথে।
সে চায় তোমাকে
পাড়ের প্রসঙ্গে শোনাতে।
যেভাবে সন্ধ্যা আসে গ্রামে
নদীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সব গ্রামেই
একটা মীরা বাড়ি থাকে।
যে বাড়ির পেছনে
গাছের দঙ্গল ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকে
একা, আচানক তেঁতুল গাছ।
গাছটার শরীর ঘেঁষে বসা গোলাকার পুকুরের
কোমর ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে
কয়েকটা শেকড়।
প্রতি সন্ধ্যায়
সেইসব অজগর শেকড়ের পেটে
আলগা হয়ে ঝুঁকে,
ওজু করেন
কোনো এক আয়নাল মীর।
এরপর ধীর পায়ে ক্রমে তিনি যান
বাড়ির দরজায়। মসজিদের পাশে দাঁড়ান।
ফলে তার কণ্ঠে বেজে ওঠে মাগরিবের আজান।
আর সেই রাতের ঘোষণা শুনে
আকাশে আসেন ভগ্নস্বাস্থ্য চাঁদ,
গ্রামের দিকে অন্ধকার আসে তেড়ে।
মাঠে খেলতে যাওয়া বাচ্চাকাচ্চারা
সন্ধ্যা নিয়ে লোফালুফি করতে করতে ফেরে বাড়ি।
যাই
তাহলে যাই—
বাগানে গানের সাথে ঘুরি,
হাওয়ার শুশ্রুষা নিই শিহরণজুড়ে।
ঢাল বেয়ে নামার আগে
ভাঁজ করে সাথে রাখি হাসি।
নির্বিরোধ পুষ্পল সে গাছের ছায়ায় গিয়ে বসি,
বসে থাকি।
মিছিল খন্দকার
জন্ম: ২০ ডিসেম্বর, ১৯৮৫
খেজুরা, ভরপাশা
বাকেরগঞ্জ, বরিশাল।
প্রকাশিত বই:
মেঘ সামান্য হাসো (২০১৫, ঐতিহ্য)
পুষ্প আপনার জন্য ফোটে (২০১৮, জেব্রাক্রসিং)