
মৎস্যকথন
পর্ব ১
আশরাফ রোকনপ্রকাশিত : এপ্রিল ১২, ২০২০
তখন হাওড়ে বর্ষাকাল থাকতো ছয়মাস। জ্যৈষ্ঠ থেকে কার্তিক মাস। ফলে হাওড়কেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থায় তখন বর্ষাকালটা ছিলে জল ও মাছের এক মহোৎসবের ঋতু। যতদূর মনে পড়ে, যখন নতুন পানি আসতে শুরু করতো আমাদের বাড়ির সামনের শুকনো চট্টন, সবুজ মাঠগুলো ক্রমশ ডুবে যেতে যেতে যখন ঘাটের কিনারে চলে আসতো উজানের ঢলের পানি, মনে হয় তখনই শুরু হয়ে যেত বর্ষাকাল।
ঘোলা পানিতে একাকার হয়ে যেত মাঠঘাট, নদীনালা, খালবিল, বাওড়। সবই মিলেমিশে যখন `জলে জলময়` একটা সমুদ্রের রূপ ধারণ করতো হাওড়াঞ্চল। আর এ ঘোলা পানিতে উঠে আসতো হাওড়ের অভ্যন্তরে প্রবাহিত বিভিন্ন নদনদী, খালবিল, দাইড়, ডোয়ার প্রভৃতি থেকে অজস্র মাছেরাই বর্ষার মুক্ত জলাশয়ে। আর ঘোলা পানিতে যে মাছ শিকার সহজ তা মনে হয় রপ্ত হয়ে গিয়েছিল হাওড়পাড়ের মানুষগুলির কাছে।
ফলে তারা মাছের অন্বেষণে মরিয়া হয়ে উঠতো। অপর দিকে নতুন পানি পেয়ে মাছেদেরও আনন্দ বেড়ে হতো দ্বিগুণ। আর মওশুমটাও মাছেদের ছুটোছুটির, কোলাহলের। ডিমঅলা মাছগুলি পড়তো মহাবিপদে তখন। আত্মভোলার মতো শুধু এসে যেত লোকালয়ের কাছে। হয়তোবা নিরাপদে কোথাও তার মাতৃযন্ত্রণা উপশমের জন্যে কোনো শান্তিময় আশ্রয় খুঁজতো। তার আগামী ভবিষ্যপ্রজন্মের জন্যে ভেবেই ভেবেই ব্যাকুল ছুটে আসতো হয়তো কূলের দিকে।
পুরুষমাছেরাও পিছু নিতো নারী মাছদের। আর মাছেদের এ সরলতাটুকু জেনে গিয়েছিল বলেই মৎস্যশিকারিরা ওৎ পেতে থাকতো কোনো উঁচু ট্যাকে (হাওড়ের স্থানে স্থানে উঁচু ঢিবি বিশেষ)। বসে প্রতীক্ষা করতো এক ধ্যানে তাকিয়ে ট্যাকের নিচের জলের দিকে ঠাহর করে বুঝে নিতে চেষ্টারত মাছেদের গমনাগমন। এক হাতে টর্চ লাইট, অন্যহাতে লোহার খ্বালা (চিকন, চোখা, তীব্র সূঁচালো লোহার তৈরি >আকৃতির বিদ্ধক) লাগানো কোঁচ।
বাঁশের বিজোড়সংখ্যক শক্ত ফলির (ফালির আঞ্চলিক শব্দ) মাথায় খাঁজ কেটে ভরা হতো খ্বালা। সবগুলো ফলি এক করে পেছনের অংশ চেঁছেপুঁছে সরু করে তারপর প্রবেশ করিয়ে দেয়া হতো কৌশলে কোনো লম্বা কাটা বাঁশের আগার বিচ্ছিন্ন হওয়ার অংশের মধ্যে। সবগুলি ফলির পেছন ভাগ পুরে দিলে সম্মুখটা একটা আতা ফুলের মতো মেলে একটু চওড়া হতো। ফলে কোনো মাছের উপর ঘা মেরে নিক্ষেপ করলে তা বেশ কতক জায়গাজুড়ে গভীরভাবে বিদ্ধ হয়ে নাজেহাল করতে সক্ষম যে কোনো মাছকেই, তা সে যত বড় মাছই হোক না।
হাওড়বর্তী হওয়ার কারণে শৈশবে ঘটে যাওয়া এসক হরেক গ্রামীণ বোধ বিষয়ের সাথে একদিন আমারও সখ্য ছিল। এছাড়া মৎস্যশিকারে এলাকায় আমাদের পরিবারের সুনাম আছে। বাড়ির বড় ঘরের বারান্দার টিনের চালবর্গার সাথে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি একটা মাচান ছিল, যা কেবল কোঁচ, জুত্তিয়া, তোড় কোঁচ, বড়শির কুড়া (চিকন বাঁশ, যার মাথায় সুতো বেঁধে বড়শি ঝুলানো থাকে), ছিপ জাল, ঠেলা জালি, ফুটপাইন, কৈয়া জাল, টাঙ্গা বড়শি, মোলা ধরার জালের কাঠি প্রভৃতি মৎস্যশিকারের নানান সরঞ্জামে ঠাসা থাকতো।
পিতামহ ছিলেন মানবদরদী, সৌখিন শিকারি। শিকার করে যে মাছ পেতেন পাড়াসুদ্ধু সব ভাগ করে দিতেন। পিতাও। আর তাইতো ভাবি, জীবনে যত প্রকারের মাছের সাথে দেখা হয়েছে আমার তার স্মৃতিভারও একেবারে কম নয়। যার কিছু জানি আমি আর বাকিটুকু হাওড়পাড়ের হিজলের গাছ।
লেখক: কবি