মিথিলা (ফাইল ছবি)

মিথিলা (ফাইল ছবি)

মিথিলাকে কেন স্যালুট দিতে হবে

শামীমা জামান

প্রকাশিত : নভেম্বর ১০, ২০১৯

আবরারদের অপমৃত্যু, জাবির রণক্ষেত্র, নারী আইনজীবীর উপর নির্মম নিপীড়ন, খুন, ধর্ষণ— শত শত মর্মান্তিক বর্বর ঘটনা চলমান থাকলেও দেশ তথা সোশ্যাল মিডিয়া হামলে পড়েছে এক অভিনেত্রী আরেক পরিচালকের অন্তরঙ্গ ছবির উপর। হবারই কথা। আদিরস বলে কথা! যৌন অবদমিত জাতি এই আলাপের মাঝে সুড়সুড়ি খুঁজবে, এটাই স্বাভাবিক। তার উপরে অভিনেত্রী মিথিলার ছিল গায়ক তাহসানের সাথে অভিনয় ও বাস্তব জুড়ে আদর্শ শাবানা-আলমগীর জুটি ইমেজ। মেড ফর ইচ আদার ইমেজ। সেই জুটির বিচ্ছেদে ভক্তরা শাহবাগে দাঁড়িয়ে আন্দোলনও করেছিল তাদের বিচ্ছেদকে মেনে নিতে না পেরে। গতানুগতিক বিচ্ছেদ পরবর্তী নোংরামি কাদা ছোড়াছুড়ি, একে অপরের প্রতি কোনও অভিযোগ না করে তাহসান-মিথিলা সুধী মহলে একটা ভদ্র ইমেজও দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। যা কিনা যে কোনও বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে অনুকরণীয় বিষয়। সম্পর্ক ভেঙে গেলেও সন্তানের মা বা বাবা হিসেবে একে অপরকে শ্রদ্ধার জায়গায় রাখা। এই চর্চাটা চললে বিচ্ছেদ পরবর্তী সোশ্যাল ফোবিয়াগুলো কমে আসতো।

উপরন্তু  মিথিলার নিষ্পাপ চেহারা, শালীন পোশাক (বিচ্ছেদের আগে তাকে আবেদনময়ী রূপে দেখা যায়নি) সর্বোপরি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, ভদ্রতা— এসব মিলিয়ে আমজনতা তাকে একটা দেবিরূপে কল্পনায় বসিয়ে ফেলেছে। সে দেবি তার পতিদেবতা ছাড়া আর কারো হতে পারে না। তো দেবিকে যখন তার ভক্তরা দেখলেন শাড়ি পরা লক্ষ্মীমন্ত বধূটি হাঁটুতে অন্তর্বাস ঝুলিয়ে পটি করার ভঙ্গিমায় কমোডে বসে সেলফি তুলছেন, মার্জিত শাড়ির পাড় দিয়ে আগলে রাখা রহস্যময় পাহাড় পর্বত অতি সুলভে উন্মুক্ত। যেন নাইলনের দুটি গোলাপি ডেজার্ট চামচে কোনোক্রমে যৌবন তুলে নিয়ে...! ব্যাস, চোখ কপালে উঠে গেল সবার। বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে আশি পার্সেন্ট মেয়েরা হিজাব আবৃত থাকলেও মিডিয়ার কিছু মেয়ে তো পশ্চিমে অবস্থান করে পোশাকে। এরকম উন্মুক্ত ক্লিভেজ তো এখন মিডিয়ায় ডালভাত। বিকিনি পরা পিয়া জান্নাতুল বা নায়লা নাঈমের প্রায় নগ্ন ছবির নিচে কিন্তু আজকাল সমালোচনার চেয়ে বাহবাই বেশি দেখা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্য ভদ্র ইমেজের আদর্শ নারী মিথিলার নগ্ন শরীরের অপর পাশের বনমানুষটিও অনেকখানি প্রভাবিত করেছে আমজনতার গোস্বাকে।

মাত্র কিছুদিন আগেই ‘কে হবে মাসুদ রানার’ কর্কশ বিচারককে পাবলিক ট্রল করে ভিলেন বানিয়েছে। সেই ভিলেনের সাথে শুয়ে আছে তাদের প্রাণপ্রিয় অভিনেত্রী। লোকে আসলে নিতে পারেনি দুটো ধাক্কা একসাথে। সেদিন ভোরে আবার দেখা গেল ওপার বাংলার পরিচালক সৃজিত মুখার্জির সাথে মিথিলার প্রেম, বিয়ের গুঞ্জন। এরই মধ্যে হ্যাক হলো ইফতেখার ফাহমির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। হা হা, পরিবেশটা সুন্দর না? কোনও ভেজাল নেই। যে হারে সোশ্যাল মিডিয়াতে মিথিলাকে নিয়ে মানুষ বাজে আলাপ করতে থাকলো, সেখানে আসল ক্রিমিনাল চাপা পড়ে গেল। এখন কথা হচ্ছে, মিথিলাকে আপনি এই পর্যায়ে আপনার হৃদয়ের রানি থেকে নামিয়ে দিতে পারেন। প্রচণ্ড ঘৃণাও করতে পারেন। পারেন কিছুটা সমালোচনাও করতে। কিন্তু কতটা? এইভাবে ভার্চুয়াল রেপ করে আপনি আপনার শিক্ষা ও রুচির পরিচয়ই তুলে ধরছেন। তারচেয়ে বড় কথা, শুধু মিথিলা মিথিলা করছেন কেন? পুরুষ সেলিব্রেটির নাম বলছেন না কেন? আপনাদের নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। কারণ এই ব্যাপারে বহু বিজ্ঞজন বলে ফেলেছেন। আমি তাদের সাথে কিছুটা একমত। কিন্তু বলতে বলতে বিজ্ঞ বন্ধুরা যে মিথিলাকে স্যালুট দিচ্ছেন, কুর্নিশ করছেন, এইখানে আমার আপত্তি আছে।

মিথিলা তার জীবনের এই দুঃসময়ে ভেঙে না পড়ে শিরদাঁড়া সোজা করে বিষয়টি খুব স্মার্টলি হ্যান্ডেল হয়তো করেছেন। সেটি তার পরিবারের জন্য, মিথিলার নিজের জন্য অবশ্যই শুভকর হবে। কিন্তু মিথিলার লজ্জিত না হওয়াকে, ভুল স্বীকার না করাকে যারা বিশ্বজয়ের সম্মান দিয়ে মুকুট পরিয়ে দিচ্ছেন মিথিলার বোকা মাথায়, তারা সমাজকে ভুল বার্তা দিচ্ছেন। আপনারা বিজ্ঞরা বলছেন, বিচ্ছেদ হয়েছে বলে কি তিনি কারো সাথে শোবেন না? ব্যাক্তিগত প্রেমের মানবিক মুহূর্তের কথাও বলছেন। সব ঠিক আছে যখন তিনি আর কারো স্ত্রী নন, তখন সেই সময়ে একটি সম্পর্কে তিনি থাকতেই পারেন, আর সম্পর্কে থাকলে একান্ত সময়ও কাটাতে পারেন। কিন্তু তিনি আরেকজনের (ইফতেখার ফাহমীর স্ত্রী) স্বামীর সাথে শুতে পারেন না। এখানে পরকীয়াকে আপনারা মানবিক দৃষ্টিতে দেখে প্রগতিশীলতার চর্চায় ফেলতে পারেন না। মিডিয়াতে মিথিলার শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। মূলত সেসব মানুষই স্যালুটের বন্যায় তাকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। গুণী সংগীত পরিচালক প্রিন্স মাহমুদ তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘মেয়েটা বোকা, তবু বলবো আমরা এই মেয়েটাকে অনেক ভালো পাই...’ মানে তিনি পুরাই বুঝিয়ে দিলেন মিথিলার বেলায় পরকীয়াও মাফ।

মূলত মিডিয়াতে এসব ওপেন সিক্রেটই ছিল। ফাহমীর সাথে সম্পর্ক চলাকালীন একটি সাক্ষাৎকারে উপস্থাপক নাবিলাকে ফাহমির সাথে প্রেমের গুঞ্জন নিয়ে মিথিলা বলছেন, ‘এসব গুজব, গুজবে কান দিবেন না।’ পোংটা পোলাপান আবার এর সাথে ফাহমি, মিথিলার অন্তরঙ্গ ছবি জুড়িয়ে মিম তৈরি করছে। এটা দেখে মিথিলার ব্যক্তিত্বের ফেইক ইমেজটিও ভেসে ওঠে। মিথ্যাচার আর অনৈতিকতা, এ দুটোর চর্চা সমাজের আইডলরা যদি করেন তবে সেটি আসলে দিন দিন পশুর সমাজের আদলই ধারণ করে।

কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে অন্যের নাক গলানো উচিত নয়। কিন্তু কোন বিষয়টি ব্যক্তিগত আর কোনটি পাবলিক, সেটিও বুঝতে হবে। উন্নত বিশ্বে কেউ কারো জীবন নিয়ে গসিপ করে না। আমার পাশের বাসার মেক্সিকান কাপল প্রেমিক প্রেমিকা নাকি বিবাহিত দম্পতি, তা আরেক পাশের নেইবার জুইস ফ্যামিলি ঘুণাক্ষরেও জানতে চাইবে না। তবে মানুষটি যদি হন পাবলিক ফিগার, ধরুন ক্লিনটন, মনিকা লিউনস্কি কাণ্ড কিম্বা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যৌন কেলেংকারি। এসব কিন্তু এই ফ্রি সেক্স কান্ট্রিতেও টক অব দ্য কান্ট্রি হয়। সাংবাদিক জনতা সকলেই সেই খবরে নাক গলায়। সমালোচনা হয়। আমাদের মতো এত নোংরা ভাষায় নয়।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট