রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ২২

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : মে ২৪, ২০১৯

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার-বিরোধী মিত্রশক্তির রাষ্ট্রপ্রধানরা বৈঠকে বসার সময় পোপকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। স্তালিন কিঞ্চিৎ বিদ্রূপের স্বরে বলেছিলেন, এই সভাতে বা যুদ্ধে পোপের ভূমিকাটা কী? তিনি তো যীশুর মূর্তির সামনে কয়েকটি মোমবাতি জ্বালানো ছাড়া আর কিছু করতে পারবেন না।

গরিব জুতামিস্ত্রির সন্তান স্তালিন কৈশোরে কয়েক বছর লেখাপড়া করেছিলেন খ্রিস্টান পাদ্রিদের পরিচালিত স্কুলে। যা অনেকটা আমাদের কওমি মাদ্রাসার মতো। তারা গরিব ছাত্রদের থাকা-খাওয়ার যৎসামান্য ব্যবস্থা করে (লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের মতোই) ধর্মশিক্ষা দিয়ে তাদের ধর্মপ্রচারের কাজে ব্যবহার করার জন্য ছেড়ে দিত। সেখানে অন্ধ এবং প্রশ্নহীন ধর্মশিক্ষা পছন্দ হয়নি স্তালিনের। তিনি প্রতিষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। কারো কারো মতে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। আর এই যুদ্ধের সময় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম ব্যক্তি। তাদের দেশে ধর্মকে বাদ দিয়ে চলতে শেখার প্র্যাকটিস চলছিল। তাই স্তালিনের ছিল না ধর্মকে রাজনীতি বা ক্ষমতায় থাকার জন্য ব্যবহার করার প্রয়োজন। কিন্তু চার্চিল বা রুজভেল্ট তো এই প্র্যাকটিস করেই আসছেন। যাজকতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা বা উন্মাদে পরিণত করা যে কতটা সহজে সম্ভব তা তারা জানতেন। তারা জানতেন মানুষের মনের ওপর ধর্মের প্রভাব কত গভীর। এটাকে তারা কাজে লাগিয়েছেন চিরকাল। তাই পোপকে তাদের সঙ্গে পাওয়া দরকার ছিল।

স্তালিন হয়তো মনে রাখেননি, বা মনে রাখলেও গুরুত্ব দেননি যে, পোপের কথায় ইতিহাসে কত পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেম ছিনিয়ে নেবার জন্য খ্রিস্টান ইউরোপ বারংবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে ক্রুসেডে। কখনো কখনো যোদ্ধারা ক্রুসেডে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করলে পোপ তাদের জন্য লিখে দিতেন ‘স্বর্গের সার্টিফিকেট’। সেখানে লেখা থাকত, ‘অমুক ব্যক্তি একজন সত্যিকারের খ্রিস্টান। খ্রিস্টানদের তীর্থভূমি জেরুজালেমকে পুনরুদ্ধারের জন্য ক্রুসেডে সে নিহত হয়েছে। তার জন্য অবিলম্বে স্বর্গের দরজা খুলে দেওয়া হোক।’ নিচে পোপের স্বাক্ষর এবং সিলমোহর।

অনেকের কাছে ব্যাপারটি হাস্যকর মনে হলেও লক্ষ লক্ষ খ্রিস্টানের কাছে এই সার্টিফিকেট ছিল সত্যিকারের স্বর্গলাভের সার্টিফিকেটই। ধর্ম এভাবেই অন্ধ করে রাখে মানুষকে। অথবা অন্যকথায় বলা যায়, ধর্মের ব্যাপারে এইভাবেই অন্ধ হয়ে থাকাকেই ইমান বলে মনে করে শত শত কোটি মানুষ। অমুক অমুক মুরতাদ হয়ে গেছে, তাদের কতল করলে বিনা বিচারে বেহেস্তে যাওয়া যাবে— ধর্মনেতার এমন কথায় মানুষ হত্যার ঘটনা এই বাংলাদেশে অহরহ ঘটে চলেছে। বেশিরভাগ মানুষই ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে বিনা প্রশ্নে। দেওবন্দ বা রামপুর মাদ্রাসা থেকে যেভাবে বলা হয় সেভাবেই পোশাক-আশাক, চলাফেরা, খাদ্য-খাবার বেছে নেয় তবলিগ এবং কওমি মাদ্রাসার লোকজন। নবি খেজুর খেয়ে ইফতার করতেন। খেজুরই তো খাবেন তিনি। আরবে তো আম, জাম, কাঁঠাল, তরমুজ ছিল না। পেলে সেগুলোও নিশ্চয়ই খেতেন। খেজুর, অর্থাৎ তিনি একটি ফল খাচ্ছেন। এখন তাই বলে আমাদের দেশেও খেজুরই খেতে হবে ইফতারিতে! হুজুররা আক্ষরিক অর্থে নিয়েছেন নবির ইফতারিকে। ফলে সারা পৃথিবীতে মুসলমানদের কাছে খেজুর রপ্তানি করে নবির দেশের মানুষ প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার উপার্জন করে। এই হচ্ছে আক্ষরিকতার বাস্তবতা।

হিন্দু ধর্মের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাতা, কোরআন বা বাইবেলের মতো সুনির্দিষ্ট গ্রন্থ ছিল না। এগিয়ে এলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি শ্রীকৃষ্ণকে রূপ দিলেন অনেকটা নবি মোহাম্মদের মতো বাস্তব ব্যক্তিত্বে, তার জীবন থেকে সরিয়ে নিলেন প্রেমভাব, লীলা, অলৌকিকতা, লোকজতা। আর গ্রন্থ হিসাবে বেছে নিলেন গীতা। একদা নাস্তিক বঙ্কিম এমনভাবে বিন্যস্ত করলেন ‘হিন্দু ভারত’-এর রূপ যেখানে ভারতীয় মুসলমান বা অন্য ধর্মের অনুসারীদের কোনো জায়গা নেই। আহমদ ছফা এইজন্যই বঙ্কিমকে আধুনিক সাম্প্রদায়িকতার উদ্গাতা শতবর্ষের ফেরারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারই অনুসরণে আজ ভারত পরিণত হয়েছে আরএসএস-শিবসেনা-বিজেপি-র ভারতে। সর্বধর্মসমন্বয়ের ভারত আজ শুধুই হিন্দু-ভারত। হিন্দু ভারতে গোমাংস ভক্ষণকারীকে হত্যা করলে স্বর্গলাভ নিশ্চিত।

এখনো বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানীর জীবনে পড়ে মানুষ বিশ্বাস করে যে বাগদাদের মাটিতে কবর হলে তার গোর আজাব মাফ হয়ে যাবে। পীরের ওরসে লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়। তা সমাবেশ হতেই পারে। কিন্তু সমাবেশে দেখা যায় মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ, হার্টের রোগী, এই ভিড়ে তার নিশ্বাস আটকে মারা যাওয়ার আশঙ্কা। জিগ্যেস করলে বলেন যে তিনি এই আশঙ্কা জেনেই ওরসে এসেছেন। কেন এলেন? কারণ তার বিশ্বাস এই ওরসে মৃত্যু হলে পীরের উছিলায় তিনি বেহেস্তে চলে যেতে পারবেন। আবার পূর্ণ গর্ভবতী রমণীদের দেখা যায়। হাঁসফাঁস করছেন। যে কোনো মুহূর্তে প্রসব বেদনা উঠতে পারে। তিনি কেন এই দমচাপা মানুষঠাসা ভিড়ের মধ্যে এসেছেন। তিনিও জেনে-শুনেই এসেছেন। এখানে এই ওরসের কালে যদি তার সন্তান জন্মগ্রহণ করে তবে সেই সন্তান হবে পীরের বিশেষ দোয়াপ্রাপ্ত। সেই সন্তানকে নিয়ে ভবিষ্যতে তাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না।

কালকূটের ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ পড়তে গেলে হিন্দুদের মধ্যে ঠিক একই রকমের অন্ধবিশ্বাসের ছড়াছড়ি দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে ন্যাংটো সাধুরা পূজিত হন। তাতে নাকি অক্ষয় স্বর্গবাস! এক ধর্মের মানুষের এই রকমের বিশ্বাস এবং ধর্মযাপন অন্য ধর্মের লোকদের কাছে হাস্যকর এবং বিপজ্জনক। যে হাসছে সে জানেও না যে তার ধর্মাচরণের মধ্যেও একই রকম হাস্যকর উপাদান রয়েছে অনেক। আবার অন্য ধর্মের উত্থানকে সে যেমন বিপজ্জনক মনে করছে, তার ধর্মের উত্থানকেও অন্য ধর্মের লোকেরাও সেই রকমই বিপজ্জনক বলেই ভাবছে।

গত শতকে পর পর দুইটি বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে, বিশেষ করে ইউরোপে মানুষ ধর্ম থেকে একেবারে দূরে সরে যাচ্ছিল। অনেকেই এমন ঘোষণা দিয়ে ফেলেছিলেন, ‘ঈশ্বর আজ মৃত’। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকে ধর্ম পিছু হটতে হটতে একেবারে উপসনালয়কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আজ, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি পৃথিবীতে এখন ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’, ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’, ‘ইহুদি জাতীয়তাবাদ’, ‘শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদ’। এদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে পৃথিবীর তাবৎ মাল্টিন্যাশনাল, করপোরেট, লুটেরা রাজনীতিবিদ এবং পুঁজিপতিরা। অথচ এই পৃথিবীতে দেশে দেশে যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেই ‘শোষিতের জাতীয়তাবাদ’ গড়ে ওঠার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। পৃথিবীর মহৎ মহীয়ান মানবিক ধ্রুপদী সাহিত্যগুলো কি মানবজাতির কোনো কাজেই লাগবে না?

লেখক: কথাসাহিত্যিক