রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ২৫

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : মে ২৮, ২০১৯

২০-২১ বছর বয়স থেকে নিজেকে দেখতে চাওয়া এবং দেখতে পাওয়ার অভ্যেস শুরু হয়। নিজেকে দেখতে পাওয়া মানে ভবিষ্যতের ‘আমি’কে দেখা। আমি নিজেকে দেখতে পেতাম দুইটি অবস্থায়। একটি হচ্ছে লেখার টেবিলে বসে থাকা আমি। অপরটি হচ্ছে কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে দিগন্তের পথে হেঁটে যাওয়া আমি। তার মানে, লেখালেখি আর ভ্রমণ।

অন্য কোনো অবস্থায় নিজেকে আমি দেখতে পাইনি কখনোই। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, অথচ নিজেকে বড় কোনো হাসপাতালে বড় ডাক্তারের চেহারায় দেখতে পাইনি। সদ্য যুবক, অথচ কোনো সুন্দরী যুবতীর সান্নিধ্যে দেখতে পাইনি। ছাত্র রাজনীতি করছি তখন, অথচ কোনো ডাকসাইটে নেতা বা মন্ত্রী বা এমপির চেহারায়, অনেক মানুষ ঘিরে আছে আমাকে, এমন অবস্থায় দেখতে পাইনি।

প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান আমি। বেশ কষ্টে জীবনযাপন করতে হয় আমাদের। অথচ নিজেকে অনেক টাকার মালিক হিসাবে বা বিলাসবহুল বাড়িতে থাকা অবস্থায় দেখতে পাইনি। আমার দামি গাড়ি আছে, দামি হোটেলে খাচ্ছি, দুইহাতে টাকা ওড়াচ্ছি, আমার হুকুমে ত্রস্তে ছুটছে অনেক সেবক— এমন কোনো মনছবি আমার আদৌ ছিল না কোনোদিন।

তখন মহাজাতকের কোয়ান্টাম সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেনি। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় রাশিফল লিখে কিছুটা পরিচিতি পেয়েছেন কেবল। মনছবি শব্দটাও তখন উদ্ভাবিত হয়নি। তবু আমি মনছবি শব্দটাই ব্যবহার করছি। তার মানে নিজের অজান্তেই তখন আমি ঠিক করে ফেলেছি, আমার কাজ হবে লেখালেখি। এই ব্যাপারটা তখন বুঝিনি, এখন বুঝি। সেই মনছবিই আমাকে বারবার বাধ্য করেছে এমনভাবে আমার পেশাটিকে পুনর্বিন্যস্ত করে নিতে, যাতে আমার লেখালেখির কাজটা সবচাইতে ভালো ভাবে চালিয়ে যেতে পারি।

আবার লেখালেখি যখন সর্বাত্মকভাবে শুরু করি, তখন আমার কিন্তু সাহিত্য নিয়ে কোনো স্বপ্ন ছিল না। কেবল একটাই লক্ষ্য ছিল, ভালো লিখতে হবে, গতানুগতিকতার বাইরে থাকতে হবে, যে ধরনের লেখা ১০০০টি হয়ে গেছে, আমার লেখা যেন সেই সারিতে যোগ দিয়ে ১০০১ নম্বর হয়ে দাঁড়িয়ে না থাকে। ছোট হোক, প্রায় না দেখতে পাওয়ার মতো অস্পষ্ট হোক, তবু যেন আমার লেখার জন্য আলাদা একটি সারি থাকে।

লেখার জন্য পুরস্কার পাব, পদ-পদবি হবে, আমার লেখা নিয়ে মানুষ আলোচনা করবে, লেখার জন্য আমি টাকা অর্থাৎ লেখকসম্মানি পাব, আমার লেখা অনূদিত হবে অন্য ভাষায়, দেশে-বিদেশে আমন্ত্রিত হয়ে যাব লেখক হিসাবে— এসব তো দূরের কথা, আমার গল্পসমগ্র বা প্রবন্ধসমগ্র বা উপন্যাসসংগ্রহ বের হবে ঢাউস আকারে, এই স্বপ্নটিও আমি কোনোদিন দেখিনি। অথচ সেগুলি আজ বাস্তব।

আমার সৌভাগ্য যে কথাসাহিত্যে কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমি আলোচনায় এসেছি। আলোচনায় আসা মানে সমকালীন অন্য লেখকদের আড্ডায় আমার গল্পের কথা উঠেছে। এই বিষয়টিকে প্রায় কেউ খেয়াল করেন না। খেয়াল করেন পুরস্কারপ্রাপ্তির কথা। কিন্তু এই আলোচনায় আসাটা সত্যি সত্যিই অনেক বড় ব্যাপার। এইদেশে অনেক লেখক-কবি আছেন এবং ছিলেন যারা সমাজের চোখে উচ্চপদস্থ মানুষ, তারা লেখেনও নিয়মিত, তাদের বই বের হয় নিয়মিত, বিশাল হলঘরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে তাদের গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবও হয়, পত্র-পত্রিকার সাধারণ সংখ্যা তো বটেই, ঈদ এবং বিশেষ সংখ্যাগুলিতেও নিয়মিত ছাপা হয় তাদের লেখা, তারা কেউ কেউ এক বা একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন, কেউ কেউ বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন, কিন্তু তাদের নাম বা তাদের কোনো লেখার কথা সমকালীন এবং অনুজ লেখক-কবিদের অনানুষ্ঠানিক আড্ডা-আলোচনায় কখনোই ওঠে না। অনেক প্রাপ্তির পরেও এরা সেই দুর্ভাগা লেখক-কবি যাদের লেখা সমকালীন এবং অনুজদের মনে কোনো দাগ কাটতে পারেনি। তাদের একটি গ্রন্থ বা গল্প বা কবিতার নাম খুব সহজে সক্রিয় লেখকরা মনে করতে পারেন না। (সক্রিয় লেখক মানে সেই লেখক যিনি নিজের লেখার পাশাপাশি দেশে কোথায় কেমন ধরনের লেখা হচ্ছে সেই খবরটিও রাখেন)। লেখকজীবনের প্রাপ্তির প্রথম এবং প্রধান ধাপ এটিই।

প্রাপ্তির পরের ধাপ হচ্ছে কেবলমাত্র লেখার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং নিজের পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে বৃহত্তর সিরিয়াস পাঠকের কাছে পৌঁছুতে পারা। এই জায়গাতেও আমি সত্যিকারের সৌভাগ্যবান। আমরা যারা জনপ্রিয় ধারার লেখক নই, সেই সিরিয়াস ধারার বেশিরভাগ লেখক-কবির পাঠকদের মধ্যে আছেন অন্য লেখক বা বন্ধুমণ্ডল বা নিজেদের গোষ্ঠীসদস্য। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে কিছু ছাত্রছাত্রী তাদের স্যারের বই কেনেন। কীভাবে কীভাবে যেন আমার রচনা সেই বৃত্তকে প্রসারিত করতে পেরেছে। বিষয়টি আত্মতৃপ্তির নয়। সন্তুষ্ট হয়ে এখানেই থেমে যাওয়ার নয়। কিন্তু ঘটনাটি ঘটেছে। দেশের ভেতরে খুব প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েও হঠাৎ হঠাৎ একজন-দুইজন মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি, যারা আমার নাম এবং অল্প হলেও কিছু লেখার সাথে পরিচিত। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তারা অনেকেই একসময় প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই রাজনীতির কারণেই তাদের পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। এখন রাজনীতি করেন না। কিন্তু পড়েন। তারা আমাকে নিজেদের লেখক হিসাবে গ্রহণ করেছেন। দেশের সিরিয়াস পাঠকদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই বেশি। আবার দেখেছি কওমি মাদ্রাসা থেকে পাশ করা গাঁয়ের মসজিদের ইমামও আমার ‘মুসলমানমঙ্গল’ এর কথা জানেন।

আর ভ্রমণ হচ্ছে আমার অবিচ্ছেদ্য স্বভাব। এক জায়গাতে বেশিদিন কাটালে ভেতরে অস্থিরতা তৈরি হয়ে যায়। ভ্রমণ বলতে আমি কোথাও গিয়ে ঘুরে আসা বুঝি না। নতুন একটা জায়গাতে গেলাম, কিছু স্থাপনা দেখলাম, দর্শনীয় জায়গাগুলোতে ঢুঁ মারলাম, ফটোসেশন করলাম, ফিরে এলাম— এটি আমার কাছে ভ্রমণ নয়। আমার কাছে ভ্রমণ মানে সেই ভূগোলকে ভালো করে চেনা, মানুষকে পর্যবেক্ষণ করা, তাদের জীবনপ্রণালী এবং প্রবণতা বুঝতে চেষ্টা করা। তাই কোনো জায়গাতে গিয়ে পা ছুঁইয়েই ফিরে আসাটা আমার হয় না। সেখানে বেশ কয়েকদিন থাকতে হয়। যত বেশি পারা যায় মানুষের সংস্পর্শে যেতে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দিগন্তের দিকে একাকি হেঁটে যাওয়ার শেষ গন্তব্যও সেই লেখার টেবিলই। ‘এই ভ্রমণ আর কিছুই নয়, কেবল তোমার কাছেই ফিরে আসা’।

নিজের অর্জন নিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে গেল। আত্মপ্রচার মনে হতেই পারে। কিন্তু সাহিত্যের জন্য ত্যাগ এবং কষ্ট স্বীকারের কথা আমরা খুব বলি। আমিও সজ্ঞানে-অজ্ঞানে বলি। অথচ সাহিত্যের কাছ থেকে প্রাপ্তির কথা যদি একটুও না বলি, তাহলে সেটি বড় বেশি অকৃতজ্ঞতা হয়ে যায়। কারো কাছেই অকৃতজ্ঞ বলে চিহ্নিত হতে চাই না।

লেখক: কথাসাহিত্যিক