মোৎসার্ট

মোৎসার্ট

মোৎসার্টের পাঁচটি চিঠি

প্রকাশিত : আগস্ট ১১, ২০২০

ভোল্‌ফগাংক্‌ আমাডেয়ুস মোৎসার্টের জন্ম ১৭৫৬ সালের ২৭ জানুয়ারি। মারা যান ১৭৯১ সালের ৫ ডিসেম্বর। অস্ট্রীয় এই সুরকার ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সঙ্গীত যুগের বিখ্যাত ও প্রভাবশালী সুরস্রষ্টা। জালৎস্‌বুর্গ শহরে জন্মগ্রহণকারী মোৎসার্ট শৈশব থেকেই তার বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।

কিবোর্ড ও বেহালায় দক্ষতা অর্জন করে তিনি মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তার প্রথম সুর সৃষ্টি করেন এবং ইউরোপীয় অভিজাতদের সামনে তা পরিবেশন করেন। ১৭ বছর বয়সেই তিনি জালৎস্‌বুর্গের দরবারি সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, পাশাপাশি নিরলসভাবে অসংখ্য সুর সৃষ্টির মাধ্যমে আরো উচ্চ অবস্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যান।

১৭৮১ সালে যখন তিনি ভিয়েনা ভ্রমণ করছিলেন, তখন তাকে জালৎস্‌বুর্গের দরবার পদ থেকে পদচ্যুত করা হয়। তিনি ছয়শোর বেশি সুর সৃষ্টি করেন, তন্মধ্যে অসংখ্য সুর সিম্ফোনিক, কনসার্টেন্ট, চেম্বার, গীতিনাট্যধর্মী ও দলীয় সঙ্গীতের শীর্ষ সুর বলে বিবেচিত হয়। তিনি ধ্রুপদী সুরকারদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় প্রভাব বিস্তারকারী এবং পরবর্তী পাশ্চাত্য শৈল্পিক সঙ্গীতে তার প্রভাব অনস্বীকার্য।

লুডভিগ ফান বেটোফেন তার শুরুর কাজগুলো মোৎসার্টের অনুকরণে সৃষ্টি করেন এবং জোসেফ হ্যাডন লেখেন, “পরবর্তী একশো বছরেও এমন প্রতিভা দেখা যাবে না।” মোৎসার্টের পাঁচটি চিঠির বাঙ্লায়ন করেছেন তরুণ কবি সঙ্গীতা দাশ  

এক.

সালসবার্গ ১৭৬৯
প্রিয়তমা,
কিছু পঙক্তি লিখে তোমাকে জ্বালাতন করার যে স্বাধীনতা আমি দেখালাম, সেজন্য তোমার ক্ষমাপ্রার্থী। তবে গতকাল যেমন তুমি বলেছিলে যে, ল্যাটিন ভাষা তুমি বুঝতেই পারো, আর আমিও খুশিমতো ওই ভাষায় লিখতে পারি, তাই ল্যাটিনে কয়েক পঙক্তি লিখে ফেলার জোরালো আবেগ থেকে আজ আর নিজেকে প্রতিহত করতে পারলাম না। আর আমার প্রতি নির্দয় হয়ো না। পাঠোদ্ধার হলেই হেগনারের ভৃত্যের হাতে উত্তর লিখে পাঠিও। কারণ আমার দূতটির হাতে সময় নেই। মনে রেখো, কেবলমাত্র চিঠি লিখেই তোমার উত্তর দিও।

আমি জানতে চাই, এত বেশি বেশি যুবকদের কাছে আলস্য এত মহার্ঘ্য কেন। যে কোনও শব্দ, কোনও আঘাতই তাদের জাগাতে পারে না?

দুই.

ভেরোনা, জানুয়ারি ১৭৭০
প্রিয়তম বোন,
অবশেষে একটা চিঠি পেলাম। এত দীর্ঘ সময় আর এত দীর্ঘ অপেক্ষার পর উত্তর এলো যে, আমি ধৈর্য হারিয়েছি। এবং অধৈর্য হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। জার্মান গণ্ডমূর্খটি যা বলার ছিল বলেছে, এবার ইতালিয়ানটি শুরু করছে: আমি যেমন অনুমান করেছিলাম, তার চেয়ে ইতালিয়ান ভাষায় তুমি অনেক বেশি সুদক্ষ। এবার বলো তো, ক্যাভালিয়াররা যেসব কমেডি নাটক পরিবেশন করে তুমি সেই অভিনেতাদের একজন নও কেন? সম্প্রতি `ইল রুগেইরো` নামের একখানা অপেরা শুনেছি। ব্রাডামান্তের বাবা অরোন্তে একজন রাজকুমার ব্যারিটোন কণ্ঠের অধিকারী একজন ভালো গায়ক, আফেরি অভিনয় করেছেন। উঁচু সুরে গাইতে গেলে অবশ্যি অনেকটাই কৃত্রিম মনে হয়, তবে ভিয়েনার তিবাল্ডির মতো অতটা খারাপ নয়। এদিকে ব্রাডামান্তে তো রুজিয়েরোর প্রতি প্রেমমুগ্ধ কিন্তু, তার বিয়ে স্থির হয়েছে লিওনের সঙ্গে। তবে বিয়ে সে করবে না। বিরাট কোনও দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে এমন এক সম্ভ্রান্ত মহিলার ভান করে আছে সে। মিথ্যা কী এক নাম গ্রহণ করেছে, আমার মনে নেই। এঁর কণ্ঠস্বর চলনসই, আর দেখতেও মন্দ নয়। কিন্তু গান গায় একেবারেই বেসুরো। ব্রাডামান্তের প্রেমাস্পদ, একজন সুরকার এবং গায়কির ধরন মাঞ্জৌলির মতো। জোরালো আর মধুর কণ্ঠস্বর যদিও বেশ বয়স্ক, পঞ্চান্ন হয়েছে।

লিওন বিয়ে করবে বিরাট ধনী ব্রাডামান্তেকে। তবে মঞ্চের বাইরের জীবনে সে ধনী কিনা আমি বলতে পারবো না। আফেরির স্ত্রীর কণ্ঠস্বর সবচেয়ে সুমধুর, কিন্তু মঞ্চে এতই আস্তে গায় যে কিছুই শোনা যায় না। ভিয়েনায় যে বেহালাবাদক, লল্লির বাজনা শুনেছিলাম তার বোন আইরিনের চরিত্রে অভিনয় করছে। তার কণ্ঠস্বর কর্কশ আর সবসময়ই হয় খুব ধীর লয়ে নতুবা খুব দ্রুত গতিতে গায়। গানোর চরিত্র যিনি করেছেন তার নাম কখনো শুনিনি। মঞ্চে এটাই তার প্রথম অভিনয়। প্রতি অংকের মাঝে ব্যালে নাচ ছিল। রোয়েস্লার নামে একজন ভালো নৃত্য শিল্পী আছেন এখানে। উনি জার্মান আর বেশ ভালোই নাচ করেন। শেষ যে বার অপেরায় গেলাম, শ্রী রোয়েস্লার আমাদের ব্যালকনিতে এসে পড়েছিলেন। কার্লোটির সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। প্রসঙ্গত সবাই এখন আসন প্রদর্শক। এর সচেয়ে বড় সুবিধা হলো, মুখোশটা একবার টুপিতে বেঁধে নিলে কারো সাথে কথা বলার সময় টুপি খোলার ঝামেলা থেকে অব্যাহতি মিলবে। সারভিটোর উমিলিসিমো এসবেই কাজ চলে যায়। বেশ মজার ব্যাপার। সবচেয়ে অদ্ভুত হলো, আমরা ঘুমোতে গেলাম সোয়া সাতটায়। আচ্ছা, এ বিষয়টা কি তা যদি আন্দাজ করতে পারো তাহলে মেনে নেবে তুমিই সব আন্দাজিদের জননী। আমার হয়ে মায়ের হাতে চুম্বন দিও। তোমার জন্য রইলো হাজার চুম্বন। আর কথা দিলাম, চিরদিন তোমার স্নেহবান দাদা হয়েই থাকব।

তিন.

মিলান, অক্টোবর ২০, ১৭৭০
প্রিয় মা,
অপেরার জন্য এত বেশি পদ রচনা করতে হচ্ছে যে, আঙুল ব্যথা হয়ে আছে। তাই তোমাকে খুব বেশি লিখতে পারবো না। আশা করি, তুমি প্রার্থনা করবে যাতে আমার অপেরা সসমাদৃত হয় আর শীঘ্রই আমাদের আনন্দম্য সাক্ষাৎ ঘটে। সহস্র চুম্বন তোমার হাতে। আর বোনের সঙ্গে অনেক কথা বলার আছে। কি কথা? তা কেবল জানেন ঈশ্বর আর আমি। হে ঈশ্বর, শীঘ্রই যেন তার মুখোমুখি হয়ে কথাগুলো বলতে পারি। ততদিনের জন্য তাকে সহস্র চুম্বন। আমার সব বন্ধুদের অভিবাদন। প্রিয় মার্থার্লকে হারিয়েছি আমরা। তবে আশা করি, ঈশ্বরের করুণায় এখন সে মঙ্গলময় অবস্থানে আছে।

চার.

মিলান, অক্টোবর ২৭, ১৭৭০
প্রিয়তম বোন,
তুমি তো জানো, আমি কথা বেশ ভালোই বলতে পারি। তোমাদের ছেড়ে যখন এলাম তখন পর্যন্ত এমনটাই ছিলাম। সম্প্রতি তার প্রায় সবটাই সংকেত দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে নিয়েছি। কারণ এই পরিবারের ছেলেটি কথা বলতে পারে না আর কানেও শুনতে পায় না। এবার অপেরা রচনার কাজে হাত দিতে হবে। বড় অনুতাপ বোধ হয়, যে দ্বৈত নৃত্যের সুর তুমি চেয়ে পাঠিয়েছিলে তা আজও রচনা করে উঠতে পারিনি। তবে ঈশ্বর চাইলে সম্ভবত এবারের ইস্টারে সংগীতটি আর আমার দুইয়েরই দেখা মিলবে। আজ আর লিখতে পারছি না। বিদায়.. প্রার্থনা কোরো আমার জন্যে।

পাঁচ.

মিলান, নভেম্বর ৩, ১৭৭০
আমার প্রিয় আদরের বোন,
তোমাকে আর মাকে অনেক ধন্যবাদ, তোমাদের অকৃত্রিম শুভকামনার জন্যে। আমার আকুল বাসনা, তোমাদের দুজনের সাথে খুব শীঘ্রই সালজবার্গে দেখা করা। আমার মনে হয়, মার্টিনেলি মহাশয় তোমার ইতালিয়ান কর্মসূচিটির প্রস্তাব রেখেছেন। প্রিয় বোন, তুমি সবসময়ই এত চতুর আর এত সুচারুভাবে কাজ সম্পন্ন করো! ইতালি ভাষায় তোমার অভিবাদন আর তার পরেই একই লিখনশৈলীতে মার্টিনি মশায়ের প্রশংসা, যাতে করে আমি বুঝতে না পারি, বুঝতে পারিওনি। আর আমি তখনই বাবাকে বলেওছি, আহা! আমিও যদি তোমার মতো চটপটে আর বুদ্ধিমান হতাম! বাবা উত্তর দিলেন, ‘আরে হ্যাঁ, সত্যিই তো!’ আমিও জুড়ে দিলাম, ‘উফ, কী ঘুম পেয়েছে!` আর বাবার ছোট্ট উত্তর, `তাহলে লেখা বন্ধ করো।’

বিদায়! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো, আমার অপেরা যেন সফল হয়।