ঢাকা শহর

ঢাকা শহর

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৩১

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ০৫, ২০১৯

চারশো বছরের শহর ঢাকা নিয়ে কোনো ভালো উপন্যাস নাই আমাদের সাহিত্যে। অথচ সিংহভাগ লেখকই বাস করেন এবং করতেন ঢাকাতে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা পেলাম না কোনো উপন্যাস। কারণ কী? একটি কারণ হতে পারে ক্ষমতার অভাব। কিন্তু সকল লেখকের ক্ষেত্রে তো একথা প্রযোজ্য হতে পারে না। কারণ অনেকেই বিভিন্ন উপন্যাসে নিজেদের ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাহলে আরেকটি কারণ হতে পারে যে, ঢাকাতে তারা বাস করেন বটে, কিন্তু ঢাকাকে সেইভাবে চেনেন না। অন্তত যতটুকু গভীর পরিচয় থাকলে একটি শহরকে নিয়ে জেমস জয়েসের ‘ডাবলিনার্স’ বা ওরহান পামুকের ‘ইস্তাম্বুল’ এর মতো বই লেখা যায়, ততটুকু পরিচয় তাদের নেই ঢাকার সাথে।

ঢাকাবাসী যতজন লেখকের সাথে আমার পরিচয় আছে, দেখেছি তাদের প্রত্যেকেরই দিনযাপনের গণ্ডি অত্যন্ত সীমিত। পেশাগত কাজে তারা বাইরে যান, সেই যাওয়া-আসার পথে যেটুকু জ্যামক্লান্ত চোখে দেখতে পান, আর কর্মস্থলে কলিগ এবং কাজে আসা লোকজন, তারপরে অফিস ছুটির পরে রুদ্ধশ্বাসে সংসারের কিছু জিনিসপত্র কিনে বাসায় ফেরার তাড়া। এর বাইরে আছে সপ্তাহে বা পনেরো দিনে নিজ নিজ বলয়ের লেখক-কবিদের সাথে কিছু আড্ডা। মাসে-দুইমাসে শিল্পকলায় নাটক বা চিত্র প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া। পাড়া-মহল্লা তো দূরের কথা, একই বিল্ডিংয়ের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সাথেও ভাব বিনিময় নাই বললেই চলে। রোজকার ঢাকা শহরের আপ-টু-ডেট তাকে জানতে হয় খবরের কাগজ বা টিভির খবরের মাধ্যমেই। এ তো শুধু মাত্র কিছু ঘটনা জানা। শহরকে জানা নয়। ঢাকা শহরে বসে সে যা শুনছে, মফস্বলে বসে সেই একই তথ্য পাচ্ছে সেখানকার টিভি দর্শক। লেখকের ঢাকা চেনা তো এইরকম হবে না।

এই শহরে এখন প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস করে। হাজার রকম পেশা তাদের। এদের মধ্যে অন্তত দেড় কোটি মানুষ নিজের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে নেহায়েত প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্যে ঢাকাতে এসে জুটেছে। কারণ দেশের কোথাও কর্মসংস্থান নেই। কেউ উচ্ছেদ হয়েছে কৃষক-ক্ষেতমজুরের বৃত্তি থেকে, কেউ মাছধরা থেকে, কেউ ক্ষৌরকর্ম থেকে, কেউ ছোট ছোট ব্যবসা থেকে। ঢাকাতে এলে কোনোরকমে প্রাণটা ধারণ করা যায়। কারণ সারাদেশের কালো টাকা ঢাকাতে বিনিয়োগ হয়। তার উচ্ছিষ্ট দিয়ে বেঁচে থাকে মজুর-মেথর-কুলি, রিক্সা-সিএনজি চালক, গার্মেন্টকর্মী, ভ্যানচালক, হকার, সবজিবিক্রেতা, চায়ের দোকানদার— এইরকম হাজারটা পেশার মানুষ। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঢাকাতে বাস করে খুব কষ্টে। তার সাথেই এই ধরনের বিভিন্ন পেশার মানুষদের আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি হয়। কারো হয়তো ট্রেন-বাস ধরতে হবে, কারো পরিবারের কেউ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে পড়ে আছে, তার তখন ত্বরিৎ দরকার একটি রিক্সা বা সিএনজি। কিন্তু আধাঘণ্টা নিরন্তর চেষ্টা করেও সে পারছে না কোনো সিএনজি চালককে সেইদিকে যেতে রাজি করাতে। খুব জরুরি রোগীর দোহাই দিলেও কাজ হয় না। তখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত তাকে গালি দেয় অমানুষ বলে। এটি রোজ ঘটে। অসংখ্য ঘটে। কিন্তু কেউ মনে রাখে না যে এই সিএনজিঅলা মানবতা দেখানোর জন্য ঢাকা শহরে আসেনি। এসেছে জীবন বাঁচাতে। নিজের এবং পরিবারের। মানবতা দেখালে তার বরং ক্ষতিই হয়ে যাবে। সেই ক্ষতি সে স্বীকার করবে কোন দুঃখে?

জন্মসূত্রে ঢাকায় বাস করা লেখকের সংখ্যা খুবই কম। বেশিরভাগই শিক্ষাজীবন শেষ করে ঢাকাতে এসেছেন থিতু হতে। বুকে কবি বা লেখক হবার স্বপ্ন নিয়ে। তো প্রথমে তাকে নিজের জন্য একটা জায়গা করে নিতে হয়। কোনো চাকুরির সংস্থান বা কোনো একটি কর্মসংস্থান। তারপরে নিজের জীবন এবং সংসারকে গুছিয়ে নেওয়া নেয়া। ততদিনে মেঘে মেঘে বেলা পেরিয়ে যায়। চাকুরি-ব্যবসা-সংসার করার পরে লেখার উপাদান সংগ্রহের জন্য যে বাড়তি জীবনীশক্তি দরকার হয়, তার সামান্যই অবশিষ্ট থাকে তার মধ্যে। একই দিনচক্র, কর্মচক্র এবং সঙ্গচক্রে ঘুরপাক খেতে হয় তাকে। এইসব কারণে দেখা যায়, ঢাকাবাসী লেখকরা হালকা-পাতলা, অথবা জটিল পরকীয়া প্রেম-ট্রেমের গল্প লেখার পাশাপাশি ইংরেজি-ফরাসি-লাতিন সাহিত্য পাঠ করে সেই ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার গল্প বেশি লিখেন। তাদের লেখাতে আখ্যানের গভীরতা কম থাকে স্বাভাবিকভাবেই। সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তারা কব্জির কসরত আর কেরামতি দেখাতে চান খুব বেশি। কেউ কেউ বেশি ঝুঁকে পড়েন অনুবাদের দিকে। আর বেশিরভাগই বাংলাভাষায় লেখেন লাতিন-ইংরেজি-ফরাসি গল্প। পড়লে বোঝা যায় পাত্রপাত্রী বা স্থানের নামগুলো বাংলাদেশের মতোই, তবে তারা যে ভাষায় কথা বলে বা যেভাবে চিন্তা করে তা বাংলার সাথে মেলে না। খুব গভীর চিন্তার লেখাই বটে! কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে দশকের পর দশক ধরে একটি সম্মানজনক জীবনের জন্য লড়াই করে আসছে, সেই লড়াইয়ের কোনো চিহ্ন গল্পগুলিতে পাওয়া যায় না। ফলে তাদের পাঠক কমতে থাকে। আর তারা এই আত্মপ্রসাদে ভুগতে থাকেন যে তাদের চিন্তা খুবই মৌলিক বলেই সাধারণ মানের মধ্যবিত্ত পাঠক তাদের সাথে তাল মেলাতে পারে না। তারা তখন মানুষের সাথে মেলামেশা আরো কমিয়ে দিয়ে আরো আরো বিদেশি বই পড়তে থাকেন।

আমাকে বা আমার মতো কাউকে কাউকে তারা বলেন, দারিদ্র্য বেচে সাহিত্য করা লেখক। সেই উক্তির উত্তর আমি আগেও দিয়েছি। আমি নিজে নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র মানুষকে চিনি বলে তাদের নিয়েই লিখি। অচেনা মানুষ নিয়ে লিখতে যাওয়া দুর্বল এবং অপেশাদার লেখকের কাজ। তবে সেইসাথে প্রশ্নও করি, তারা কয় জেনারেশনের ধনী? তাদের বাপ-দাদার পেশা কী ছিল? খোঁজ নিলে দেখা যাবে মাত্র এক জেনারেশনের আদমব্যবসা নাহয় কারো ব্যক্তিগত টাকা অথবা ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়া ধনী তারা। অথবা সরকারদলীয় রাজনীতির ছত্রছায়ায় লুটপাট। বেশি হলে গার্মেন্ট ব্যবসা। সেটাও তো সরকারি মদদপুষ্ট হয়ে গরিব-ঠকানো ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার অভিজ্ঞতা বলে, ‘জাদুবাস্তবতার গল্প’ লেখা তুলনামূলক সহজ কাজ। কিন্তু ‘বাস্তবতার জাদু’ গল্পে তুলে আনা, শৈল্পিক নান্দনিকতার সাথে তুলে আনা হচ্ছে এই দেশের লেখকের শক্তিপরীক্ষার আসল জায়গা। চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক