
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ২৭
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুন ০১, ২০১৯
আমাদের দেশের সব লেখককেই কোনো-না-কোনো পেশায় জড়িত থাকতে হয় জীবন যাপনের জন্য। হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া অন্য সব বাণিজ্যসফল লেখকদের জন্যও এটি প্রযোজ্য। কারণ তাদের আর্থিক সফলতা অতখানি নয় যে শুধু লিখেই তারা সংসার চালাতে পারেন। আমাদের ধারার লেখকদের তো সেই প্রশ্নই আসে না।
বছর পাঁচেক আগে সায়ীদ স্যার (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) জিগ্যেস করেছিলেন লেখা থেকে আমি বছরে কী পরিমাণ টাকা পাই। মনে মনে হিসাব করছিলাম। পত্রিকা থেকে, প্রকাশক থেকে, বিভিন্ন সেমিনারের প্রবন্ধ লেখা ও আলোচনা থেকে, লেখক প্রকল্পের সম্মানী থেকে সবমিলিয়ে আড়াই লাখ টাকার মতো হবে। ‘আ-ড়া-ই লা-খ!’ সায়ীদ স্যার খুব অবাক হয়েছিলেন লেখালেখি থেকে আমার অর্থপ্রাপ্তির বিশাল অঙ্ক (!) শুনে। আমি হেসে বলেছিলাম, স্যার এক বছর সংসার চালানোর জন্য এই টাকাকে কী আপনি যথেষ্ট মনে করেন? তাছাড়া ঘটনা তো এমন নয় যে প্রতিমাসে আমি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাচ্ছি। ঈদের সময় লাখখানেক, বাকি সময় কোনো মাসে টাকা পাই, কোনো মাসে পাই না। তাহলে আমি চলব কেমন করে?
তাই সব লেখক-কবিরই জীবনযাপনের জন্য অন্য একটি পেশার ওপর নির্ভর করতে হয়। লেখালেখির পাশাপাশি কেউ শিক্ষক, কেউ সাংবাদিক, কেউ আমলা, কেউ টেকনোক্র্যাট, কেউ পুলিশ, কেউ আর্মি, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ ব্যাংকার, কেউ কৃষক, কেউ অন্যকিছু। কিন্তু একটা না একটা পেশা আছেই। আমি ডাক্তার, একথা শুনে অনেকেই অবাক হন। ডাক্তারি করে লেখালেখি! বিরক্তি আসে এমন ভাব দেখলে। ডাক্তাররা যেন লেখালেখি করতেই পারে না।
লেখালেখির জন্য কোন পেশাটি ভালো বা সহায়ক তা নিয়ে নানারকম বিতর্ক আছে। অনেকেই মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা হচ্ছে লেখালেখির জন্য সবচেয়ে অনুকূল পেশা। সেটি সত্যি হতেও পারে। আমি নিজে মেডিক্যাল কলেজে পড়তে চাইনি। পড়ার সময়ও একাধিকবার অন্যত্র চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ এখানে ছাত্রের সৃজনশীলতা বা মৌলিকতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। যা আছে পাঠ্যপুস্তকে, যা পড়াবেন শিক্ষকরা সেগুলোই পড়তে হবে। পরীক্ষার খাতায় লিখতে হবে। ভয়ঙ্কর ভাইভা এবং প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় সেগুলোই বলতে ও করতে হবে হুবহু। গবেষণা এবং অন্য কিছু চিন্তা করার সুযোগ আছে। সেটি পেকে ঝুনা হবার পরে। এমবিবিএস লেভেলে সেই সুযোগ আদৌ নেই। পড়া, ক্লাস, ওয়ার্ড, ওটি, প্র্যাকটিক্যাল— দম ফেলার ফুরসত নেই। সকাল সাড়ে সাতটায় ক্লাসে ঢোকো, দুপুর তিনটায় হোস্টেলে ফিরে একটু খেয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে পড়ো, তারপর সন্ধ্যায় ওয়ার্ডে যাও, রাত দশটায় রুমে ফিরে হিটারে খিঁচুড়ি তুলে দিয়ে পড়তে বসো, রাত দুইটায় খেয়ে বিছানায় যাও, পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় আবার ক্লাসে ঢোকো। আমার বান্ধবীদের কোনোদিন সাজগোজ করতে দেখিনি। তাই কোনো ছুটির দিনে বা কোনো অনুষ্ঠানে তারা সেজে-গুজে এলে সহজে চিনতে পারতাম না।
এই রকম জায়গা থেকে পালানোর জন্য মন তো হাঁসফাঁস করতেই পারে। চেষ্টাও তাই করেছি। কিন্তু পারিনি বাবা-মায়ের জন্য। তারা আমাকে ফের ঠেলে পাঠিয়েছেন সেই মেডিক্যাল কলেজেই। এখন তাদের ধন্যবাদ দিই। ভাগ্যিস পাঠিয়েছিলেন তারা!
প্রথম নিজের গুরুত্ব অনুভব করতে পেরেছিলাম গ্রামে চাকুরি করতে গিয়ে। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা জেলা শহরে। গ্রামে থাকিনি কোনোদিন। রাজনীতির কারণে যাওয়া পড়েছে অবশ্য। কিন্তু তাকে ঠিক গ্রামে থাকা বলে না। চাকুরিসূত্রেই প্রথম গ্রামে আসা। এবং অনুভব করা যে এই গ্রামবাসী লোকজনদের সত্যিই প্রয়োজন আমাকে। মানুষকে রোগ থেকে, কষ্ট থেকে, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি বা উপশম দিতে পারার মধ্যে যে কত আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আর গ্রাম মানেই শত চ্যালেঞ্জ। এখানে তো আমার প্রফেসর নেই, অভিজ্ঞ বড়ভাইরা নেই, যাদের সাথে রোগী নিয়ে আলোচনা করা যায়, সাহায্য চাওয়া যায়। যা করার তা আমাকেই করতে হবে, এবং তৎক্ষণাৎ করতে হবে। কাছে-পিঠে ভালো প্যাথলজি নাই, দূরে গিয়ে পরীক্ষা করে আনার সামর্থ্য ৯০ ভাগ গ্রামবাসীর নাই, তাই পুরোটাই রোগীর কাছ থেকে রোগের বর্ণনা শুনে আর ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা করে রোগনির্ণয় করতে হতো। আর সুস্থ হয়ে রোগীরা যেভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে আসত, তা একজীবনের খুব বড় প্রাপ্তি। সেই অভ্যেস থেকেই এখনো রোগীকে আমি খুব কম পাঠাই পরীক্ষার জন্য। হাইটেক রোগনির্ণয় ফ্যাসিলিটির কাছে আছি বলেই রোগীকে হাইটেক পরীক্ষা করাতে হবে, তেমনটি আমি মনে করি না। পরে তো অনেক বেতনের চাকুরি করেছি। অনেক ওপরে। পলিসি লেভেলে। কিন্তু সেই তৃণমূলে কাজ করার আনন্দের স্মৃতির সমান কোনোটাই নয়।
আমার লেখালেখির জন্য এই পেশার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। মানুষের এত কাছে অন্য পেশা দিয়ে যাওয়া যায় কি না আমার জানা নেই। অন্য কোনো পেশার মানুষের কাছে মানুষ এমনভাবে নিজেকে মেলে ধরে কি না সেটাও আমার জানা নেই। সবচয়ে না হলেও খুব বড় একটি ব্যাপার হচ্ছে এই পেশা আমাকে যতখানি স্বাবলম্বিতা এবং স্বাধীনতা দিয়েছে, তা অন্য কোথাও পেতাম বলে মনে হয় না। এমনকী অসুস্থ হয়ে চাকুরি ছেড়ে দেবার পরেও আমাকে ভাত-কাপড় নিয়ে একদিনের জন্যেও চিন্তিত হতে হয়নি। প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করার পরে আমার স্বাধীনতা আরো অনেক বেড়ে গেছে। কাজের স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, বলার স্বাধীনতা— সবকিছুই। জাতির সামনে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা এসে দাঁড়ালেও চাকুরিজীবী মানুষরা মুখ খোলার সাহস পায় না। উল্টো সেই জনবিরোধী কাজে নিজেরও হাত লাগাতে হয়। সরকার পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম পাল্টানোর মতো করে যোগ দিতে হয় বিজয়ী শিবিরে। তেইশ বছর ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, তারপরে পাঁচ বছর ‘জয় বাংলা’, তারপর পাঁচ বছর আবার ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, তারপর আবার ‘জয়বাংলা’ জপ করতে হয় না।
মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী নিউজ বা সম্পাদকীয় লিখতে হয় না। টক শো-তে গিয়ে দালালি করতে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদ পাওয়া বা ধরে রাখার জন্য ভাঁড়ামো করতে হয় না। সম্পাদক-প্রকাশকের নির্দেশে পাবলিক কী ধরনের লেখা খাচ্ছে (!) সেই ধরনের লেখা লিখতে হয় না। জীবনযাপনে এবং পেশাগত জীবনে ভণ্ডামি করতে গেলে নিজের লেখাতেও সেই ছাপ পড়ে। সৌভাগ্য যে সেই রকম মৌসুমী ভণ্ডামির আশ্রয় আমাকে নিতে হয় না। আমার পেশা তাই প্রতিকূলতা না হয়ে, হয়ে উঠেছে আমার লেখালেখি এবং আদর্শের রক্ষাকবচ। আব্বা-মাকে সালাম।
লেখক: কথাসাহিত্যিক