রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ২৩

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : মে ২৬, ২০১৯

কবিতা আসলে মস্ত এক ধাপ্পা। তা যদি না হতো তাহলে এত এত মহৎ, মহীয়ান কবিতা থাকতেও পৃথিবী কেন বারবার পরিণত হয় নরককুণ্ডে? কেন বারবার যুদ্ধ-মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়? মৃত্যু ঘটে নিরীহ মানবসন্তানের? কেন ধর্ষিতা ও বিধবা হয় লক্ষ লক্ষ নারী? কেন পিতৃহীন হয় অজস্র মানবসন্তান? কেন বাস্তুচ্যুত হয় কোটি কোটি মানুষ? ইস্কাইলাস থেকে হোমার, রুমি থেকে রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে থেকে শেক্সপিয়ার— এত এত সব মহান কবিদের কবিতা কেন পৃথিবীর মানুষকে যথেষ্ট মানবিক করে তুলতে পারল না?

অভিযোগ আমার নয়। তাদেউশ রুজেভিচ, বিখ্যাত পোলিশ কবি, যার নাম একাধিকবার উঠেছে নোবেলের শর্টলিস্টে, তিনিই করেছেন এই অভিযোগ। একাধারে কবি ও যোদ্ধা ছিলেন তিনি। নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে দেশের গুপ্ত বিপ্লবী দলের হয়ে লড়াই করেছেন তারা দুইভাই। বড়ভাই নাৎসিদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাদেউশ নিজেও একাধিকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। মাতৃভূমির স্বাধীনতার যুদ্ধে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন পোল্যান্ডের মুক্তিযোদ্ধা পদক।

এমন একজন কবিও বিশ্বাস হারান কবিতার ওপর? নাকি তিনি বিশ্বাস হারিয়েছিলেন মানুষের ওপর? অথচ কবিতা লেখা তিনি বন্ধ করেননি। আমৃত্যু লিখে গেছেন কবিতা, নাটক, বিভিন্ন ধরনের গদ্য। পরবর্তীতে সেই তিনিই আবার বলছেন, সাহিত্য আসলে কাজ করে খুব ধীরে ধীরে। অনেকটা মানুষ-প্রকৃতি-জীবজগতের বিবর্তনের মতো ধীর তার কাজের গতি। তবে কেউ যদি তাড়াতাড়ি সাহিত্যের কাছ থেকে প্রেরণা এবং জীবনময়তা পেতে চায়, তাহলে তাকে নিজেই যেতে হবে সাহিত্যের কাছে। সাহিত্য তাকে দুহাত ভরে দেবে। তার হৃদয়কে কলুষমুক্ত করে দেবে। তার অন্তরকে পূর্ণ করে দেবে অনুপ্রেরণায়। সেইজন্য তিনি শিশুকাল থেকে সাহিত্যের কাছে যাওয়ার অভ্যেস করতে বলেছেন। অথবা শিশুর কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন সাহিত্যকে। তাহলে সাহিত্যের সংস্পর্শে শিশু বেড়ে উঠবে মানবিক হয়ে।

আমাদের একজন শিশু মনস্তত্ত্ববিদ বলেছিলেন, যে কিশোর ‘পথের পাঁচালী’ পড়ে অপু-দুর্গার জন্য চোখের পানি ফেলেছে, সে কোনোদিন খুনি বা সমাজবিরোধী হতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, অপু-দুর্গার কাছে সব কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে যাবে কে? রাষ্ট্র, সরকার, বড় দলগুলি এই দায়িত্ব পালন করবে না। কারণ তাদের দরকার খুনি, ঐক্যহীন, সমাজবিরোধী, নতজানু এক জনগোষ্ঠীকে, যাদের তারা নিজেদের স্বার্থে ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারবে। দায়িত্ব নিতে পারত পিতা-মাতা। কিন্তু পিতা-মাতার নিজেদের অবস্থানই তো বই-পুস্তক থেকে অনেক দূরে। লেখাপড়া না-জানা অভিভাবকের কথা বাদই থাকুক, ডিগ্রিধারী বাবা-মায়েরাও তো বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করার পরে চাকুরির ম্যানুয়েল ছাড়া আর কিছুই পড়ে না। তারা নিজেরা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোনো সাহিত্য পাঠ করেনি জীবনেও। তাহলে সন্তানের সামনে তারা ভালো সাহিত্যকে উপস্থাপন করবে কেমনভাবে?

তার বদলে সন্তানের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগানোর নামে আরবি পড়তে শেখায় মৌলভীকে বেতন দিয়ে। সে শুধু পড়তে শেখানোই। রিডিং পড়ে যাওয়া। দুলে দুলে সুরা-দোয়া পাঠ করা। কোনো অর্থ না বোঝা, তাৎপর্য না বোঝা। এই তোতাপাখি শিক্ষা থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ আসবে কেমন করে? এর সাথে আছে জিপিএ-৫ তোলার জন্য সন্তানের ওপর বিরামহীন কোচিং আর প্রাইভেট শিক্ষকের বোঝা এবং মানসিক নির্যাতন চাপিয়ে দেয়া। এখনকার শিক্ষা অনেক ব্যয়বহুল। সেই টাকা খরচ করতে কেউ পিছ-পা নয়। কেউ দিনরাত্রি এক করে পরিশ্রম চালিয়ে যায়, যার ঘুষ খাওয়ার সুযোগ আছে সে ঘুষ খায়, যার ব্যবসাতে দুই নম্বরী করার সুযোগ আছে সে দুই নম্বরী করে, যার এমপি-মন্ত্রীর কানেকশন আছে সে চাকুরি-নিয়োগ-বদলির তদবিরের মাধ্যমে টাকা উপার্জন করে, যে চোরাচালানি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে সে ইয়াবার ব্যবসা করে, যে লাইন খুঁজে পায় সে প্রতিষ্ঠানের মালিক-পরিচালক এবং করপোরেট টাইকুনদের জন্য নারী সাপ্লাই করে। এই রকম অনেক ভাবে বাড়তি টাকা উপার্জনের ব্যবস্থা বাংলাদেশে হয়েছে। এইভাবে টাকা উপার্জনের মাধ্যমে যে সন্তানকে সে ডিগ্রি জোগাড় করে দেয়, স্বাভাবিকভাবেই সেই সন্তান হয়ে থাকে সংবেদনশীলতার দিক থেকে পুরোপুরি ভোঁতা। বাপের-মায়ের পেশা বা বাড়তি আয় সম্পর্কে একটা ধারণা একসময় সন্তান পেয়েই যায়। তখন বাপ-মাকেও তার আর শ্রদ্ধা করার দরকার পড়ে না। বাপ-মা তখন তার কাছে স্রেফ টাকা সরবরাহের যন্ত্রমাত্র।

এইভাবে মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মানুষ বংশানুক্রমে দূরে যেতে থাকে উচ্চচিন্তা থেকে, সৎচিন্তা থেকে, মুক্তচিন্তা থেকে, উদারনৈতিক চিন্তা থেকে। এইরকম জনগোষ্ঠীর কাছে কোনো প্রবেশাধিকার নেই সাহিত্যের বা কবিতার। তাদেউশ রুজেভিচের হাহাকার আমাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয় প্রায়শই। সত্যিকারের কবি-সাহিত্যিকরা সত্যি সত্যিই অনেক দূর পর্যন্ত ভবিষ্যৎ দেখতে পান। এই দেখার ক্ষমতাটা আসলে কোনো অলৌকিক বা আধ্যাত্মিক শক্তি নয়। বড় লেখক-কবিরা সময় এবং মানুষের প্রবণতাকে পাঠ করার ক্ষমতা অর্জন করেন সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে। পাঠ করেন সমাজ মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, সাধারণ মানুষের জীবনভাবনা, দেশ ও সমাজের গতিমুখ, আন্তর্জাতিক বা বিশ্বের পরিচালকদের দৃষ্টিভঙ্গি। তারা দেখতে পান কোনদিকে যাওয়ার প্রবণতা মানুষের। এই গভীর অধ্যয়ন এবং পর্যবেক্ষণ তাকে ভবিষ্যতের বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টিনিক্ষেপের সুযোগ করে দেয়। সেই কারণেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন মানুষ এবং পৃথিবী সম্পর্কে।

তাদেউশ বাস করেছেনে এমন এক সময়ে যখন আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্ব চলছিল খুব জোরালোভাবে। একজন কবি বা লেখক সেই দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে পড়েন নিজের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তাদেউশও জড়িয়ে পড়েছিলেন। বর্তমানের যুদ্ধ দুই অসম শক্তির মধ্যে হলেও সেটি চালিয়ে যাওয়া যায়, যদি ভবিষ্যতে কোনো আলোর রেখার সন্ধান পাওয়া যায়। বর্তমানের অনিবার্য পরাজয়কেও তখন খুব বেশি বড় বলে মনে হয় না। বরং এই পরাজয় ভবিষ্যতে আরো সংগঠিতভাবে যুদ্ধে নামার বাড়তি প্রণোদনা জোগায়। কিন্তু যদি দেখা যায় যে ভবিষ্যতেও শুভ-সুন্দরের জয়লাভকে অসম্ভব করে তোলা হচ্ছে, আর পৃথিবীবাসী তা নিয়ে মোটেই ভাবিত নয়, তখন আর হতাশা চেপে রাখা সম্ভব হয় না।

অগভীর লেখক-কবিরা এতকিছু ভাবেন না। তারা গড্ডালিকার প্রবাহ বজায় রাখেন। পত্রিকার পাতা ভরান, টেলিভিশনের গতানুগতিক স্ক্রিপ্ট সাপ্লাই করেন, কল্পনাশক্তিহীন কাব্য রচনা করে চলেন, ক্লিশে প্রেমকাব্যের পুনরাবৃত্তি ঘটান, রাজসভায় স্থান পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করেন। কিন্তু তাদেউশ রুজেভিচ বা তাঁর মতো লেখক-কবিদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্তমানকে। এবং পুরোপুরি অন্ধকারময় ভবিষ্যৎকে। তারা ফেটে পড়েন চিৎকারে। কখনো কখনো তাঁদের কলম পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে অনেক দিনের জন্য। এই দশা থেকে লেখক-কবিদের মুক্ত করতে পারে কেবলমাত্র মানুষ। সেইসব মানুষ যারা অন্ধকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা থেকে কখনোই পিছু হটেন না।

মানুষ যতখানি সাহিত্যের ওপর নির্ভরশীল, সাহিত্যও ঠিক ততখানিই নির্ভরশীল মানুষের ওপর। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক