যুথী ধর শ্রাবণীর শিল্প সত্তা

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুলাই ৩০, ২০২০

যুথী ধর শ্রাবণী ১৯৯১ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ২৯ জুলাই ছিল তার জন্মদিন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি আইন বিষয়েও অধ্যয়ন করেছেন।

তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের একজন নিয়মিত শিশুশিল্পী ছিলেন। তিনি ছায়ানটের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তিনি একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি বিভাগের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।

এ পর্যন্ত তার দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ `অদ্বিতীয়া` ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ `ভাসমান গৃহত্যাগী`। তিনি চমৎকার লেখেন। কী কবিতা, কী গল্প, কী স্টাটাস, তার হাতের ছোঁয়ায় সমস্ত লেখাই সাহিত্য গুণসম্পন্ন হয়ে ওঠে। অনন্য হয়ে ওঠে। তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

তিনি লিখেছেন, ভেবেছিলাম একটা ধবধবে সাদা রঙের জামদানি কিনবো। ব্লাউজটা থাকবে টকটকে লাল রঙের। চুলগুলো এখন যতটুকু হয়েছে, চাইলেই বেলির মালা গেঁথে একটা হাতখোঁপা বানিয়ে ফেলা যেত। হাতভর্তি লাল রঙের রেশমি চুড়ি, কপালে লাল টিপ। পায়ে ভরপুর আলতা দেওয়া, হাতের নখগুলোকেও না হয় আলতায় চুবিয়ে নিতাম! বলো তো, আমাকে কেমন লাগতো সেদিন? সামনে দেবীপক্ষ আসছে কিনা! ততদিনে পৃথিবী ভালো হবে তো?

এটাকে আপনারা কী বলবেন? কবিতা, স্টাটাস বা অন্য কিছু। আপনারা যে যেটাই ভাবুন না কেন, যে যেটাই মনে করুন না কেন, লেখাটি কাব্যগুণসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। এটাই যুথী ধরের বৈশিষ্ট্য। এটাই শ্রাবণীর লেখার সৌন্দর্য!

তিনি অন্যত্র লিখেছেন,
শ্রাবণ এমনই..
নিঃসঙ্গতার চিহ্নটুকু ধুয়েমুছে ফের,
প্রতিদিন এক জীবন বেঁচে থাকার দায়..

চোখের জলে ভেজে শেষ রাতের শোক..
খুঁজে যারে পায়নি, কেন সে কাঁদায়?`

এই পাঁচ লাইন লেখা একটি পরিপূর্ণ কবিতা হয়ে উঠেছে। পেয়েছে অপূর্ব সৌন্দর্য! তিনি একটি স্টাটাস দিয়েছেন এমন,

`আমিই কি একমাত্র যার মা বাবা কোনোভাবেই বাইরে যেতে দিতে রাজি না?

সেই ১৭ই মার্চ থেকে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি না, হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি না, টিএসসির মরিচ চা খাই না, চুল খুলে এলোমেলো হয়ে কাঠগোলাপের গাছটার নিচে দাঁড়াই না, কতদিন আমি নাজিরাবাজার বিরিয়ানিপল্লীর বাতাসের গন্ধ শুঁকি না!

একমাত্র মরলেই শ্মশানে বেড়াতে যেতে পারবো, ভাবটা এমন!

জীবনে যারা বাটপাড়ি করে চলে গেছে, তাদের খুন করে যাবজ্জীবন জেলে থাকাও বোধহয় এর চেয়ে সুখের!

আগে জানলে আমার জীবন থেকে সুস্থভাবে তাদেরকে যেতে দিতাম?`

এমন চমৎকার চমৎকার দিনলিপিতে ভরে ওঠে তার নিত্যদিনের উঠান। তিনি যে লেখাটাকে কবিতা বলে চিহ্নিত করেন। সে লেখা অনন্য সাধারণ হয়ে ওঠে। অভূতপূর্ব হয়ে ওঠে। তেমনি একটি কবিতা `ভালোবাসা`

`কবে থেকে তোমায় ভালোলাগে জানো?
ঐ যে কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে
তুমি দেখেছিলে আমি হতাশায় ভেঙে যাচ্ছিলাম,
তুমি দুহাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে নিলে।
আমাকে মাটিতে আছড়ে পড়তে দাওনি।

আমি মনে মনে সেদিন কি বলেছিলাম জানো?
আমি মরে গেলেও যেন এভাবেই ধরে রাখতে পারো!

কবে থেকে তোমায় ভালোলাগে জানো?
ঐ যে একদিন রাস্তায় ফেরার সময় আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছিলো!
তুমি পাগলের মত এদিক সেদিক ঘুরে একটা পলিথিনে জল ভরে আনলে।
তুমি বলেছিলে এর চেয়ে ভালো কিছু পাওনি!

আমি সেদিন মনে মনে কি বলেছিলাম জানো?
হৃদয়ে করেই তো আনতে পারতে,
সেটা তো আকাশ সমান বড়!

কবে থেকে তোমায় ভালোলাগে জানো?
ঐ যে সেদিন প্রখর তাপে আমি ঘামছিলাম..খুব খুব ঘামছিলাম!
তুমি নিজের পিঠ রোদে তুলে দিয়ে আমার পেছনে দাঁড়ালে,
আমার একটু ছায়া লাগবে বলে!

আমি সেদিন মনে মনে কি বলেছিলাম জানো?
তুমি আমাকে যেন সারাজীবন এভাবেই তোমার ছায়ায় রাখতে পারো!

কবে থেকে তোমায় ভালোলাগে জানো?
একদিন তরকারি কুটতে গিয়ে বটিতে আমার আঙুল ফালা ফালা হয়ে গেলো,
তুমি শুনে হাউমাউ করে কেঁদেছিলে!

আমার কাটা আঙুলের রক্ত সেদিন তোমার চোখে দেখেছিলাম জানো?

কবে থেকে বুঝলাম তোমায় ভালোবাসি জানো?
যখন তোমার দৃষ্টি না চাইতেই অনেককিছু বলে দেয়..
এবং সে দৃষ্টি চির নিষ্পাপ, চির পবিত্র!
এতটুকু তো বুঝি কোন চোখটা ঠিক কেমন!

তুমি কোনোদিন চোখ তুলে তাকাতে পারোনি কেন জানো?
কারণ তুমি আমাকে তোমার চেয়েও সহস্রগুণ বেশি ভালোবাসো!

এখন বলো তো!
আগে "ভালোবাসি" বলবে কে?
তুমি? নাকি আমি?`

কী নান্দনিক শিল্প সৌন্দর্য পাই এই কবিতা পাঠে। কল্পনার সীমাহীন রাজ্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসাকে।

তিনি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্ভ্রম হারিয়ে যারা বীরাঙ্গনা হয়েছেন। সেই ধর্ষিতা মায়েদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন `আর্তনাদের ডায়েরি`

`যখন রাত নামে,
আমি আমার আর্তনাদ আরো তীব্রভাবে শুনতে পাই।

রাত এজন্যই আসে,
অতীতকে বারংবার সামনে টানার..
লজ্জার পর্দা নামানোর আর অবকাশ পাই না আমি।

আমি ছটফট করি!
সে ঘৃণার ছবি চোখে ভেসে উঠলে
আমার মনে হয় কত সহস্র রাত্রি ধরে আমি একফোঁটা ঘুমাতে পারি না!

পুরুষ, প্রকৃতি টেনে ধরে রেখেছে তার জৈবিকতা,
একটুখানি ফাঁক পেলেই লাভা উগড়ে দিতে চায়!
সেসব পুরুষের অস্থিমজ্জায় মিশে থাকে যৌনতা,
তারা যাই হোক, অন্তত মানুষ নয়।

আমি নারী বলে ভেবে নিয়েছো আমি মরে আছি,
অথচ মাতৃজঠরের মুখ থেকে বের হবার আগমুহূর্তেও তোমার একথা মনে হয়নি।
তখনও তোমার মা জীবিত।
মরেনি আজো।

নিজের মা ছাড়া সব নারীকে ভোগ করা যায়,
কোন শিক্ষায় তুমি পাপী জানি না,
তবে জেনে রাখো তোমার জননী ঠিক সে মূহুর্তেই ধর্ষিত হয়েছে
যখন তুমি, তোমরা একেক নারীকে ভোগ করায় মত্ত ছিলে।
সে দলে আমিও ছিলাম।

চিনতে পারার কথা নয়,
আমাকে চেনা যায় না।
আমি তো মরে গেছি তখনই,
এখন যা দেখছো সব অস্থিচর্মসার।

তবে এবার আর আমি নারী নই।
আমি জ্বলন্ত চিতার ন্যায় দাউদাউ করে ধেয়ে আসা মহাকাল!

আমি অগ্নিকন্যা দ্রৌপদী, আমি প্রস্তরখণ্ড অহল্যা, আমি চরিত্রবতী সীতা সাবিত্রী কিছুই নই।
আজ থেকে আমার নাম `মৃত্যু`।

আমি তোমার বীর্যঘটিত দেহের অবনত বাসনার অবদমিত রণচণ্ডী,
যা তিলে তিলে তোমাকে টেনে হিঁচড়ে টেনে আনবে জনসম্মুখে।
তোমার লিঙ্গ কর্তনে হবে আমার বিজয়োল্লাস শুরু।

ইতিহাস কখনও প্রতারণা করে না।
তোমাদের মত মানুষ প্রতারণা করতে পারে।

তবে জেনে রেখো, আমি মৃত্যুরূপে এ পৃথিবীর সমস্ত ধর্ষিতাদের একান্ত কামনার ফসল।

আমি প্রতিটি ধর্ষকের প্রতিনিধিত্বকারী মৃত্যু।
আমি মৃত্যু!
আমি মৃত্যু!`

নিজের মধ্যে চেতনার স্ফুরণ না ঘটলে। হৃদয় দিয়ে অনুভব করার শক্তি সৃষ্টি না হলে, এ ধরণের কবিতা সৃষ্টি করা যায় না। যুথী ধর শ্রাবণী সেই চেতনা লালন করেন বলেই এমন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে, এমন দৃঢ়তার সাথে লিখতে পারেন।

নিতি ভালোবাসা নিয়ে লিখেছেন,

`যাকে ভালোবাসবে,
তাকে প্রথম দেখায় নারী কম,
দেবী মনে হবে।

যাকে ভালোবাসবে,
তাকে প্রথম দেখায় পুরুষ কম,
মানুষ মনে হবে।

যাকে ভালোবাসবে,
শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসবে তোমার শরীর।
ঠিক দেবীর সম্মুখে যেমন পুরোহিত,
সোনার প্রতিমায় গড়া মাটির মন্দির!

যাকে ভালোবাসবে,
পৃথিবী একপাশে, অন্যপাশটা হবে একান্ত তার।
প্রার্থনায় থাকবে পবিত্র বাসনা,
তাকে ধরে রাখবার!

যদি ভালোবেসেই থাকো,
তবে তোমার ব্যথায়
আঙুল না তুলে বরং পুড়ে মরে যেও
তার সুখের আশায়!`

ভালোবাসার এমন সংজ্ঞা ক`জন করতে পারে বলুন তো? সবাই পারে না। যারা পারে, তারা কবি হয়ে ওঠে। কাব্যের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ওঠে তাদের চারিপাশ।

তিনি গল্পকার হিসেবেও অনন্য। তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে রচনা করতে পারেন গল্পের প্লট। লিখে ফেলতে পারেন ঝরঝরে বাক্যে খুব সাজিয়ে গুছিয়ে। তিনি একটি গল্প লিখেছেন, `অন্তিম ইচ্ছাপূরণ` শিরোনামে,

`কেউ ফেরেনা খালি হাতে খাজা তোর দরবারে …

সকাল থেকেই গানটা মহল্লায় বাজছে । খাজাবাবার অনেক পুরোনো একদল অনুসারী আছে এখানে । প্রতি শুক্রবারে খাজাবাবার নামে সিন্নি দেওয়া হয় । পাড়ার অনেকেই সেখানে যায় যাদের মধ্যে ফকির মিসকিনের সংখ্যাই বেশি ।

সকাল থেকেই গানটা বাজছে । খুব মন দিয়ে দুই তিনবার গানটা পুরোটা শুনলো আদিত্য । আজ তার বেকার জীবনের ঝাড়া তিন বছর পূর্ণ হলো । সামনে পাহাড়সমান বই খাতা ইয়া লম্বা লম্বা নোট সাজেশন... কত কি করেছে, কত পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু চাকরি হচ্ছেনা তার । ক্লাসের বন্ধুবান্ধব আজ বড় বড় পোস্টে চাকরি করছে অথচ সে ...

না আর ভাবা যাচ্ছেনা , সারাদিন পড়ে পড়ে মাথায় কিছু নেই আর এই পোড়ারমুখো পাড়ার মানুষের পাগলামি ... উফ ! কেউ থামায় না কেন গানটা !

লোকে বলে অভাবে নাকি স্বভাব পাল্টায় ... কি জানি কতোটা সত্যি যদি তাই না হত তবে সে আজ কয় মাস হয়ে গেল , মন্দিরে যায়না কেন ? নাহ ! ঈশ্বরের প্রতি আস্থা রাখে পাগলেরা , যারা কিছু বোঝেনা জানেনা তারাই মাথা একশবার করে ওপর নিচে নামায় । সবাই সব পায় আমিই কেন তবে ...যাই স্নান করে আসি ।

সন্ধ্যাবেলা ...
আদিত্য রাস্তায় ।

অনেক মানুষের হৈচৈ শুনে সে একটু উঁকি দিল । খাজাবাবার নামে ব্যাপক উৎসব চলছে । তাকে দেখতে পেয়ে কে একজন হাতে খানিক সিন্নি তুলে দিল । আদিত্য হাঁ করে আছে , কি করবে ভাবছে তখনই পেটটা খানিক কামড় দিল ... দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি।

সকাল থেকে শুনে আসা সেই গানের দুই চার লাইন মনে পড়লো। হাতে সিন্নি , মাথায় এইসব গানের কলি ... কি করবে কি করবে ভাবছে ঠিক তখনই তার মনের পূর্বসত্ত্বা তাকে যেন ঠেলে ঠেলে বলছে, চেয়ে নে ... কি চাইবি চেয়ে নে ...

ছোটবেলায় বাবার আঙুল ধরে দুর্গাপূজায় ঘোরার কথা মনে পড়ে গেল । বাবা বলতো ঠিকমত প্রণাম করো , মায়ের কাছে মনের সব কথা বলতে হয় বাবা ! মা সবার ইচ্ছা পূরণ করেন।

ছোট্ট আদিত্য হাত জোড় করে কত কি বলতো কত কি চাইতো তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই । এক জোড়া চোখ , হাজার হাজার স্বপ্ন !

হাতের সিন্নির ওপর কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো ...সম্বিৎ ফিরে অবাকই হলো কিছুটা । একি আমি কাঁদছি !

তোমাকে খুব বিশ্বাস করি ঈশ্বর , আমি জানি তুমি আছো । সবরূপে সবখানে যদি তুমিই থেকে থাকো আমি কেন তবে বঞ্চিত হচ্ছি বলতে পারো ! কিছুই তো দাওনি জীবনে , একটা শান্তির মৃত্যু দিতে পারো ?

পরের সপ্তাহ , শুক্রবার ...

অনেকদিন পর সময় নিয়ে স্নান করল আদিত্য । যাই আজ একটু মন্দিরেই যাই , মেসে কিছুই রান্না হয়নি ... সেখানে গেলে অন্তত দুপুরের ভোগের প্রসাদটা খাওয়া যাবে । সাতপাঁচ ভেবে হেঁটে হেঁটে বড় রাস্তাটায় উঠলো সে । নাহ এইবার পরীক্ষাটায় আমাকে ভালো করতেই হবে , বয়স যে আর বেশিদিনের নেই ! চাকরিটা একান্তই না পেলে পরে কি করবো আমি ! ভাবছে ভাবছে ঠিক এমন সময় ..

একটা ভারী গোছের লরি ঠিক তার বুকের ওপর দিয়ে চলে গেল ।

একবার তীব্র গোঙানি ...
না থাকলো চোখ , না থাকলো একগাদা স্বপ্ন ।
না থাকলো মন , না থাকলো বড় হবার ইচ্ছা ।

দূরের একটা ভাঙা মাইকের অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে

কেউ ফেরেনা খালি হাতে খাজা তোর দরবারে ...`

গল্পটি পড়ে আপনাদের কেমন লাগল? নিশ্চয় ভালো লেগেছে? ভালো লাগবারই কথা। তিনি নান্দনিক শিল্প সৃষ্টিতে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। আজ তার জন্মদিনে তার লেখক জীবনের সফলতা কামনা করছি। অনন্য হয়ে উঠুন আপনি। আপনার আলোয় আলোকিত হোক বিশ্ব চরাচর।