পলাশীর যুদ্ধ

পলাশীর যুদ্ধ

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৩০

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ০৪, ২০১৯

অনেকে বলেন যে, গান্ধী তার অহিংসার ধারণাটি পেয়েছিলেন তলস্তয়ের কাছ থেকে। কথাটা কতখানি সত্য তা জানি না। তবে গান্ধী যে খুব ভক্ত ছিলেন তলস্তয়ের, সেকথা সত্য। গান্ধী একটি চিঠি লিখেছিলেন তার প্রিয় লেখক-দার্শনিক তলস্তয়ের কাছে ভারতের তৎকালীন অবস্থার বিবরণ জানিয়ে। উত্তরে তলস্তয় লিখেছিলেন, ১০ হাজার ইংরেজ কীভাবে ৩৩ কোটি ভারতীয়কে অধীনস্ত রেখে দেড়শো বছর ধরে শাসনকর্ম চালিয়ে যেতে পারে, এমন কথা তিনি নিজে তো বটেই, কোনো রুশবাসীই, ভাবতেই পারবেন না। তাদের কাছে ব্যাপারটি বাস্তবতার বাইরের কোনো একটি ঘটনা বলে মনে হবে।

তলস্তয় হয়তো খেয়াল করেননি, সেই সময়ে ভারতবর্ষে সব মিলিয়ে মাত্র ১০ হাজার ইংরেজ থাকলেও তাদের অনুগত এদেশীয় শ্রেণির (অ)মানুষ ছিল লক্ষ লক্ষ। এই দেশকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত শাসন-শোষণ করত দালাল, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, রাজা, জমিদার, পাইক-পুলিশ, গুপ্তচর, এমনকী বঙ্কিমচন্দ্র বা সৈয়দ আহমদের মতো লেখকরাও। তাদের কাছে ব্রিটিশ শাসন ছিল আশীর্বাদ। এবং তারা মুক্তকণ্ঠে সেকথা স্বীকার এবং ঘোষণা করতে কোনোই দ্বিধাবোধ করেননি। ব্রিটিশদের হয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে গেছেন তারাই। বিনিময়ে পেয়েছেন শোষণের একটা অংশ।

রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত ঘটালেন বলে ইতিহাসে লেখা হয়। কিন্তু সেই পলাশীর যুদ্ধটা ছিল আসলে শেষ পরিণতি। সেই যুদ্ধের আগে অনেক বছর ধরে চলেছে কেনাবেচা এবং মন্ত্রণাযুদ্ধ। আবার এটাও দেখা গেছে, পলাশীর যুদ্ধ চলার সময়েও কাছের ক্ষেতখামারে কৃষকরা দিব্যি কাজ করে যাচ্ছে। কে যুদ্ধ করছে, কে রাজা হচ্ছে তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কারণ দেশে কী হচ্ছে বা না হচ্ছে তাতে তাদের মতামত দেবার বা অংশগ্রহণের কোনোই সুযোগ ছিল না। ক্লাইভ বোনের কাছে চিঠি লিখছেন এই বলে যে, তার বিজয়ী বাহিনী যখন মুর্শিদাবাদ শহরে ঢুকছে তখন রাস্তার দুইধারে ছাদের ওপর যত মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল তারা একটা করে ঢিল ছুঁড়লেও ইংরেজবাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। এমনই কাপুরুষ ছিল তখন এই দেশের মানুষ। আসল সত্যটা হচ্ছে তারা কেবলমাত্র কাপুরুষ নয়, বরং সমস্ত রাজকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন।

একই অবস্থা দেখতে পাই সাতচল্লিশের পোকায় কাটা স্বাধীনতা বা ভারতভাগের সময়। মওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’কে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে ধরা যায়। সেখানে সর্বোচ্চ ১০০ জনের নাম আছে ইংরেজ, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ মিলিয়ে। এই ১০০ বা তারও কম সংখ্যক মানুষ নির্ধারণ করছেন ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য। অসংখ্য বিদ্রোহ-বিপ্লব-রক্তদানের ঘটনা ঘটেছে দুইশো বছরে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৩৩ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছে মাত্র শতখানেক লোক। এবং তাদের মধ্যেও আবার মূল কুশীলব ছিলেন গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ, প্যাটেলসহ ডজনখানেক লোক। ভারত ভাঙার হুমকি জিন্নাহ হাতে রেখেছিলেন কংগ্রেসকে ব্ল্যাকমেইল করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু দেখা গেল নেহরু-প্যাটেল আগে থেকেই সেটি আঁচ করতে পেরে ভারত ভাঙার ব্যাপারে প্রস্তুত হয়েই বসে আছেন। আর কারো মতামতের দরকার নেই। গান্ধী-জিন্নাহ-নেহরু-প্যাটেল যা চাইবেন সেটাই হবে। সেটাই হয়েছে। ইনারা আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ। কিন্তু বাস্তবে পৃথিবীর বৃহত্তম এক্সোডাস, দীর্ঘস্থায়ী রক্তপাত, ধর্ষণকাণ্ড, স্থায়ী বিভেদ তৈরির জন্য দায়ী এই মানুষগুলোই।

বাংলা থেকেই ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত। আবার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সংগ্রাম, রক্তদান সবচাইতে বেশি করেছে বাঙালিরাই। অথচ ভারতের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নাই। এমনকী বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করা হবে কি না, সে ব্যাপারেও তাদের কাছ থেকে কোনো মতামত চায়নি কংগ্রেস, লীগ, ইংরেজ। শরৎ বসু-আবুল হাশিমরা যতই চ্যাঁচান, গান্ধী কর্ণপাতও করেননি তাদের কথায়। আবুল কালাম আজাদ বারবার বলতে চেয়েছেন যে, ভারত-বিভাগ হিন্দু-মুসলিম বিভেদের কোনো সমাধান হতে পারে না। পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ করে দিলে তাদের মনের ক্ষোভ কমে আসবে। এই কাজ শুরু করেছিলেন স্বরাজ পার্টির দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তার ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর মাধ্যমে। তার অকালমৃত্যু সেটিকে থমকে দেয়।

১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ এবং আসামকে আলাদা প্রশাসনিক বিভাগ করা হলে বাঙালি হিন্দুরা এই বিভক্তির বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও সবটুকু আবেগ নিয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বঙ্গভঙ্গ রদ করার আন্দোলনে। পরে অবশ্য সরে গিয়েছিলেন আন্দোলন থেকে। যে হিন্দুরা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন, সেই হিন্দু বাঙালি বুদ্ধিজীবীরাই আবার ১৯৪৭ সালে ঘোষণা দিলেন যে ভারত যদি বিভক্ত না-ও হয়, তবু বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করতেই হবে। আসল কারণ সেই সাম্প্রদায়িকতা। তখন আদম শুমারিতে দেখা গেছে অখণ্ড বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর উচ্চবর্ণের ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী হিন্দুর কাছে মুসলমান মানেই নমঃশূদ্র। সেই নমঃশূদ্রের অধীনে তারা থাকতে রাজি নন কোনোমতেই। তারা কেউ পড়েই দেখলেন না শরৎ বসু, আবুল হাশেম, কিরণশঙ্কর রায়দের প্রণীত অবিভক্ত স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলার প্রস্তাবিত সংবিধান। কলকাতায় রায়ট হলো। রায়ট কারা বাধায় তা সব সচেতন মানুষই জানে। সোহরাওয়ার্দী তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। আনন্দবাজার বড় করে হেডলাইন করল, সোহরাওয়ার্দী নিজে পিস্তল হাতে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করছে কলকাতার হিন্দুদের। এইভাবে অপ্রপচার চালিয়ে আনন্দবাজার কলকাতার দাঙ্গাকে ছড়িয়ে দিল সারা দেশে। তখন তো বাংলা বিভাগের দাবি আরো জোর পেয়ে যাবেই। আহমদ ছফা বলেছিলেন, ১৯০৫ সালে বাংলাকে প্রশাসনিকভাবে দুইভাগে ভাগ করাটা বহাল রাখলে পূর্ববঙ্গের উদীয়মান মুসলমান মধ্যবিত্ত হয়তো নিজেদের প্রসারিত করার সুযোগ পেত। ৪২ বছরে তারা হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে সমানে সমানে দাঁড়াতে পারলে হয়তো ১৯৪৭ সালের বাংলাভাগের প্রয়োজন পড়ত না। বাংলা কথা ভারতবর্ষের ইতিহাস অন্য রকম হলেও হতে পারত।

এসব যে ঘটেছে, তার পেছনের কারণও সেই একই। সাধারণ মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা। গুটিকয়েক মানুষ নিজেরা দেশের হর্তাকর্তা হয়ে বসবে। তারাই সব সিদ্ধান্ত নেবে। এই একই প্রক্রিয়া এখনো বহমান। বরং আমাদের দেশে অবস্থা আরো বেশি খারাপ। এখন কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি চাইলে হবে। না চাইলে হবে না। বঙ্গবন্ধু, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা— স্বাধীনতার পর থেকে সব আমলে এই একই অবস্থা। এমনকী সুন্দরবন থাকবে কি থাকবে না সে ব্যাপারেও জনগণের কোনো অংশেরই মতামতের কোনো মূল্য নেই। জনগণ সর্বশেষ ভোট দিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। অথচ দেশ নাকি চলবে ‘মদীনা সনদে’র ভিত্তিতে। যেহেতু একজন এটি চান।

এই রকম পরিস্থিতিতে সবচাইতে অস্বস্তিতে থাকার কথা লেখক-কবিদের। কারণ তারাই হয়ে থাকেন সমাজের সবচাইতে সংবেদনশীল এবং দূরগামী চিন্তার মানুষ। কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশি নীরব। তারা খুব ভালো করেই জানেন যে ইতিহাস কেবলমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান নয়, সকলেরই বিচার করবে। তবে তাদের নিজেদেরও যে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে সেকথাটা বোধহয় ভুলে গেছেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক