
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ১৬
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ১৩, ২০১৯
বিনোদন-সাহিত্যের যুগ বোধহয় শেষের পথে। কারণ বিনোদনের অসংখ্য উপায় এখন সর্বস্তরের মানুষের হাতের মুঠোয়। বিনোদনের জন্য বই পড়ার দরকার তার আর নেই। বিমল-ফাল্গুনী-নীহাররঞ্জন-নিমাই-সুনীল-শীর্ষেন্দু-হুমায়ূনদের পথ ধরে কতজনই তো চেষ্টা চালালেন। (নামগুলো একসারিতে বলে যাওয়া কেবলমাত্র বাণিজ্যসফলতার দিক থেকে)। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেনও। আনন্দবাজার-দেশ-প্রথম আলো কতজনকেই তো প্রমোট করল। কিন্তু কেউ আর সেই ব্যবসা এনে দিতে পারলেন না এখন পর্যন্ত। ধারে-কাছেও পৌঁছাতে পারছেন না। একটা কারণ হতে পারে, আগেকার বিনোদন-লেখকদের সমান প্রতিভা নতুনদের নেই। তবে দ্বিতীয় কারণটিই প্রধান। যার কথা আগেই বলেছি। বিনোদন হিসাবে বই এখন আর অপরিহার্য নয়।
আগে মা-খালা-ভাবিরা সংসারের কাজ সেরে সবাইকে খাইয়ে নিজে দুমুঠো খেয়ে বিছানায় গড়াতে গড়াতে একটি হালকা উপন্যাস মেলে ধরতেন চোখের সামনে। এখন তারা স্যাটেলাইট টিভির অনেক চ্যানেল সার্ফিং করেন। ট্রেনে-বাসে-স্টিমারে-বিমানে ওঠার সময় একটা উপন্যাস সাথে নিতেন অনেকেই। এখন বইয়ের বদলে স্মার্টফোন। বিনোদনের বই বা সময় কাটানোর বই এখন আর প্রয়োজনীয় নয়।
আনন্দ এবং বিনোদনের মধ্যে ফারাক যোজন যোজন। একবার একটি টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশের সরকারি ক্ষমতাবলয়ের খুব প্রভাবশালী একজন লেখিকার সাথে কিঞ্চিৎ বাহাস হয়েছিল আমার। তাকে আমি ‘বিনোদন’ আর ‘আনন্দ’— এই দুইয়ের পার্থক্য বোঝাতেই পারলাম না। বোঝাতে পারলাম না যে, বিনোদন দেবার জন্য যে বই লেখা হয়, যে সিনেমা-নাটক বানানো হয়, যে নাচ বা গান উপস্থাপন করা হয়, সেগুলো ফ্যাক্টরিতে তৈরি জিনিসের মতো একটি প্রডাক্ট। ১৯৭৩ সালে আমেরিকায় ‘কালচার ম্যানুফ্যাচারিং প্রজেক্ট’ শুরু করা হয় সরকারের বিশেষ ব্যবস্থাপনায়। বিনোদন হচ্ছে সেই জিনিস যা ভোক্তা উপভোগ করবে, কিন্তু তা তাকে ভাবাবে না, তার মনে কোনো চিন্তা বা প্রশ্নের উদ্রেক করবে না। এবং উপভোগ করার পরে সে সিনেমা-নাটক-বইটির কথা ভুলে যাবে। শিল্প যেখানে দর্শক বা পাঠকের মনে প্রশ্ন তৈরি করে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য তাকে ব্যাকুল রাখে, বিনোদন শিল্প সেখানে তাকে সবধরনের ভাবনা থেকে মুক্ত রাখবে। সে হবে ‘নিষ্ক্রিয় ভোক্তা’। বিনিময়ে যে পয়সা সে ব্যয় করবে, তা দিয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠবে কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি। আসলে সেটি একটি কমার্শিয়াল ইন্ডাস্ট্রিই বটে।
কিন্তু সত্যিকারের সাহিত্য-শিল্পের সংস্পর্শে এসে পাঠক-দর্শক লাভ করবেন আনন্দ। বিনোদন মনের উপরিতলের জিনিস। আনন্দ সেখানে মনের গভীরতর প্রদেশে অবস্থান করে। সেখান থেকেই সাহিত্য তাকে সামনে নিয়ে আসে। পাঠক আনন্দ লাভ করেন নিজেকে চিনতে পারার সূত্র খুঁজে পেয়ে। আবার রক্তাক্ত হতে থাকেন নিজেকে আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত হতে দেখে। যে সাহিত্য বা শিল্প পাঠক-দর্শককে ওষুধ খাইয়ে ঘুম আনার মতো আপাতত বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ জীবনের যুদ্ধ থেকে সরিয়ে এনে কিছুক্ষণের জন্য উপশমের স্বস্তি এনে দেয়, তা আসলে সাহিত্য বা শিল্প পদবাচ্য নয়।
আনন্দকে বলা হয় ‘ব্রক্ষ্মস্বাদ সহোদরম’। নিজেকে চেনার আনন্দ। সাহিত্যের কাজ হচ্ছে মানুষের একেবারে ভেতরের মানুষটিকে বের করে এনে তার নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া। যে সাহিত্য এই কাজটি করতে পারে, সেই সাহিত্যের বিলুপ্তির কোনো আশঙ্কা নেই। বিনোদন-সাহিত্যের এই বিদায়বার্তা মানে কি বইপড়া উঠে যাওয়া? উত্তরটা আসলে ঠিক উল্টো। মানুষ বই পড়বেই। বই পড়ে চলবেন সত্যিকারের পাঠকরা। তারা পড়বেন সত্যিকারের সাহিত্য, সত্যিকারের চিন্তামূলক বই, বিভিন্ন বিষয়ের গবেষণামূলক বই, ইতিহাসকে নতুন ব্যাখ্যায় উদ্ভাসিত করে লেখা বই, দার্শনিকতা এবং দার্শনিক বিতর্ক নিয়ে লেখা বই, গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন সভ্যতাকে আলো দেখানোর জন্য লেখা বই, সত্যকে আরো স্পষ্ট করে তুলে ধরে লেখা বই। চলতি ভাষায় আমরা যেগুলোকে সিরিয়াস বই বলি, সেগুলোর বিক্রি বাড়ছে ক্রমান্বয়ে।
সেইসাথে বইয়ের লেখকও বিবেচিত হবেন বইয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে। অসৎ লেখকের উপদেশেভরা বই পাঠক ছোঁবেন না। কারণ বই এমন একটি জিনিস, যেখানে লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের সততা এবং অন্ধকার— দুটোরই ছাপ পড়ে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে যারা অসততাকে অবলম্বন করেছেন, তারা যত পরিশ্রম করেই বই লিখুন না কেন, সেই বই পাঠক হাতে নেবেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্ফোরণের যুগে কোনো লেখক বা ব্যক্তি নিজেকে সম্পূর্ণ আড়ালে রাখতে পারেন না। সংবাদকর্মী হয়তো তার কাছে পৌঁছাতে পারছে না। কিন্তু তার প্রতিবেশী বা অফিসের কলিগ অথবা তার দ্বারা নিগৃহীত ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়াতে ঠিকই তার চরিত্র এবং কর্মকাণ্ড তুলে ধরছে। অথবা তুলে ধরবে। সৎকর্ম এবং অপকর্ম— দুটোই।
এখনই এইসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। শুধু লেখা নয়, লেখকও এখন উঠতি-পড়তির মধ্যে চলে এসেছেন। তিনি আপস করছেন নাকি লড়াই করছেন, দালালি করছেন নাকি ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেছেন, সত্য গোপন করছেন নাকি সত্য প্রকাশ করছেন, তিনি সাহিত্যের সংগঠক নাকি সাহিত্যের ঠিকাদার, তিনি দেশের মানুষের জন্য আন্তরিক আন্দোলন করছেন নাকি বিদেশের টাকায় তাদের প্রেসক্রিপশনের বাস্তবায়ন করছেন, তিনি কি নিজের অন্তরের ভাষায় কথা বলেন নাকি বিদেশি দাতাসংস্থার শেখানো বুলি আউড়ে চলেন— সবকিছুই বিবেচিত হচ্ছে পাঠকের কাছে। সোস্যাল মিডিয়ার অনেক খারাপ দিকের কথা বলা হয়। তার সদর্থক দিকও অনেক।
আমাদের শহরের গণেশ পাল খুব নিবেদিত কবিতার লেখক। নিজের পয়সায় গুটিকয়েক কবিতার বই ছেপেছেন। একুশের বইমেলাতে গিয়ে মোড়কও উন্মোচন করে এসেছেন। কিন্তু বই তো বিক্রি হয় না। চরম হতাশ। আমার কাছে জানতে চাইলেন, তোমার বই প্রকাশকরা নেয়, আমারটা নেয় না কেন? তোমাকে প্রকাশকরা টাকা দেয়, আমার কাছে টাকা চায় কেন? উত্তর দিলাম, প্রকাশকরা তো তার বই ছাপবে, যার বই থেকে তার লগ্নিকৃত টাকা উঠে আসবে। কার বই? যার পরিচিতি আছে লেখক হিসাবে। কীভাবে ঘটে পরিচিতি? দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা ছাপা হলে সেই লেখকের নামটি চোখে পড়ে প্রকাশকদের। তারা সেই লেখকের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি চান।
গণেশদা মলিন মুখে বললেন, কিন্তু আমার লেখা কোনো পত্রিকা ছাপে না যে! আমি বললাম, হতাশ না হয়ে আপনি সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রাই করে দেখতে পারেন। আমি কিন্তু ঠাট্টা করিনি। যদি গণেশদার লেখাতে সত্যিকারের সারবস্তু থেকে থাকে, তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে তা কারো-না-কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে আশা করা যায়। গণেশদা বিরসমুখে বললেন, ফেসবুকের কথা বলতিছ তো? ওই জাগাতও খালি দলাদলি। দলের লোকেরা একজনকে মহাকবি বানায়, দলের লোকেরাই আরেকজনকে মহাপুরুষ বানায়। কত ভূয়া কবি ফেসবুকের দলবাজির মাধ্যমে বড় কবি হয়ে গেছে? আমি খুব দৃঢ়তার সাথে বলি, অনেক ভালো লেখক-কবি হারিয়ে গেছেন গণেশদা। এই জিনিসটা ঘটে। সবকালে সবদেশেই ঘটে। কিন্তু আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি, কোনো গুণহীন লেখক বা কবি, যত বড় দল সাথে নিয়েই মাঠে নামুক না কেন, তার হাতে যত টাকা, যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, সে টেকেনি অতীতেও। ভবিষ্যতেও টিকবে না। টিকবে না! টিকবে না! বর্তমানকে বড়জোর কিছুটা বিভ্রান্ত করতে পারবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক