
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ২৬
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : মে ৩০, ২০১৯
অনেকেই তাদের জীবনের কথা শোনাতে চান আমাকে। বলেন, তার সেই জীবনের কাহিনিটি শুনে আমি গল্প লেখার মতো একটা প্লট পেয়ে যাব। কখনো বলি, ঠিক আছে শুনব একসময়। কখনো কখনো নাছোড় বান্দার কাছে শুনতেই হয় তার জীবনের গল্পটি। আমি শ্রোতা হিসাবে খারাপ না। ধৈর্য ধরে অনেকের অনেক কথাই শুনি। বলার চাইতে শুনি বেশি। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ আমার বলার জন্য মুখ একটা আর শোনার জন্য কান দুইটা। কখনো উৎসাহী বক্তাকে কমলকুমার মজুমদারের মতো বলতে পারি না, প্লট! প্লট দিয়ে কী হবে মশাই? প্লট দিয়ে বাড়ি হতে পারে। গল্প হয় না।
প্লট দিয়ে আসলে আমার গল্প হয় না। অথবা বলা যায়, আমার গল্প লেখাতে প্লট কোনো কাজে লাগে না। প্লট মানে তো পুরো আখ্যান জেনে নিয়ে গল্প লেখা। একটি ঘটনাকে গল্প বানিয়ে ফেলা। আমার ক্ষেত্রে সেটি হয় না। কোনো একটি হঠাৎ উঠে আসা চিন্তা, একটি বাক্য, বিশেষ পরিস্থিতিতে একজন মানুষের মুখ, কোনো তর্কের কোনো বাক্য, কোনো একজন মানুষের হঠাৎ ঘটানো কোনো ঘটনা গল্পের বীজ হিসাবে কাজ শুরু করে আমার মনে। এই রকম বীজ তো অনেক আসে। আমাদের দেশে সবার জীবনই খুব ঘটনাবহুল। দেশটার প্রতিটি দিনই ঘটনা-দুর্ঘটনাবহুল। তাহলে এদের মধ্যে কোনটি নিয়ে আমি গল্প লিখতে বসব? তা বেছে নেয় আমার সজ্ঞান এবং অবচেতন মন। মাঝে মাঝে এটিকে গর্ভধারণের প্রক্রিয়ার মতোই মনে হয়। একবার মিলনে পুরুষ ৪০ কোটি শুক্রাণু ঢেলে দেয় নারীর মধ্যে। সেই ৪০ কোটির মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। তাদের মধ্যে মাত্র একটি শুক্রাণু মিলিত হতে পারে নারীর ডিম্বাণুর সাথে। বাকি সবাই মারা যায়। সেই জয়ী শুক্রাণুর মতোই অসংখ্য বীজ থেকে যে কোনো একটি বীজ আমাকে দখল করে। বাধ্য করে তাকে নিয়ে লেখার টেবিলে বসতে। লিখে ফেলি হয়তো গল্পের প্রথম বাক্য বা প্রথম কয়েকটি বাক্য। তারপর শুরু হয় এক অচেনা রাসায়নিক এবং জৈবিক বিক্রিয়া। কারণ এর পরে কী লিখব তা তো আমি জানি না। মাথার মধ্যে তখন গল্পের সম্ভাব্য গতি-প্রতিকৃতি, চরিত্ররা, নিসর্গ, ঘটনা-দুর্ঘটনার সমাহার একসাথে কাজ করতে থাকে। চরিত্রদের সাথে চলে আমার অবিরত সংলাপ, তর্ক-বিতর্ক, দ্বন্দ্ব-মিলন, হাসি-ঠাট্টা, এমনকী গালি-গালাজ পর্যন্ত। আমি যা করাতে চাই চরিত্র তা করতে চায় না। আমি যা বলাতে চাই চরিত্র তা বলতে চায় না। উল্টো তর্ক জুড়ে দেয়। আমাকে শেখাতে চায় যে গল্পকে গল্প হয়ে উঠতে হলে আমাকে এটাই করতে দিতে হবে বা বলতে দিতে হবে। আমি পাল্টা যুক্তি দিই। সে-ও আরো যুক্তি হাজির করে। এইভাবে শম্বুক গতিতে গল্প এগুতে থাকে। কখনো কখনো চরিত্র-র সাথে লেখকের বাহাস সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত লেখা স্থবির হয়ে পড়ে থাকে। এইরকম স্থবিরতা যখন অচলতায় পরিণত হয়, তখন সেই গল্পটি অসমাপ্ত ফাইলে জমা হয়ে পড়ে থাকে ভবিষ্যতের অপেক্ষায়। কখনো কখনো পরিত্যক্তও হয়, কারণ তাকে আর কখনোই সমাপ্ত করা সম্ভব হয় না।
আর যে গল্পটি একটু একটু করে এগুতে থাকে, সে প্রতিটি শব্দের সাথে সাথে আমাকে ফালা ফালা করে চিরে অগ্রসর হয়। সাধারণত শুরু থেকে একটি গল্পের শেষ শব্দটি লিখতে আমার সময় লাগে সাতদিন থেকে দেড়মাস পর্যন্ত। এই সময়কালে আমার অবস্থা থাকে অবর্ণনীয়। যেহেতু আমার মস্তিষ্কের ভেতরটা এই সময় থাকে অনর্গল কথা-বার্তা, বাদ-প্রতিবাদ, ঘটনা-দুর্ঘটনায় মুখর, তাই বাইরের জীবনে আমি প্রায়শই হয়ে পড়ি কম মনোযোগী, স্বল্পভাষী। বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া এড়িয়ে চলি সংগঠন, আড্ডা, অনুষ্ঠান। বাড়িতে খুব প্রিয় কোনো অতিথি এলেও মনে মনে বিরক্তই হই। তখন আমার প্রিয় কাজ হয়ে দাঁড়ায় একা একা রাস্তায় হাঁটা। আমি তো জানি না গল্পটি কখন শেষ হবে বা কোথায় গিয়ে শেষ হবে। তাই গল্প যত এগিয়ে চলে আমার ভেতরের অস্থিরতা তত বাড়তে থাকে। শেষ বাক্যটি লেখার পরে গল্প যখন জানায় যে সে পূর্ণতা পেয়েছে, তখন আমি বড়জোর একটা কাজ করতে পারি। তা হচ্ছে প্রচণ্ড ক্লান্তিময় সুখ নিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিছানায় এলিয়ে পড়া।
তার পরের কাজ হচ্ছে গল্পের একটি নাম দেওয়া, বার বার পড়ে লিখিত গল্পটিতে কোনো শিথিল বাক্য থাকলে তাকে পুনর্বিন্যস্ত করে ঋজুতা দেওয়া, কোনো একটি স্তবককে প্রয়োজনে নতুন করে লেখা, প্রয়োজনমতো কোনো শব্দকে পরিবর্তন করা। এবং অতি অবশ্যই কোনো শব্দের বানান নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে অভিধান দেখে শুদ্ধতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া, বা অশুদ্ধকে সংশোধন করা। এইসব পর্ব শেষ হলে সন্তোষজনক মনে হলে গল্পটি পাঠিয়ে দিই ছাপার জন্য। তারপর স্রেফ ভুলে যাই সেই লেখাটির কথা। অভিযাত্রা শুরু হয় নতুন লেখার পথে। সংক্ষেপে এই হচ্ছে আমার গল্প লেখার প্রক্রিয়া।
বড় লেখকরা নতুনদের জন্য তেমন কোনো সহায়ক বই লিখে যান না। তবে সাক্ষাৎকারে তারা নিজেদের লেখার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক কথা বলেন। অবশ্যই সেগুলো নতুন লেখকদের কাজে লাগে। আমার চোখে পূর্ণাঙ্গ বই খুব একটা চোখে পড়েনি। ব্যতিক্রম ম্যাক্সিম গোর্কির ‘প্রসঙ্গ সাহিত্য’। আর সৈয়দ শামসুল হকের ‘মার্জিনে মন্তব্য গল্পের কলকব্জা’। এই বই দুটি সহজলভ্য। প্রত্যেক নতুন লেখকই সংগ্রহ করতে পারেন। বিদেশি লেখকদের বই অবশ্য অনেকগুলোই আছে যেগুলো বাংলায় অনূদিত হয়নি। সেগুলো থাকলে ভালো। আর অবশ্যই একটি বই টেবিলে থাকত হবে লেখকের। তা হচ্ছে বাংলা অভিধান। যে কোনো ভালো অভিধান হলেই চলবে। বেশি হলে ভালো। ন্যূনতম একটা থাকতেই হবে।
সৈয়দ শামসুল হক বড় বেশি ভালোবেসেছিলেন আমাকে। লিখিত বইগুলোর বাইরেও সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিক, মঞ্চনাটক লেখা, কাব্যনাটক লেখা, অনুবাদ সম্পর্কে অনর্গল নির্দেশনা দিয়ে যেতেন আমাকে। বলতেন, ষাট বছর ধরে একা একা কষ্ট করে সব খুঁজে বের করতে হয়েছে। সঙ্গে করে কবরে নিয়ে চলে যাওয়ার চাইতে তোমাদের দিয়ে যেতে পারা অনেক শান্তির। তবে সেইসাথে এটাও বারবার মনে করিয়ে দিতেন, এইসব কলকব্জা তোমাকে রাস্তাটা ধরিয়ে দেবে কেবল। সাহিত্যে তোমার নিজের পথ তোমাকেই নির্মাণ করতে হবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক