
লেভ তলস্তয়
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ১৯
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ১৭, ২০১৯
১৯০১ সালে চালু হওয়া নোবেল পুরস্কার তলস্তয়কে দেওয়া হলো না। নোবেল কমিটি কারণ হিসাবে বললেন, ‘তলস্তয় যথেষ্ট খ্রিস্টান নন।’ ধর্মকে নিজেদের বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নানামুখি ব্যবহারের একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে তলস্তয়কে নোবেল পুরস্কার না দেওয়া। এতে তলস্তয়ের কোনো ক্ষতি হয়নি। তলস্তয় এখনো প্রচণ্ড জীবিত একজন লেখক। নোবেল কমিটি যাকে পুরস্কার দিয়েছিল, যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায়, সেই স্যালি প্রুধোমের নামটা কেবল দলিল-দস্তাবেজেই রয়ে গেছে।
তলস্তয় নিজেও তার আগেই চার্চের ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছেন। চার্চের সদস্য পদ ত্যাগ করেছেন। চার্চও তাকে বহিষ্কার করেছে। তবু তলস্তয় কিন্তু নিজেকে সত্যিকারের খ্রিস্টানই মনে করতেন। মনে করতেন তিনিই খ্রিস্টের সঠিক অনুসারী। এখানেই ধর্মবিদদের সাথে বা সাধারণ ধর্মানুসারীদের সাথে একজন সত্যিকারের গভীর চিন্তাশীল মানুষের পার্থক্য। তার কাছে ধর্ম বা ইশ্বর অন্যদের মতো রেডিমেড পাওয়া কোনো বিষয় নয়। তার চিন্তায় যে ইশ্বর ধরা দেন, তিনি মোল্লা-পাদ্রিদের ইশ্বর হন না সচরাচর।
রবীন্দ্রনাথের ইশ্বরকেও কি কেউ চিনতে পেরেছেন ঠিকমতো? কত গবেষকই তো পিইচডি করলেন রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তা-ইশ্বরচিন্তা নিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ইশ্বর বলতে ঠিক কী বুঝতেন, তা ধরা পড়েনি কোনো গবেষণাতেই। গবেষকরা নিজেদের ইশ্বরকে বানাতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ইশ্বর। বেঁচে থাকলে কবি হয়তো শুধু মৃদু হাসতেন। তিনি নিজেও তো পরিষ্কার করে যাননি। এটাও পরিষ্কার করে যাননি যে, ইশ্বর হিসাবে কোন সত্তাকে তিনি মান্য করতে শুরু করেছিলেন জীবনের শেষ পর্বে এসে। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, তিনি নিজেও কি শেষ পর্যন্ত উপনীত হতে পেরেছিলেন কোনো স্থির সিদ্ধান্তে? তার ইশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে?
তাহলে দেখা যায়, যে ইশ্বর নিয়ে কোটি কোটি মানুষ জীবন কাটিয়ে দিতে পারে অনায়াসে, যে উপাসনাবিধিকেই সঠিক এবং পরিবর্তনহীন জেনে অনুসরণ করতে পারে শত কোটি মানুষ, সেই ইশ্বর এবং উপাসনাবিধি কারো কারো কাছে যথেষ্ট মনে হয় না। অনেকেই এই ভিন্নতার কারণে নতুন উপধর্ম প্রবর্তন করেন, নতুন মজহাব তৈরি করেন। সেই কারণেই ইসলামে ৭৩ ফেরকা, হিন্দু ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন দেবতার শরণ, খ্রিস্টানধর্মে অনেক উপদল।
তলস্তয় বা রবীন্দ্রনাথরা কোনো ধর্ম-উপধর্ম প্রবর্তন করে যান না। তবে জানিয়ে যান, প্রচলিত কোনো ধর্মপথ এবং ইশ্বরভাবনা তাদের নিজেদের কাছে যথেষ্ট মনে হয় না, যথেষ্ট আপন মনে হয় না, যথেষ্ট নিজের মনে হয় না। তাদের আত্মার পিপাসা মেটে যে ইশ্বরের সন্নিধানে, যে ইশ্বরের কল্পনায়, সেই ইশ্বর প্রচলিত ধর্মের ইশ্বর নন। তারা তাই নিজেদের ইশ্বরের স্বরূপ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না, আবার প্রচলিত পথের সামনে কালাপাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েও যান না, আবার প্রচলিত পথে নিজেকে সঁপেও দেন না।
বিবেকানন্দ বলেন, যে ইশ্বর বিশ্বের সকল মানুষকে রুটি দিতে পারে না, তার উপাসনা পাওয়ার অধিকার নেই। বিবেকানন্দ ধর্মগুরু। তাই হয়তো তিনি এই রকম কথা বলেও পার পেয়ে গেছেন। ধর্মগুরুর পদেই আসীন আছেন এখনো। কিন্তু এই একই কথা যখন কার্ল মার্কস বা সমাজ পরিবর্তনের যোদ্ধারা বলেন, তখন সারা পৃথিবীর সব ধর্মের পাণ্ডারা একত্রিত হয়ে তেড়ে আসেন তাদের কতল করতে। বামপন্থিরা বলতে চান যে, কোটি কোটি মানুষের অনাহারের কারণ হিসাবে ইশ্বরের দোষ ধরার দরকার নেই। কারণ এই মানুষগুলোকে অনাহারে রেখেছে অন্য এক শ্রেণির মানুষই। তারা এমনভাবে সমাজের সম্পদগুলো নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করে রেখেছে, যা সম্পূর্ণ নষ্ট অর্থনীতির মেকানিজম। এখানে ইশ্বরের কোনো অদৃশ্য হাত নেই। সেই হিসাবে বলা যায়, বামপন্থিরা বরং দোষারোপের হাত থেকে রক্ষা করতে চান ইশ্বরকে।
তবু জনগণের কাছে বামপন্থিরা ইশ্বরের বিরোধী, আর যে মোল্লা-পুরুতরা শোষণকর্মের সহযোগী হিসাবে ভূমিকা পালন করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে, তারাই নাকি ধর্মের রক্ষক! কোনো ব্যক্তি সমাজের জন্য ভালো কোনো কাজ করছেন কিনা তার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিনি ইশ্বরে বিশ্বাসী কি না। ডারউইন বিবর্তনের তত্ত্ব প্রকাশ করার পরে এক কবিবন্ধু আকুল হয়ে ছুটে গেলেন তার কাছে। তত্ত্বটি সঠিক বা বেঠিক তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুললেন না। বারবার শুধু জানতে চাইলেন, চার্লস, তুমি কি ইশ্বরে বিশ্বাস করো? পুন: পুন: তাগাদার ফলে ডারউইন উত্তর দিয়েছিলেন, হ্যাঁ আমি ইশ্বরে বিশ্বাস করি। তখন প্রশ্ন এলো, তাহলে এই তত্ত্ব কীভাবে প্রচার করতে পারলে তুমি? ডারউইন হেসে বললেন, ইশ্বর নিজে সরাসরি কিছু করেন না। তিনি অনেকগুলি চেইন অব অর্ডার তৈরি করে দিয়েছেন। সেই চেইন অনুযায়ী সবকিছু হয়। ইশ্বর চাইলেও সেই চেইনটা ব্রেক করতে পারেন না। তাহলে অনর্থ ঘটে যাবে। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবও সেই চেইন অনুযায়ীই ঘটেছে। বিবর্তন এখনো চলছে। সেটাও ঘটছে ইশ্বরের নির্ধারিত সেই চেইন অনুসারেই।
অনেক আগে ড. ইব্রাহীমের সম্পাদনায় মাসিক ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ (বিজ্ঞান সমায়িকীও হতে পারে নাম) পত্রিকা প্রকাশিত হতো। বিজ্ঞানকে সাধারণ পাঠকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলবার জন্য অনেকখানি ভূমিকা পালন করেছে পত্রিকাটি। তার কোনো এক সংখ্যায় পড়েছিলাম ড. কুদরত-ই-খোদার লেখা বিবর্তন বিষয়ক একটি বড় রচনা। তিনিও বিবর্তনকে ইসলামসম্মত বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। বলার বিষয় হচ্ছে, একই ধর্মের অনুসারী মানুষের কাছে ইশ্বরের রূপ এক না-ও হতে পারে। জালালউদ্দিন রুমীর ইশ্বর, গালিবের ইশ্বর, মনসুর হাল্লাজের ইশ্বরের রূপ এক নয়। আবার ওমর খৈয়ামের ধর্মপালনের তরিকা অন্য সবার মতো ছিল না। ইবনে সিমা, ওমর খৈয়ামকে মোল্লারা বারবার দেশান্তরিত হতে বাধ্য করেছে তাড়িয়ে বেরিয়েছে মুসলিম সাম্রাজ্যের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত।
যে বিজ্ঞানী জীবনভর কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে মারাত্মক সব রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছেন, মানবজাতিকে মুক্ত করেছেন রোগের কষ্ট-বেদনা থেকে, আবিষ্কার করেছেন পৃথিবী থেকে বিভিন্ন রোগ নির্মূল করার টিকা-প্রতিষেধক, তিনি বেহেশতে যেতে পারবেন না মুসলিম নন বলে। অন্যদিকে যে লোক সারাজীবন সমাজের বোঝা হয়ে থেকেছে, সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে আরো বাড়িয়েছে সমাজ ও দেশের বোঝা, সেই লোক জন্মসূত্রে মুসলিম হবার সুবাদে তসবি টিপে বেহেশতে চলে যাবে— ইশ্বরকে এতখানি যান্ত্রিক সত্তা ভাবতে অনেকেরই আপত্তি আছে। এইসব কারণে অনেক চিন্তাশীল মানুষই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে অবস্থান করেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মাধ্যমে যাদের আয়-রোজগার চলে, যারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকেই রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে সবসময়, অর্থাৎ ধর্মই যাদের একমাত্র ব্যবসায়িক এবং বৈষয়িক পুঁজি, তারা তো সবধরনের চিন্তাশীলতার বিপক্ষে অবস্থান নেবে তা তো জানা কথাই।
এই পর্ব লেখার সময় আমার টেবিলে আঁদ্রে জিদের উপন্যাস ‘প্যাস্টোরাল সিম্ফনি’। এক অন্ধ তরুণীর প্রতি একজন পাদ্রির জটিল আকর্ষণ-কেন্দ্রিক উপন্যাস। হঠাৎ-ই মনে পড়ল, ভ্যাটিকানের সুপ্রিম ধর্মীয় কাউন্সিল ১৯৫২ সালে আঁদ্রে জিদের মৃত্যুর একবছর পরে এই লেখকের সব রচনাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। অথচ বইটা এখন আমি পড়ছি। পোপ আর তার নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিল্প তার নিজের অবস্থান ঠিকই তৈরি করে নিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নেতারা শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-চিন্তাবিদদের জীবনে কম বিপর্যয় ঘটান না। কম কষ্টের কারণ হন না। কিন্তু দশ-বিশ-পঞ্চাশ-একশো-হাজার বছর পরে হলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন সাহিত্যের কাছে, চিন্তাশীলতার কাছে।
শাস্ত্র চিরকালই হার মেনেছে শিল্পের কাছে। কারণ শাস্ত্রের চাইতে শিল্প অনেক বেশি মানবিক। কারণ শাস্ত্র বিচারক, আর শিল্প হচ্ছে মানুষের হাত ধরে অচেনা পথে হাঁটার সঙ্গী। শাস্ত্র বলে, তোমার গতিবিধি ও চিন্তার পরিধি বেঁধে দেওয়া আছে। আর সাহিত্য বলে, তুমি তোমার কল্পনাকে বিস্তৃত করো অসীম থেকে অসীমে। জীবনের বিস্তার ঘটাও দিকে-দিগন্তরে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক