
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ২৪
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ২৭, ২০১৯
আমার কাছে খুব কঠিন এবং দুরূহ মনে হয় প্রেমের গল্প লেখা। কারণ প্রেম হচ্ছে মানুষের সবচাইতে জটিল অনুভূতি। তাকে গল্পের কেন্দ্রে আনা খুব কঠিন কাজ। তাছাড়া প্রেম কখনোই একা থাকে না। তার সাথে গা জড়াজড়ি করে থাকে সংশয়, ঈর্ষা, আধিপত্য, যুক্তিহীনতা, উদারতা, সংকীর্ণতা, আরো অনেককিছু। একটি ছোট বাক্য বা আচরণ পরস্পরের ওপর কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে তা অচিন্ত্যনীয়। প্রেমে পড়া সুখি মানুষ কদাচিৎ দেখা যায়। আবার প্রেম নাই তো আছে কেবল হাহাকার। এমন জিনিসকে গল্পে তুলে আনা খুব সহজ ব্যাপার নয়।
আমরা যেসব প্রেমের গল্প দেখি সেগুলোকে ব্যঙ্গ করে অমিয়ভূষণ মজুমদার বলেছিলেন, A boy meets a girl নিয়ে যা লেখা হয় তা প্রেমের গল্প নয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’কে প্রেমের উপন্যাস তো দূরের কথা উপন্যাস বলেই স্বীকার করেন না। ‘নৌকাডুবি’কেও না।
আমি ততদূর না গেলেও বাজারে যেসব প্রেমের গল্প বা উপন্যাস বেশি চালু সেগুলোকে তেমন গ্রহণযোগ্য মনে করি না। বেশিরভাগই খেলো এবং জলো। কিছু রোমান্টিক বাক্য, রোমান্টিক দৃশ্য, কিছু ভুল বোঝাবুঝি, তারপরে মধুরেণু সম্পায়েৎ— এই হচ্ছে বইগুলোর ভেতরের সারাংশ। ওসব পড়তে গিয়ে হাসি আসে। এমনকি বিশ্বজুড়ে অন্যতম বেস্ট সেলার এরিখ সেগালের ‘লাভ স্টোরি’কেও আমার কাছে জলো মেলোড্রামাই মনে হয়।
প্রেমের উপন্যাস হিসাবে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসটিকে যদি একটি উদাহরণ হিসাবে ধরি, তার পাশে হুমায়ূন আহমেদের ‘কবি’ একটি ফেলনা উপন্যাস। আমি সেই রকম একটা ফেলনা উপন্যাস বা গল্পের জনক হতে চাই না। আবার তারাশঙ্করের মতো প্রেমের উপন্যাস লেখার শক্তি বা কবজির জোর আমার আছে কি না সেই পরীক্ষাটা দিতেও ভয় লাগে। দস্তয়ভস্কি বা চেখভের মতো প্রেমের গল্প-উপন্যাস লেখার কথা তো ভাবতেই সাহস পাই না। দস্তয়ভস্কির উপন্যাস পড়ার সময় মাঝে মাঝে লেখককে খুব বেশি স্যাডিস্ট মনে হয়। উপন্যাসের চরিত্রটিকে তিনি নিষ্করুণভাবে ভোগাতে থাকেন। মানুষ এতও সইতে পারে! আত্মহত্যা করছে না কেন লোকটা! কিন্তু প্রেম বোধহয় এমনই জিনিস যা প্রেমিককে আত্মহত্যাও করতে দেয় না।
খুব কষ্টের বিষয় হচ্ছে, প্রেম চিরজীবী নয়। সফল প্রেমের পরিণতি হিসাবে বিবাহকে ধরা হয়ে থাকে। বলা হয়, প্রেমের সফল পরিণতি এবং পূর্ণতা হচ্ছে বিয়ে। পূর্ণতা মানেই তার সাথে আর কিছু যোগ করার নেই। যোগ হবে না। তখন হতে থাকবে কেবল ক্ষয়। প্রেম পরিণত হয় গার্হস্থ্য অভ্যাসে। দুই-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে দাম্পত্য জীবনে প্রেমের অস্তিত্ব খুব কমই থাকে। অনেক বছর ধরে সংসার করে আসা মানে এই নয় যে সংসারটি প্রেমময়। বরং উল্টোটাই বেশি সত্য। তখন প্রেমের জায়গা নেয় বোঝাপড়া। সেই জন্যই বোধহয় সফল প্রেম নিয়ে গল্প-উপন্যাস তেমন হয় না। হয় প্রেমের ট্রাজেডি নিয়ে।
এ কেমন কথা যে একটা মানুষ সবসময় কেবলমাত্র আর একজন মানুষের কথাই ভাবতে থাকবে! ভাববে আর মনে প্রশ্ন জাগবে সে-ও কি এখন আমার কথা ভাবছে? যদি মনে হয় ভাবছে না, তখনই নিজেকে গুরুত্বহীন এবং পরিত্যক্ত মনে হবে।
অন্য সময় যেসব কথা বা আচরণকে হাস্যকর মনে হবে, প্রেমে পড়লে মানুষ সেগুলোই করে, সেগুলোই বলে। প্রেমের কারণে সেগুলো আর হাস্যকর থাকে না। বরং প্রেমবৃক্ষের গোড়ায় জলসিঞ্চনের মতো অপরিহার্য হয়ে ওঠে। গল্পে বা উপন্যাসে এই রকম বোকা বোকা সংলাপকে অপরিহার্য করে তোলার মতো পরিবেশ তৈরি করা কম শক্তির লেখকের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। প্রেম নিয়ে লেখা তাই খুব বড় এবং শক্তিমান লেখকের কাজ, অথচ আমাদের দেশে প্রেম নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখে ভাসিয়ে দেয় শক্তিহীন লেখকরা।
প্রেম বোধহয় বাউল বা সুফিতত্ত্বের মতোই গুরুমুখি ব্যাপার। গুরুসঙ্গ বা সাধুসঙ্গ ছাড়া যেমন বই-পুস্তক পড়ে সুফিতত্ত্ব বোঝা যায় না, সেই রকম প্রেমে না পড়লে তার স্বরূপ বোঝা যায় না। তাই বোধহয় প্রেমতত্ত্বে নারী-পুরুষ উভয়ে উভয়ের গুরু।
তবে যুগ পাল্টেছে। পাল্টে গেছে প্রেমের ধরনও। পাল্টাতে পাল্টাতে এমন জায়গাতে পৌঁছেছে যে মনে এই প্রশ্নটাও জাগে, প্রেম কি এখনো আছে? প্রেম নিয়ে এখন আদৌ কি কেউ ভাবে? এখন সবাই ফান করে। সিনেমা দেখা ফান, ক্লাবে যাওয়া ফান, অ্যাডভেঞ্চারে যাওয়া ফান, কোকাকোলা খাওয়া ফান, পাহাড়ে ওঠা ফান, গাড়ি জোরে ড্রাইভ করা ফান। প্রেমও একটি ফান। দেখা করা, কোথাও যাওয়া, কোথাও খাওয়া, তারপর বিছানায় যাওয়া। ব্যস হয়ে গেল। পরে আবার একটি ডেট ঠিক করা হবে মোবাইলে যদি ততদিন পর্যন্ত আকর্ষণ থাকে। যদি ততদিনে অন্য কারো সাথে বেশি ইনভলব হয়ে পড়ার ঘটনা না ঘটে। পুরুষতন্ত্র তো আছেই, এখন নারীবাদ যুক্ত হয়ে প্রেমকে আর পাঁচটা ঘটনার মতো একটি ইভেন্টে পরিণত করে ফেলেছে। পই পই করে বলে দিচ্ছে, বিছানায় যাবে যাও, কিন্তু খেয়াল রাখবে তোমার পুরুষ পার্টনার যেন তোমার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে। প্রেমিক নয়, মেল পার্টনার। প্রেমিকা নয়, ফিমেল পার্টনার। তাই অন্য কারো সাথে বসে থেকেও মোবাইলে ‘হাই সোনা, তুমি লাঞ্চ করেছ তো বাবু! আমি এলোন। তোমাকে খুব মিস করছি’ বলতে গলা বিন্দুমাত্র কাঁপে না কোনো পক্ষেরই।
দুজনেই জানে যে দুজনের মিথ্যেই ধরা পড়বে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই দুজনের কাছেই। তবু কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এটাই নর্মস। লজ্জাহীনতা। মানুষ নিজের কাছে যদি লজ্জা না পায় তাহলে অন্য কারো কাছে লজ্জিত হতে ভুলে যায়। তবু নিশ্চয়ই সত্যিকারের প্রেম আছে কারো কারো মধ্যে।
বন্ধুরা জানে প্রেমের গল্প লিখতে আমার অপারগতার কথা। তারা বলে, তুই প্রেমের গল্প লিখিস না কেন? প্রেম তোর কাছে অজানা বিষয় নয়। নিজে তো প্রেম করেছিস। দরকার মনে হলে আরেকবার প্রেম কর। আমি উত্তর দিই না। নিজের কৈশোরে ফিরে যাই। আমাদের বাড়ির সামনে দুই বিঘার মতো ফাঁকা মাঠ। সেখানে একটা আমগাছ, কয়েকটা নারকেল-সুপারির গাছ। আর পুরোটা জুড়ে ঘাসের গালিচা। বাগান বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাগানের সীমানা শেষ হলেই রাস্তা। আমাদের বড় ঘরের জানালা দিয়ে রাস্তা দেখা যায়। বাগানের গেট থেকে বাড়ির গেট পর্যন্ত মোরাম বিছানো হাঁটাপথ। জোহরের আজান হয় দুপুর একটায়। তার আগেই রান্না-বান্না সেরে নেয় মা। তারপর নিজে গোসল করে চুলটা আঁচরে, পরিষ্কার শাড়ি পরে, স্নিগ্ধ একটু প্রসাধন সেরে আমাকে কোলে বা পাশে নিয়ে বসে জানালায়। মাকে তখন কী সুন্দর যে লাগে! কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় বাগানের বেড়ার সামনে রিক্সা থেকে নামছে আব্বা। নেমেই তাকায় জানালার দিকে। তার মুখে ফুটে ওঠে সুন্দর এক চিলতে হাসি। তার জন্য স্নিগ্ধ অপেক্ষমান দুটি চোখ। তা দেখে আব্বার নিজের চোখদুটোও মোলায়েম হয়ে আসে। আব্বা হেঁটে আসতে থাকে। মনে হয় মোরাম বিছানো পথে নয়, আব্বা হাঁটছে মায়ের দৃষ্টি বিছানো পথ ধরে। আব্বা জানালার কাছাকাছি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে মা। তারপর বলেম, চল গেটটা খুলে দিই।
বন্ধুদের আশ্বস্ত করি, আমি একদিন সেই প্রেমের গল্পটা লিখব নিশ্চিত। চলবে
লেখক: কথাসাহিত্যিক