মেহেদী উল্লাহ

মেহেদী উল্লাহ

মেহেদী উল্লাহর গদ্য ‘ভ্রমের দিকে দৌড়ে গেল দুজন’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৪, ২০২০

আপনার যন্ত্রণা বুঝতে পেরেও গতকাল বিকেলে আমি দাঁত কেলিয়ে হেসেছি। এরজন্য দুঃখিত। আসলে এটা এই জন্যই ঘটেছে,‘প্রেম’ নামক অনুভূতি আমাদের দুজনার দুই রকমের। আপনি প্রেমের যে বিন্দু থেকে শুরু করেন, হতে পারে আমি সেথায় প্রেমের শেষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে, আবার আপনার জন্য প্রেম যেখানে গন্তব্য, হতে পারে তা আমার জন্য সূচনা বা যাত্রারম্ভ। এই জন্য আপনার মন খারাপ আর আমি হেসেছি। আবার দেখা যাবে, আমার প্রেমের অর্ন্তবয়ান, বর্তমান হাল-দশা জেনে আমি হাসছেন, অথচ আমার মেঘসম মন খারাপ। ভালোবাসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের কাছে ভালোলাগার একটা শূন্য স্থান। সেই ‘শূন্য’ মানুষভেদে বিভিন্ন রকম। আমার জন্য যা সমুদ্র, আমার কাছে তা হতে পারে কূয়া।

যাই হোক, গতকাল বিকেলে আপনার যখন মন খারাপ তখন রাস্তার ধারের হাসনাহেনা থেকে সর্প পাগল করা গন্ধ ছুটছিল। আপনার নাকে হয়তো তা এসে লাগেনি, কারণ আপনার অনুভূতির ইন্দ্রয়জুড়ে তখন মরা প্রেমের বিঘ্ন। প্রেম কি তাহলে মরেও! এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। আমার চেয়ে একজন মনোচিকিৎসক আরো ভালো বলতে পারবেন। জানেন, হাসনাহেনা ঘ্রাণ বিলিয়ে দিচ্ছে, অথচ আপনি হয়তো পাননি সেই মাতাল করা গন্ধ। এটা কি শুধু আপনার দোষ? আমি তো বলবো, একই সঙ্গে হেনারও হীনতা। তেমনি বলবো, প্রেমে দুজন মানুষকেই সক্রিয় থাকতে হবে। গতকালই তো, এক যুবক আমাকে প্রশ্ন করলো ফেসবুকে। বললো, তার প্রেমিকা তাকে ছেঁকা দিয়েছে, সে এখন কি করতে পারে। আমি তাকে জানালাম, যে চলে গেছে সে ফিরে আসাটাই এখানে একমাত্র সমাধান। তোমার কি করার আছে! সে সায় দিল তাতে। প্রেম ভাঙার বেলায় প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা দুজন দুজনার সাপেক্ষে বাধিত। আপনি যেমন তার সাপেক্ষে কলসির ভাঙা একটা টুকরো, তেমনি সেও আপনার সাপেক্ষে একটা টুকরো। কলসি যদি না-ই ভাঙতো তবে তো একটাই থাকতো। তাহলে, সে যদি ভেঙে দেয় প্রেম, আপনারা দুজন দুজনের সাপেক্ষে একটা কলসির দুটি ভাঙা টুকরো।

আসলে আপনি কবি, আমার চেয়ে আপনার এই সম্পর্কিত জ্ঞান বেশিই থাকবে। আমাদের সময়টা বেশ খারাপ যাচ্ছে, আমাদের সময়ের প্রেমের সবচেয়ে বড় জটিলতা ‘ইগো’। এটা খারাপ না ভালো, তা সময়ের উপর ছেড়ে দিলাম। একটা নির্দিষ্ট সময়ে, ঘড়িতে যে শুধু সময়ই বাজে, তা নয়। সেই সঙ্গে প্রত্যেকটি কাঁটার ফাঁকে যে জায়গাটুকু রয়েছে তাতে আরো অনেক কিছুই বাজে। যেমন, সমকালীন সমস্যাগুলো— সম্পর্ক, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানা কিছু। তারই ক্ষুদ্রতম একটা ডিসকোর্স আপনার প্রেম। বলছিলাম. ইগোর কথা। এই সময়ে শুধু প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার সম্পর্কই নয়, স্বামী কিংবা স্ত্রীর সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে তাদের নিজস্ব ইগো। একুশ শতকের বাঙালি নারী-পুরুষের সম্পর্কের প্রধান জটিলতা ইগো।

দেখুন, নারী এখন শিখছে, পড়ছে, নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে চাইছে। আমি কৃষ্ণ হয়ে তাকে রাধা ভেবে বসলে মস্ত বড় ভুল হবে। অতীতে পরমের জীবের প্রতি টান ছিল তাই হয়তো কৃষ্ণ নিজেই মানুষের বেশে রাধার টানে মর্ত্যে চলে এসেছে। এখন আর সেই দর্শন আপনি পাবেন না। এখনকার কৃষ্ণরা অনেক বাঁকা, তারা ইগোর কারণে রাধার কাছে আগবাড়িয়ে যেতে চায় না, আবার রাধার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। রাধাই বা আগে আগে চলে যাবে কেন তার কাছে? তাই স্পষ্ট সমস্যাটা— কে তাহলে আগে যাবে? রাধা না কৃষ্ণ? এই নিয়ে পড়ে থেকে কেউই যায় না, ফলে দ্বিপাকি সম্পর্কটা একাকিত্বে গড়ায়। হয়ে যায় ছাড়াছাড়ি। কৃষ্ণও রাধার বাড়ির আঙিনা মাড়ায় না, রাধাও যায় না কৃষ্ণের বৃন্দাবনে। দুজন দুজনের মতো করে একা, একা হয়ে যায়। অথচ জানেন, তখনই সমস্যাটা পড়ে গিয়ে প্রেমের গায়ে। অনর্থক দোষায়, প্রেম ভেঙে গেছে। বৈবাহিক সম্পর্ক গড়িয়েছে তালাকে।

একটা সিনেমার কথা মনে পড়ছে, নাম মনে আসছে না! স্বামী বা স্ত্রী কেউই আগবাড়িয়ে নিজে থেকে কামে সাড়া দেয় না। স্বামীর আকাঙ্ক্ষা, স্ত্রীই তাকে জড়িয়ে ধরুক, বলুক এসো মিলি একসাথে। আবার স্ত্রী ভাবে, আমি আগে যাব কোন দুঃখে, আমার কাম বাসনাকে কেন আমি তার কাছে ছোট করবো? সমস্যা বাড়ে এতে। সিনেমায় দেখলাম, ইগোর ফলে স্বামী বা স্ত্রী কেউ কাউকে কামে সহযোগিতা করছে না। যে যার মতো একা একা মৈথুনে মজছে। এটা হচ্ছে আমাদের মধ্যবিত্তের নতুন প্রবণতার একটা। অতীতে নারীর অবস্থা যা ছিল, তাতে সে এই অহংবোধের সঙ্গে মোলাকাত করতে পারেনি। আমি উনিশ, এমন কি বিশ শতকের কথা বলছি। যা ধরুন, আমাদের মা-নানিদের আমল।

আর এখন! এটা কিন্তু নারীর সমস্যা না। সে বাস্তবিক পুরুষের সমতালে জীবনানুভূতি বুঝে নিচ্ছে পুরোপুরি। অথচ ইগোর ভূত ঘাড়ে চাপলে কাউকে না কাউকে ছাড় দেওয়াই উত্তম। যে কাউকে এগিয়ে আসতে হবে আগে। নইলে সম্পর্ক টিকবে কোত্থেকে! এই ক্রাইসিস যে শুধু মধ্যবিত্তের, তাও নয়, নিম্নবিত্তের মধ্যেও হাজির হয় অন্যভাবে। কিছু দিন আগে গেলাম নোয়াখালীর একটা গ্রামে। রাতের আন্ধারে গ্রামের মুরব্বীরা বিচার করতে বসেছেন এক স্বামী আর এক স্ত্রীর। স্ত্রীর অভিযোগ, সে নাকি তার স্বামীকে দেখেছে, বাড়ির পুকুরের পাড়ের আন্ধার জঙ্গলে অন্য এক মহিলার সঙ্গে। সে হাতেনাতে ধরেছে। সে লাইটের আলো ফেলে দেখেছে দুজনকে কামরত অবস্থায়। স্ত্রীর আর্জি, যে স্বামীর ঘরে বউ থাকতে অন্য মহিলার দরকার হয়, সে তার ভাত খাবে না। অন্যদিকে স্বামীর আত্মপক্ষ সমর্থন, এক তরকারি দিয়ে নাকি প্রতিদিন ভাত খেতে ভালো লাগে না।

এমন কথা শুনে বলুন, স্ত্রীর কি-ই বা বলার আছে। দুজনের যুক্তি যার যার কাছে সঠিক। এক স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে থাকতে সে বিরক্ত, আর স্ত্রীর চাওয়া একটাই স্বামী থাকবে তার, সে অন্য মহিলার সঙ্গে শুবে কেন সে থাকতে? অবশেষে, বিচার করা যখন সম্ভব হচ্ছিল না তখন এক প্রবীণ স্বামীটিকে বললেন, তুমি তো বললা, এক তরকারি দিয়ে প্রতিদিন ভাত খেতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু তুমি তো জন্ম থেকে একই বাতাস নিচ্ছো। বাতাস কি প্রতিদিন পাল্টায়! স্বামীটি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকলো, একথা শুনে। সবাই আবার শুরু করলো নতুন ভাবে বিচার করা। আসলে, মানব জীবনের কোনো কিছুরই নির্দিষ্ট কোনো অর্থ নেই, একটা প্রসঙ্গ বা ঘটনার নানা অর্থ থাকতে পারে। যে অর্থটা যার বেলায় প্রযোজ্য। আপনার প্রেমের বর্তমান অবস্থাকে তাই আপনি কোন অর্থ দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন তা শুধুই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমার ধারণা, আমরা মধ্যবিত্তরাই প্রেমকে একট নির্দিষ্ট বৃত্তে বন্দি করেছি, এলিট শ্রেণির প্রেম কখনো ভাঙে না। কারণ, তাদের প্রেম ভাঙা দিয়েই শুরু হয়, তারা প্রেমই করে ভাঙার জন্য। পোষায় না, চলে যায়। যতদিন যাকে ভালো লাগে, প্রেম নয়, শুতে ভালো লাগে।

আমার গুলশানের এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কয় টা গার্লফ্রেণ্ড? সে বললো, ঠিক নাই, যেদিন যে শুইতে চায়, সেই দিন তার সঙ্গে সময় কাটাই। আমি বললাম, তুমি শোওয়ার প্রস্তাব দেও না? সে বলল, আমি তো মামা একজন, আমি শুইতে চেয়ে বিপদে পড়বো নাকি! বুঝ না, সূর্যকে কেন্দ্র করে সব গ্রহ-নক্ষত্র ঘুরে, যখন কক্ষপথে যে পড়ে সেই সূর্যের কাছাকাছি থাকে। সূর্য কি যায়? বরং যে আসে তার সাপেক্ষে সূর্য কাছাকাছি। আমার বেলায়ও একই কথা খাটে। যে যেদিন আসতে চায় তাকেই সময় দিই, আমি বলি না। আমাদের প্রেম আছে, তাই ভাঙে। ভাঙতে ভাঙতেই আবার গড়ে ওঠে প্রেমের ইতিহাস। আমি একটা গল্পে এমন একটা চরিত্র সৃষ্টি করেছিলাম, যে যুবকটি ভালোবাসে একজন মডেলকে। অথচ দেখুন অভিভাবক স্থানীয় একজন তার ভালোবাসা সম্পর্কে আরেক অভিভাবকের কাছে মন্তব্য করছে এমন— এ  শহরের যুবকদের মতো সে যন্ত্রণা আর বিষণ্ণতায় অস্থির নয়। সে তার হৃদয়কে অপরাধী করে তুলেছে। সব খালি জায়গাসমূহ যখন যানস্ট্যান্ড আর ইট-পাথরে ঠাসা হতে চলেছে, তখন সে এ শহরে পার্ক পত্তনের স্বপ্ন দেখছে। আর যুবকেরা যা ভাবতেও পারছে না, সে ওই ভাবনায় তার হৃদয় এবং সম্ভবত দেহকেও ফুসলিয়ে দিয়েছে। আমি তাকে বলেছি একটি আস্তাবল আর প্রার্থনালয় খুঁজতে।

কে এই অভিভাবক? আমার বিচারে একুশ শতক। শহরের সব যুবক যখন ভালোবাসা ভুলে গেছে, প্রেম নেই তাদের হৃদয়ে, তখন সে একজনকে ভালোবেসেছে। শহরে আর প্রেমের পার্ক নেই, যা আছে তা প্রেমহীনতার যানস্ট্যান্ড আর ইট-পাথরের বাসা। প্রেমের বদলে যুবকদের হৃদয় যন্ত্রণা আর বিষণ্ণতায় অস্থির। তবুও কবিরা ভালোবাসে। প্রেমে হাবুডুবু খায়! আসলে, প্রেমিক আর প্রেমিকার চেয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা দিন দিন আরো ডিফিকাল্ট হয়ে ওঠেছে। ইদানীং তালাকের পরিমাণ বেড়ে গেছে খুব। আমি এই সম্পর্ক নিয়ে অনেক ভেবেছি। অনেক চিন্তা করে একটা গল্প লিখলাম। নাম, জায়া-পতির তালাচাবি। মূলসূত্র, স্বামী-স্ত্রীর আলাদা আলাদা বাসায় থাকা। যখন যে সময় পাবে আসবে। শরীরের চাহিদা মিটিয়ে চলে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, শরীরের চাহিদা তো অন্য কাউকে দিয়েও পূরণ করা যেতে পারে। এতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। যদি কেউ সম হয়, অবশ্যই করবে। তবে কেউ কাউকে না জানানোই উচিত। যার যখন যার সঙ্গে ভালো লাগবে থাকবে। শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্য তারা বিবাহে আবদ্ধ হবে। ভালোবাসার জন্য নয়। কারণ, আমি মনে করি, এই সময়ে ভালোবাসা সম্ভব নয়। আমরা যে সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তা কোনোভাবেই আমাদের ভালোবাসার কথা বলে না। প্রেমের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ দেয় না। কারণ, আপনি তো কখনোই পারবেন না, এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আপনার পূর্বপুরুষের মতো করে প্রেম করতে। সোসাইটি আসলেই আপনাকে সে সুযোগ দিবে না। তাই প্রেমকে অতীতের অবস্থান দেখে দেখবেন না প্লিজ। কবি বলেই হয়তো আপনি দেখতে পারছেন! শহরের আর কোনো যুবক প্রেমিকা চলে গেলে কষ্ট পায় না, তাহলে আপনি পাবেন কেন! শহরের আর কোনো যুবতী প্রেমিক চলে গেলে আর কাঁদে না, অথচ আপনার এমন কেন অনুভূতি! পৃথিবীর কাছাকাছি একটা চাঁদের মিনিংও এখন বদলে নেওয়া উচিত। এখন আর চাঁদ সুন্দর কোনো বস্তু হতেই পারে না। কি কবি, কি সাধারণ মানুষে। আমার তো মনে হয়, চাঁদ একটা কঠিন পাথর, পৃথিবীর বুকের ওপর চেপে আছে, যেমন চেপে আছে আপনার বুকের ওপর প্রেমের বিষাদ। সময়মতো সব কিছুর মিনিং সেই মোতাবেক বদলে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। যে আপনাকে ছেড়ে যেতে চায় যেতে দিন। আপনার যাকে ছেড়ে যেতে মন চাইবে চলে আসুন। তাহলে প্রশ্ন, ভালোবাসা কোথায়? আপনিই বলুন, ভালোবাসা কি আসলেই আছে। যা নেই তা আসবে কোত্থেকে! এই টা মানুষের চরম সৃজনশীলতার মধ্যে একটা। মানুষ দুজন মানুষের লিঙ্গের আকর্ষণের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু অভ্যস্ততার আচরণকে ভালোবাসা বলে সংজ্ঞায়িত করে আসছিল এতদিন।

আজ এই নতুন শতকে হাটে হাঁড়ি ভেঙে গেছে। এখন ভাবছি, যা ছিল না এতদিন, তা যাবেই বা কেমন করে! সবি আসলে ধারণা মাত্র। বলতে পারেন কনসেপ্ট। একজন ’মালালা’ কে ধরণীর উপরে তুলে একশজন ‘মালালা’ কে চোখের সামনে গুলি করে মারার সামিল। এগুলো হচ্ছে, অভিধার চোরাটান। সাবজেক্ট এবং অবজেক্টকে অভিধায় অভিষিক্ত করা। যাতে গুণতে সুবিধা হয়। শাসন করতে কিংবা পোষ মানাতে সুবিধা হয়। জীবনকে একটা ছাঁচে ঢুকিয়ে ফেলা মানে, জীবনকে কাঠামোবদ্ধ করতে পারা। প্রেমও সম্পর্কের একটা ছাঁচ। যাতে একজন পুরুষ ও নারী ডিফাইন করে নেয়, তাদের চলাফেরা কেমন হবে অথবা একে অন্যের প্রতি কি আচরণ করবে, এবং কিভাবে তারা একে অপরের প্রতি অধিকার ফলাবে। শাহজাহান মমতাজের জন্য তাজমহল গড়েছেন— এই ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। বরং আমি এই ভাবে ভাবি, তাজমহল গড়তে গিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক উল্টো বঞ্চিত হয়েছে তাদের স্ত্রীর ভালোবাসা থেকে। প্রেমিকার ভালোবাসা থেকে। দিন-রাত খেটে-মেটে তাজমহল গড়তে গড়তে যারা আধমরা হয়ে গেছে। যদিও বলবেন, এটা তো ছিল তাদের জন্য কর্মসংস্থান। হ্যাঁ, তাজমহলের এই আরো একটা গুরুত্বের দিক যে, এইখানে কাজ করে হাজার-হাজার লোকের জীবিকা নির্বাহ করেছে। তবে, চীনের মহাপ্রাচীরের মতো যদি হয় এই নির্মাণ, তবে তা পৃথিবীর ভালোবাসাহীনতা সমূহের মধ্যে নিষ্ঠুরযজ্ঞ।

লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, সিরি-ফরহাদ— এই সমস্ত ব্র্যান্ডিং। এই এক ব্র্যান্ডিংয়ের কারণে পৃথিবীতে প্রেমের মর্যাদা বেড়ে গেছে। চিন্তা করুন একবার, কবি প্রেমের কবিতা লিখেছেন, সাহিত্যিক লিখেছেন অনবদ্য প্রেমকাহিনি, চলচ্চিত্রকার বানিয়েছেন প্রেমের সিনেমা। এই প্রেম বিক্রি করে এখনো খাচ্ছে কিছু মানুষ। তাদের জীবিকা। যারা এমন প্রেম নিয়ে সৃষ্টিকর্ম করে, এমন ভেবে লাভ নেই যে, আহ! কি মহান সৃষ্টি। বরং এই ভাবে ভাবলে এই পূজিবাজারে লাভ যে, এটা নিছক একটা পণ্য। প্রেমের মাহাত্ম্য বিক্রি করে খাওয়া। যিনি প্রেমের যত কলা জানবেন, তার বাজারে ছলাও তত ভালো হবে। পৃথিবীতে একই সঙ্গে চলছে ধ্বংস ও সৃষ্টি। একই সঙ্গে চলছে সৌন্দর্যতত্ত্ব, শিল্পতত্ত্ব ও অসুন্দর আর বিভীষিকা। একই সঙ্গে শান্তির জন্য পুরস্কার দান আর যুদ্ধের জন্য অর্থ বরাদ্দ। মরণাস্ত্র বানাতে কি টাকা লাগে না! সৈনিক কি বিনা পয়সায় গুলি ছুঁড়ছে? আবার ‘নোবেলে’র জমানো টাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেওয়া হচ্ছে নোবেল। সবখানের অন্তরঙ্গ টাকা বা পুঁজি। প্রেমও সেই পুঁজি দিয়ে প্রভাবিত। একই যেহেতু ধ্বংস আর সৃষ্টি সুযোগ আছে পৃথিবীতে, তাই প্রেমিক হিসেবে বিচ্ছেদ কিংবা মিলনেরও সুযোগ আছে আপনার। তা একই সঙ্গে।
আপনি ঠিক করবেন আপনি কোন দলে ভিড়বেন। মিলন শেষে বিচ্ছেদ নিয়ে ফিরবেন নাকি বিচ্ছেদে থেকে বিচ্ছেদ নিয়ে ফিরবেন তা আপনার একান্ত বিবেচনার বিষয়। শুধু জানবেন, পৃথিবীতে কোনো প্রেম নেই আজ। যাকে প্রেম বলে ধরা হয় তা সম্পর্কের একটা আইডিয়া মাত্র। আপনি কবি, আপনার এটা আরো ভালো বোঝার কথা। তাই একটা ধারণার যেমন ভুল বা শুদ্ধতার দিক আছে, তেমনি প্রেমেও আছে বিচ্ছেদ কিংবা মিলন। এই নিয়ে হতাশ হওয়া, কষ্ট পাওয়া, দুঃখ করা, বিষণ্ণ হয়ে পড়া বোকামি। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে শুরু করুন জীবনের নতুন হিসেব-নিকেষ। সকালে ঘুম থেকে ওঠে যে মল ত্যাগ করেন, তার মতো প্রেমটাকেও দেহ থেকে বের করে দিন। মনে রাখবেন, এই মুহুর্তে আপনার জন্য যা প্রেম তা আপনার প্রেমিকার জন্য অপ্রেম। আর আগে আপনার প্রেমিকার জন্য যা ছিল প্রেম তা আপনার জন্য ছিল অপ্রেম। দুজন মানুষের সঙ্গে একই প্রেম একসঙ্গে চলতে পারে না। কারণ, সব মানুষের অনুভূতি এক হতে পারে না। মানুষ ভেদে অনুভূতি যেমন বিভিন্ন, প্রেমও তেমন মানুষভেদে বিভিন্ন। দুজন মানুষ একই সঙ্গে একরকম করে সমপ্রেম বিনিময় করতে অক্ষম। তাই, যা আগে কখনো পারেননি, তা এখন না পারলেও অসুবিধা নেই। মানুষের মধ্যে কখনোই প্রেম থাকে না, যা থাকে তা প্রেমের মরিচিকা। প্রেমিক ছুটবে, প্রেমিকাও ছুটবে। শেষে, গিয়ে দেখবে সবটাই সূর্য আর মরুভূমির দুষ্টামি। তেমনি একটা ভ্রমের দিকেই দৌড়ে গিয়েছিল তারা দুজন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক