
মৎস্যকথন
পর্ব ৪
আশরাফ রোকনপ্রকাশিত : এপ্রিল ২০, ২০২০
হাওড়ে বর্ষা শেষ হতো কার্তিক মাসের শেষের দিকে। ভাদ্র-আশ্বিন মাসের শেষের দিকে ক্রমে শুকিয়ে হাওড়ের প্রায় তলায় জল নেমে গেলে নদনদী,খালবিল, নালা, বাওড়, দাঁইড়, ডোয়ার— সবকিছুরই রূপরেখা সামান্য স্পষ্ট হয়ে উঠতো। সব পানি নদনদীখালবিল সব জলাশয়ে নেমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মাছধরা চলতো সমান তালে। পানি কমলে কান্দা বা ট্যাকের পাশের দাঁইড়ের সাথে সংযুক্ত নালাছইড়ায় পাতা হতো কৈয়াজাল। সন্ধ্যাবেলায় গুটি কয়েক ডুলিভরা (ডুলি=বাঁশের তৈরি ডোলা বাগোলা আকৃতির শস্য/মাছ/জাল ইত্যাদি রাখার তৈজস) ছোট্টদের শাড়ির মতো থানে থানে ভাঁজ করা কৈ মাছ ধরার জাল কাঁধে নিয়ে গৃহস্থঘরের বড় কামলাদের কেউ একজন সঙ্গে আরও অন্যান্য গৃহস্থবাড়ির দু`তিনজন একসঙ্গে ঘাটের পানসিতে করে কৈ-জালের ডুলি, কাঁথা-বালিশ, হুক্কা-চোঙা (বাঁশের তৈরি, আস্ত বাঁশের দুই-তিন গাঁট পর্যন্ত পরিমাণ লম্বা চোঙ, পাইপ; যার এক মাথায় ঠাসা থাকতো কামবিরা তামাকে (কামবিরা তামাক=শুকনো মোতিহার তামাকের গুঁড়ো যা হাওড়ের ভাষায় `কম্বল `-এর সাথে পরিমিত লালি (চিটাগুড়) ও তামাককে সুগন্ধি করে তোলার কাজে বিশেষ সুগন্ধি মিশিয়ে তৈরি), আর মাঝখানের গাঁটের নিচে গর্ত করে সে ফাঁকা অংশ টিক্কা দিয়ে (টিক্কা=পাকা,শুকনো, সরিষাকুটো পুড়িয়ে তার ছাইয়ের সাথে ভাতের ফেন মিশিয়ে তৈরি বাতাসা আকৃতির ছোট্ট চারকোল বিশেষ, যা আইল্লার আগুনে (আইল্লা=মাটির মালশায় তুষ পোড়ানো ছাইয়ে আগুন জিইয়ে রাখার সনাতনি পদ্ধতি) ভরে রাখা হতো।
মাছ শিকারের একঘেঁয়ে ক্লান্তি দূর করার জন্যেই হয়তো মাঝেসাঝে হুকোয় টান দিয়ে নিশানা ঠিক করে নিতেন শিকারিরা। রাতের অর্ধেক সময় ধরে জাল পেতে প্রতীক্ষা করতেন, কখন ভোর হবে। কেননা রাতে খাবারের সন্ধানে বের হওয়া কান্দা বা ট্যাকের আশপাশের জলজ লতাগুল্মময় স্থানে আসা কৈ, শিং, মাগুর, ভেদড়ি (মেনি মাছ), বড় বেলে/বালি মাছ, পাবদা, বড় পুঁটি জাতের মাছগুলো গভীরে নেমে যাওয়ার সময়ই যে আটকা পড়বে জালে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই জাল তোলা শেষ করে অল্পক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ঘাটে এসে পড়তো কৈজাল বাওয়াইয়ারা। দেখতাম ডুলিভরা জালে ডুলিভরা যত মাছ, ঠিক তার পরিমাণের প্রায় সমান মেটেসাপ। নানা রঙের, ধরনের, আকৃতির বিচিত্র সব মোটা, সরু, লম্বা, খাটো সাপ। শৈশবেই জেনেছিলাম যে, এসব মেটে সাপদের গায়ে কোনো বিষ নেই। একবার পদ্মপাতায় নিজের বিষ ঢেলে রেখে নাকি তাদের গোত্রপতি ঢোঁড়াসাপ অধিক মৎস্য ভক্ষণের আশায় অতি লোভি হয়ে ওঠে। এ দিকে শিং, টেংরা, মাগুর, কৈ ইত্যাদি মাছেরা ঢোঁড়াসাপের পদ্মপাতায় রাখা বিষকেই অভিনব কোনো খাদ্যবস্তু মনে করেই ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলে। অতি লোভের দণ্ড হিসেবে সর্পদেবি মনসার বদনজরে পড়ে সব বিষ খোয়ায় মেটেসাপেরা। অন্যদিকে বিষপানকারী মৎস্যসম্প্রদায়ের গায়ের কাঁটা কারো পায়ে-গায়ে বিঁধলে দুঃসহ ব্যথায় কোঁকাতে হয়।
কৈ জাল ছাড়া বছরের এ সময়টাতে হাওড়ের মানুষ বায়না পেতে বাঁধ দিয়ে মাছ ধরতো। বেশ কিছু জায়গা জুড়ে জলজ বুনো ঝাউজাতীয় গাছের উঁচু ঢিবি করা হতো জলমগ্ন বিভিন্ন ক্ষেতের আলে আলে। সব পাশ বাঁধ দিয়ে আটকে দিয়ে একপাশে জাল পেতে সে পাশ খোলা রাখা হতো জল চলাচলের জন্যে। আর এ জল চলাচলের পথটায় পানির নিচে পাতা হতো বড় উঁচ (বাঁশের তৈরি চালুনি প্রকৃতির বড় ছাকনি বিশেষ, যা দিয়ে জল বেরোতে পারলেও মাছ বেরোতে পারতো না! উঁচ ছাড়াও `হারুন`, চাঁই `নামে বাঁশের ফাঁদ পেতে এ প্রক্রিয়ায় মাছ শিকারের বিষয়টাকে গ্রামের লোকেরা `ডাক আটকিয়ে মাছ ধরা `বলতো। ছোট উঁচ দিয়েও খেও (মেলে ধরা) দিয়ে, ডাক আটকিয়ে মাছধরা হতো! কার্তিকের শেষের দিকে যখন পুরো হাওড় শুকিয়ে যেত তখন হাওড়ে ভাসা মাছের মতোই উজান থেকে ঢলের পানিতে ভেসে আসা গাছপালা, ডেংগা (ধানগাছের অবশিষ্টাংশ, শীষ কেটে নেয়ার পর), জলজ গুল্মগাছলতা, বিভিন্ন মৃতপ্রাণীদেহের গলিত অংশ, কচুরিপানাধাম সবই হাওড়মধ্যের নদনদী, খালবিলসহ সকল জলাধারে আশ্রিত হয়ে পড়ে। আর প্রাকৃতিক এসব নানা উপাদান মিশেই একটা জৈব কম্পোস্ট তৈরি হয়, যা মাছের খাদ্য হিসেবে বোধ করি অনন্য ভূমিকা রাখতো। প্রচুর পলি পড়ে উর্বর হয়ে ওঠতো কৃষিজমিগুলোও। বর্ষা মওসুমের মতো শুকনার মওশুমেও চলতো মাছ শিকারের খেলা।
অগ্রহায়ণের নদীগুলোতে বোয়ালিয়া বড়শি ফেলতেন শিকারিরা। বোয়াল মাছ ধরার জন্যে পুঁটি মাছের চেপার (সিঁদল) টোপ দিয়ে পাতা হতো বড়শি। টাঙুয়া বড়শিও নদীতে পাতা হতো শীতের শুরুতে। নদীতে উতার জাল, বর জাল, ক্বরা জাল ফেলে মাছ ধরত পেশাদার জেলেরা। শীতের মাঝামাঝি শুরু হতো পলো বাইচ। হাওড়ের মাঝখানে অবস্থিত বিভিন্ন বড় বিল, বাওড়ে দলবেঁধে হৈ হৈ রবে নেমে আসতো হাওড়পাড়ের বিভিন্ন গাঁয়ের লোকজন দলে দলে। সারিবেঁধে জলে নেমে চলতো মৎস্য অনুসন্ধান। বিলের তলায় পলো বেয়ে মাছ ধরে ক্লান্তশ্রান্ত পলোবাওয়া শিকারিদল মাছ শিকার করে দূরের পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতো যখন, তখন মাছ দেখে আনন্দে ভরে ওঠতো পরিবারের সকলের মন। অনেক সময় স্থান, কাল নির্ধারণ করে হাটবাজারে ঢোল পিটিয়ে বড় বড় বিলে বাওড়ে, মরা নদীতে পলো বাওয়ার উৎসব হতো। গ্রামবাসীদের মৎস্যশিকারে পলোবাইচ হাওড়সংস্কৃতির একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। মূলত শীতকালেই হাওড়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য মাছগুলো ধরা পড়ে। হাওড়ের জলমহালগুলোকে ইজারার মাধ্যমে প্রতিবছর রাষ্ট্র যেমন একটা আয়ের মুখ দেখে তেমনি আবার একটা জলমহালকেন্দ্রিক একটা
ব্যবসায়িক সম্প্রদায়েরও বড় অংশও এ মৎস্যসম্পদকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে। যা গোটা বাংলাদেশের মৎস্যঅর্থনীতি ও পুষ্টিতে যুগ যুগ ধরে ভূমিকা রাখছে। যদিও আজ আর আগের মতো নেই হাওড় বাওড় নদী খাল ডোয়ার কোনো কিছুরই অবস্থা, বা অবস্থান; তবু হাওড় আছে, আছে হাওড়পাড়ের জীবনও, হয়তো সে আগের রমরমা অবস্থা নেই, কিন্তু তবু আছে হাওড়কেন্দ্রিক মানুষের নানা দুঃখসুখের কাহিনীর মতোই একাত্ম হয়ে আছে অতীতের সুবর্ণ জলের গাথা ইতিহাস হয়ে, ঐতিহ্য হয়ে।
লেখক: কবি