
ফাইল ছবি
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ২১
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ২৩, ২০১৯
লেখকদের কখনো কখনো এমন কিছু পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় যা অগ্নিপরীক্ষার চাইতেও অনেক বেশি কঠিন। এই পরীক্ষাগুলো অন্য মানুষদেরও দিতে হয়। তবে তারা পরীক্ষা দিলেন কি না, দিলেও উতড়াতে পারলেন কি না তা নিয়ে নিজের কাছে জবাবদিহি করতে হলেও অপরের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু লেখকদের সেটি করতে হয়। তৎক্ষণাৎ না হলেও অনাগত সময়ের কাছে জবাবদিহি করতেই হয়।
আমরা দেশের শাসকদের মুখে সবসময় একটা কথা শুনি, যা তারা কখনোই পালন করেন না, তা হচ্ছে— ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে বড় দেশ।
লেখকদের কাছে কখনো কখনো দেশের চেয়েও বড় মানবতা। এবং এই পরীক্ষা যুগে যুগে দিয়ে আসছেন লেখকরা। জাঁ পল সার্ত্রে বা আলবেয়ার কামুর উদাহরণটিই প্রথমে দেয়া যাক। আলজিরিয়া ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। সেখানে স্বাধীনতার জন্য অন্দোলন চলছিল। আর ফ্রান্স সেই আন্দোলন দমন করার জন্য যত রকম নৃশংসতা সম্ভব সবই চালিয়ে যাচ্ছিল। সার্ত্রে প্রকাশ্যেই সমর্থন জানালেন আলজিরিয়ার স্বাধীনতার দাবিকে। নিন্দা জানালেন নিজের দেশের। দেশজুড়ে তখন রব উঠল, সার্ত্রে দেশদ্রোহী। মাতৃভূমির অযোগ্য সন্তান। পত্র-পত্রিকায় তাঁর নিন্দাবাদ জানিয়ে লিখিত হচ্ছিল অজস্র কলাম-সম্পাদকীয়। সার্ত্রে সেগুলোর উত্তর দেবার প্রয়োজনও মনে করেননি কখনো। উল্টো গোপনে টাকা পাঠাতেন আলজিরিয়ার বিপ্লবীদের সাহায্য করার জন্য। টাকা পাঠাতেন আলবেয়ার কামুও।
এ এমন এক পরীক্ষা যেখানে সমস্ত জাতির বিপক্ষে দাঁড়াতে হয় লেখককে সেই জাতিরই সম্মান রক্ষার জন্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় পাকিস্তানে জেলে বন্দি থাকতে হয়েছে কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে। আর পাকিস্তানজুড়ে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘গাদ্দার’ রূপে। এই সময়ে সেই বৃহত্তর মানবতার পরীক্ষা দিচ্ছেন অরুন্ধতী রায়। কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিকে তিনি প্রকাশ্যেই যৌক্তিক বলে অভিহিত করেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধেও।
আমাদের দেশের লেখক-কবিদের সামনে এত তীব্র কঠিন পরীক্ষা আসেনি। তবে এমন অনেক পরীক্ষা এসেছে যেখানে সমগ্র জাতির স্বার্থ জড়িত। এবং আমাদের অধিকাংশ লেখক-কবি সেই পরীক্ষাতে সসম্মানে অকৃতকার্য হয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে অল্প দুই-চারজন বাদ দিলে আমরা সব লেখকই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নৌকার পক্ষে কাজ করেছি। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের অপশাসন থেকে মুক্তি তখন জন-আকাঙ্ক্ষায় রূপ নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে দেখা গেল কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই আগের সরকারের ধারাবাহিকতাই বজায় রাখছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে দেশের তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। সমুদ্রে গ্যাস-ব্লক ইজারা দেবার ব্যাপারে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম হরতালের ডাক এসেছিল তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে।
হরতালের দিন সকাল ১০টার দিকে দেখলাম শাহবাগ মোড়ে রিকশা থেকে নামছেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ। তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, শরীর খারাপ। বেশি সময় থাকতে পারব না। তোমাদের সাথে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজের মনের বোঝাটাকে নামিয়ে যেতে এলাম। আমি বলে বসলাম, স্যার আপনি এলেন!
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার না বলা কথাগুলো। তিনি ছিলেন খুব সংক্ষেপে প্রয়োজনীয় সবটুকু কথা বলতে পারার বিশেষজ্ঞ। বললেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করলেই দেশপ্রেমের পরীক্ষা দেওয়া শেষ হয়ে যায় না। আমাদের মতো দেশে প্রত্যেককে প্রতিদিনই দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হয়।
আরো কিছু কথা হলো, যেগুলো লিখলে ৫৭ (৩২) ধারা অনিবার্য। একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন। সালাম জানিয়ে বললেন, স্যার রোদে দাঁড়িয়ে আছেন! চলুন ভেতরে বসুন। তিনি না-সূচক ইঙ্গিত করলেন। পুলিশ অফিসার বললেন, তাহলে স্যার এখানে চেয়ার দিতে বলি? তিনি সেটাও প্রত্যাখ্যান করলেন। বললেন, শুনুন, এই যে আন্দোলনটা হচ্ছে তা সরকারকে উৎখাতের আন্দোলন নয়। দেশের সব মানুষের স্বার্থে আন্দোলন হচ্ছে। সব মানুষ বলতে আপনারাও আছেন। আপনাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আছে। আর এখানে যেসব ছেলেমেয়ে জমায়েত হয়েছে তারা শিক্ষিত, সুশৃঙ্খল। দেখছেনই তো ওরা কোনো সহিংস আচরণ করছে না। এদের ওপর অহেতুক দমন-পীড়ন চালাতে যাবেন না আপনারা।
পুলিশ অফিসার বললেন, আমরা সবই বুঝি স্যার! কিন্তু...
সেই ‘কিন্তু’টাই আসল। খান সারওয়ার মুরশিদ বিদায় নিলেন আধাঘণ্টা পরে। তার কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ। ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল্লাহর গায়ে হাত তোলেনি। তবে আনু মুহাম্মদ আহত হলেন। আহত হলো সকল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ঢাকা কলেজের সামনে আরেক দফা হামলা হলো ছাত্রলীগের তরফ থেকে। সেখানে আমার বাম হাঁটুতেও লাগল তাদের ছুঁড়ে মারা ইটের টুকরা। কিছুক্ষণের জন্য চলৎশক্তি হারাতে হয়েছিল। তবে তা মারাত্মক ছিল না।
শুধু তেল-গ্যাস আন্দোলন নয়, সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পবিরোধী আন্দোলন, পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ যেসব আন্দোলনে পুরো জাতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ জড়িত, সেইসব আন্দোলনে আমার লেখক-কবি বন্ধুদের খুব অল্পসংখ্যককেই পাশে পেয়েছি। সবাই যে রাজপথে নামবেন এমন আশা আমরা করি না। কেউ-ই করে না। কিন্তু মৌখিক বা মানসিক সমর্থন জানানোর বেলাতেও তাদের অনীহা কেন যে এত বেশি তার উত্তর খুঁজে পাইনি কোনোদিন। লেখক-কবিরা এইসব বিষয়ে এত নির্বিকার থাকেন কীভাবে? ঢাকা টু রামপাল লংমার্চের সময় একজন (নাম বলব না) বলেছিলেন, গৌণ কবি, গৌণ লেখকদের সাহিত্য-শিল্পের বোধ যেমন কম হয়, চিন্তার গভীরতা কম হয়, দেশাত্মবোধ-মানবতাবোধও তেমনই কম হয়। সেইজন্যই তারা গৌণ।
ক্ষমা করবেন, আমি কাউকে গৌণকবি বা গৌণ লেখক বলছি না। সেই যোগ্যতা আমার নেই। এখন পর্যন্ত যদি স্থূল অর্থে ফলাফল বিশ্লেষণ করি তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের আন্দোলনগুলো সফল হয়নি। ধরেই নেওয়া যেতে পারে, আমরা হেরে গেছি। কিন্তু এই পরাজয় কি কেবলমাত্র আন্দোলনকারী কয়েকজনের? নাকি সমগ্র জাতির? আগামী প্রজন্মেরও নয় কি? প্রতিটি কর্মসূচির পরেই আমি মনে মনে প্রার্থনা করেছি, যারা দেশবিরোধী এইসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের সন্ততির ওপরেও যেন অভিশাপ নেমে না আসে। যারা সুন্দরবন ধ্বংস করছে তাদের বংশধরদের ওপরেও যেন প্রকৃতির অভিশাপ নেমে না আসে। যে পুলিশরা লাঠিচার্জ করছে, জলকামান বাগিয়ে গরম পানিতে সেদ্ধ করতে চেয়েছে রাজপথের সৈনিকদের, তাদের সন্তানরাও যেন আন্দোলনের সুফলের সমান অংশ পায়। যারা বয়ে আনছে পারমাণবিক দৈত্যকে, তাদের সন্তানরাও যেন আক্রান্ত না হয় ইউরেনিয়ামের বিষ-যন্ত্রণায়। যারা অশিক্ষা আর অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে জনগণকে বঞ্চিত করছে নিজেদের জল থেকে, জঙ্গল থেকে, পাহাড় থেকে, নদী থেকে, তাদের সন্তানদের মুখেও যেন নদী পিপাসার জল তুলে দেয়।
হে সুন্দরবনের দীর্ঘশ্বাস
হে খনি থেকে চুরি যাওয়া জনগণের সম্পদ
হে বিষজর্জর নদীজল
তোমরা ক্ষমা করো আমাদের!
লেখক: কথাসাহিত্যিক