রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ২০

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : মে ২২, ২০১৯

তখন একাদশ বা দ্বাদশ ক্লাসে পড়ি। পিলখানার মোড়ে ওহিদ চাচার প্রেসের সামনে দিয়ে কয়েকদিন ধরে যাচ্ছি না। একুশে ফেব্রুয়ারিতে পত্রিকা বের করেছিলাম। প্রেসে টাকা বাকি আছে। ওদিকে যেতে হলেও চেষ্টা করি সুরুৎ করে ওহিদ চাচার প্রেস পার হয়ে যেতে। কয়দিন আর এভাবে পার পাওয়া যায়! ঠিকই তিনজন চোখে পড়ে গেলাম ওহিদ চাচার। চাচা ডাকছে, আরে ও বাবারা কই যাও! আসো আসো ভিতরে আসো। চাচা-ভাতিজারা মিলে এক টাকার চানাচুর আর চা খাই, আসো!

কাঁচুমাচু হয়ে বলি, যাচ্ছি এমদাদ ভাইয়ের কাছে। বিজ্ঞাপনের টাকাটা পেলে আপনের...
ওহিদ চাচা বলেন, আরে যাবে যাবে। এখন একটু বসো। চা খাই একসাথে।
ভেতরে ঢুকে বসতে হয়।
ওহিদ চাচা আঙুল তুলে চাতালের দিকে ইঙ্গিত করেন, ওই দ্যাখো ওই জাগাত বান্ডিল বান্ডিল পোস্টার জড়ো করা আছে।
কীসের পোস্টার?
সেই ১৯৬৫ সালে থেকে এই নাটোরে যতজন ভোটে দাঁড়াইছে, এমপি থেকে মেম্বার পর্যন্ত— সবার পোস্টার আছে।
আমরা বুঝতে পারি না এই কথার তাৎপর্য।
ওহিদ চাচা বলেন, বুঝতে পারলে না? সবাই পোস্টার ছাপিছে। কিছু নিছে। আর বাকিগুলান পড়ে আছে। পুরা টাকা কেউ শোধ করেনি।
আমরা একটু কুঁকড়ে যাই।
ওহিদ চাচা আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, আরে বাবা তোমরা ছাওয়াল-পাওয়াল মানুষ, ফেব্রুয়ারি মাসে পত্রিকা বার করিছো, ভালো একটা কাম করিছো। চুরি তো আর করোনি। টাকা বাকি আছে, তা থাকুক। যখন জোগাড় করতে পারবে তখন দিবে। তাই বলে এখন পালায়া পালায়া থাকার দরকার নাই। খাও চানাচুর খাও!
ওহিদ চাচার লেটার প্রেস। তখনো অফসেট বা কমপিউটারে ছাপার কথা কেউ জানে না নাটোরে।
চাচা চায়ে চুমুক দিয়ে জিগ্যেস করেন, আজকের পেপার পড়িছো?
না। এখনো পড়িনি।
তাহলে তো দুর্দান্ত একটা কবিতা চোখে পড়েনি তোমাদের।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী বের হবার দিন। ওহিদ চাচা সংবাদ সাময়িকী চোখের সামনে মেলে ধরেন। তারপর কী মনে করে বলেন, দাঁড়াও, ফজলু মিয়ারে ফোন করি। কবিতাডা শুনাই। ঘটাং ঘটাং করে ডায়াল ঘুরিয়ে ফোন করেন তিনি ইউনাইটেড মেডিক্যাল হলের ফজলু চাচাকে। ওপার থেকে ফজলু চাচা রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ওহিদ চাচা দরাজ কণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন, ‘চুদির ভায়েরা সদা সর্বদা ঘোঁত ঘোঁত করতে বড় বেশি ভালোবাসে।’
ফজলু চাচা একটু চমকে যান বোধহয়, এইডা আবার কী?
ওহিদ চাচা বললেন, কী মানে? কবিতা। বড় কবির লেখা কবিতা। আজকের সংবাদে ছাপা হইছে। দ্যাখোনি? পড়ো পড়ো। পুরাডা আমি পড়ে শুনাতে পারব না। ছোট ছাওয়ালরা সামনে বসে আছে।
এরপরে ওহিদ চাচা ফোন লাগান আহমদ প্রিন্টিং প্রেসের আহমদ চাচাকে। রিসিভার তুলতেই, ‘চুদির ভায়েরা সদা সর্বদা ঘোঁত ঘোঁত করতে বড় বেশি ভালোবাসে।’

আহমদ চাচার প্রতিক্রিয়াও ফজলু চাচার মতোই। আমরা পরে দেখতে পাই পুরো কবিতাটি। রফিক আজাদের কবিতা। রফিক আজাদ তখন আমাদের কাছে হিরো। বিশেষ করে টিটু, মানে, আশীক রহমান তো রফিক আজাদের প্রায় সব কবিতা মুখস্ত রাখে। আমরা কেউ কবিকে চোখে দেখিনি। দেখার কোনো সুযোগও ছিল না। মনে মনে আমরা রফিক আজাদের একটি ছবি কল্পনা করে রেখেছিলাম। লম্বা একহারা দেহ, পরনের পোশাক অনেকটাই মুক্তিযুদ্ধফেরত যুবকদের মতো, সিগারেট জ্বলছে ঠোঁটের কোণে, কাউকে পরোয়া না করে হেঁটে চলেন ঢাকার রাজপথ দিয়ে, কথা বললে গমগম করে ওঠে স্বর। কল্পনার সঙ্গে কিছুই মেলেনি অবশ্য। প্রথম দেখাতে বরং একটু হতাশই হয়েছিলাম। এমনকী তাঁর গোঁফও ঠিক মানানসই মনে হয়নি।

তা হোক। রফিক আজাদ তো রফিক আজাদই। রফিক আজাদ মানে তো রফিক আজাদের কবিতা। সেইদিক দিয়ে গুরু সত্যিই আকর্ষণীয়। অমন প্রেম, অমন ক্ষোভ, সরাসরি আক্রমণ আর কারো কবিতাতে তো নেই। জনগণের ওপর কবির এই ক্ষোভ কেন? কারণ তারা সমস্ত অনিয়ম, অবিচার, অত্যাচার মেনে নিয়েও নিশ্চুপ থাকে। ফুঁসে ওঠে না। ‘কেন লিখি’ কবিতাতেও রফিক আজাদ লিখছেন যে নির্বিকার মধ্যবিত্তের মাংসল পাছায় লাথি মারতে পারছেন না বলেই লাথির বিকল্প হিসাবে তার লেখালেখি। শুধু রফিক আজাদ নয়, আরো অনেক কবি-সাহিত্যিক জনগণের নিষ্ক্রিয়তায় ক্ষুব্ধ হতাশ। অনেক আগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় দুর্ভিক্ষের সময় না খেতে পাওয়া মানুষের ঢল দেখেছেন। তারা ভাতের বদলে ফ্যান চেয়ে চেয়ে ঘুরছে বাড়ি বাড়ি। না খেতে পেয়ে মরে পড়ে থাকছে রাস্তায়। অথচ পাশেই খাবারের দোকানে থরে থরে সাজানো লোভজাগানিয়া খাদ্যের সমাহার। মানিক সক্ষোভে গল্প লিখলেন ‘কেড়ে খায় না কেন?’ মানুষের নির্বিকারত্ব দেখে মাঝে মাঝে আমার নিজেরও গা রি রি করে ওঠে ঘৃণায়। জনগণের দাস-মানসিকতা দেখে কোনো কোনো অতিবিপ্লবী দল তো ঘোষণাই দিয়ে দিয়েছিল—
হারামজাদা জনগণ
তোরা কর নির্বাচন
আমরা গেলাম সুন্দরবন।

এইসব ক্ষোভ আসে জনগণ সম্পর্কে ভুল ধারণা থেকে। আমাদের ধারণা মানুষ গরিব বা শোষিত হলেই প্রতিবাদী হয়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটতে না দেখে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। আসলে মানুষ নিজে নিজে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে না। প্রতিবাদের শিক্ষা, আদর্শ বা রাজনীতিতে শিক্ষিত হয়ে না উঠলে কেউ প্রতিবাদী হতে পারে না। এই জনগণ হচ্ছে নিছকই একটি জনসমষ্টি। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তারা দিন কাটায়। তারা প্রতিদিন হয়ে ওঠে আরো ব্যক্তিত্বহীন, লোভী, মনুষ্যত্বহীন। নিতান্ত তুচ্ছ জিনিস বা সাহায্য পাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। জাকাতের কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে ভিড়ের চাপে পদদলিত হয়ে মরে। তাদের কাছে কেবলমাত্র সেই মানুষটি গুরুত্বপূর্ণ যে তাদের ক্ষতি করতে পারে বা সরাসরি ভিক্ষা দিতে পারে। নীতিবান মানুষ তাদের কাছে শ্রদ্ধেয় হলেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ তাদের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলার ক্ষমতা নীতিবানদের নেই। তারা ভোটের সময় কোনো বাছবিচার করতে শেখে না। কে কত টাকা দিল সেটাই তাদের মানদণ্ড। কারণ ভোটের পরে তারা তো নির্বাচিত ব্যক্তির কাছে ভেড়ার সুযোগই পাবে না। কাজেই যা পাওয়া যায় ভোটের আগে ততটুকুই লাভ। রোজকার দারিদ্র্য, দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্য মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে দেয় না। সে জানেই না যে তার মানুষ হয়ে ওঠার একটি দায় আছে।

আর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জন্মই নেয় আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর হয়ে। তারা ন্যায়-অন্যায় বোঝে। কিন্তু মেনে চলতে সক্ষম নয়। নিজের লাভের জন্য তারা জন্মদাত্রী মাতাকেও বন্ধকী রাখতে পারে। সে জানে যে তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি অসীম নয়, কিন্তু যতটুকু সম্ভব ততটুকু ওঠার জন্য যা করা দরকার সবটুকুই করতে রাজি সে। এরা ‘ঘুষ এবং নামাজ-রোজা’কে এক তোরঙ্গে ঢুকিয়ে নিয়ে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারে। সর্বোপরি এরা হচ্ছে সবসময় প্রচলিত পথের যাত্রী। নতুন পথ মানেই এদের কাছে ভয়ের বস্তু। এদের কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে সৎ থাকার চেষ্টা করে কিন্তু ‍সিস্টেমের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় বলে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে, জনগণের বিপক্ষেই কাজ করে চলে। এরা জানে যে তর্কের চাইতে আত্মসমর্পণ, ব্যক্তিত্বের চাইতে পা-চাটা স্বভাব তাকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছাতে বেশি সাহায্য করবে। তাই এরা হয়ে ওঠে নিপুণ তোষামোদকারী, ব্যক্তিত্বহীন, বিবেকহীন, মেরুদণ্ডহীন।

এই ধরনের কোটি কোটি জনসমষ্টিকে মানুষ বানানো খুব সহজ কোনো কাজ নয়। কারণ সমাজ-রাষ্ট্র-সরকার-আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা চায় না তারা মানুষ হয়ে উঠুক। এরা মানুষ নয়, নিছকই জনতা, তবু বোধহয় সুধীন দত্ত-র মতো আমাদের বলা উচিত নয়— ‘সহে না সহে না আর জনতার জঘন্য মিতালী’। কারণ জনগণকে বাদ দিলে লেখক-কবির নিজেরও দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকে না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক