
কাজী নজরুল ইসলাম
রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা
পর্ব ৩২
জাকির তালুকদারপ্রকাশিত : জুন ০৭, ২০১৯
ঢাকঢোল পিটিয়ে দামামা বাজিয়ে নিশান উড়িয়ে বাংলাসাহিত্যকে উদ্ধার করতে আসা অন্তত দশজনকে দেখেছি আমি আমার লেখকজীবনে। তারা আসে বিশাল ডুগডুগিবাদকের দল সঙ্গে নিয়ে, বিপুল আর্থিক বিনিয়োগ নিয়ে, প্রচারণার নতুন-পুরাতন কৌশল নিয়ে, বড় পত্রিকা এবং মিডিয়ার আশীর্বাদ নিয়ে, সাহিত্যের বৃদ্ধদের সার্টিফিকেট নিয়ে। তাদের শোরগোলে মনে হয় যে, বাংলাসাহিত্যে সে ছাড়া আর কেউ নেই। তার আগেও কেউ ছিল না। বইমেলা হয়ে যায় তখন রঙের কারখানা। আগে থেকে ভাড়া করা ৫০-৬০-৭০ তরুণ-তরুণীর দল বইমেলার গেটে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। তাকে সঙ্গে নিয়ে মিছিলের মতো করে হেঁটে যায় বুকস্টলের দিকে। ভিড় করে লেখক বা প্রকাশকেরই টাকায় অটোগ্রাফসহ কিনতে থাকে তার বই। অদীক্ষিত, এবং সারা বছর সাহিত্যের সাথে সম্পর্ক না রাখা পাঠকরাও গ্ল্যামার এবং প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে এবং ভিড় দেখে ভিড় জমায় সেখানে। গাঁটের পয়সা খরচ করে কিনে নিয়ে যায় প্রচারিত লেখকের বই। তারপর সেই বই নিয়ে কী করে তা তারাই জানে। সেইসাথে হয় বিশাল বাজেটের একাধিক বর্ণাঢ্য প্রকাশনা উৎসব। ভাড়াটে আলোচকরা স্তবগাথা গেয়ে অভ্যর্থনা জানান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রতিভাকে (!)। মিডিয়া সয়লাব হয়ে যায় ফটো এবং আলোচকদের প্রশংসার চুম্বক বাক্যগুলিতে। এখন ফেসবুকও।
লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশের অনেক আগে থেকেই আমি বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের খুব নিবিড় একজন পর্যবেক্ষক। পাঠক হিসাবেও যেহেতু সর্বভূক, তাই বড়, ছোট, মৌলিক, গৌণ কোনো লেখক-কবির বই-ই অছোঁয়া ছিল না আমার। সে ঢাকারই হোক আর মফস্বলেরই হোক। তাই আমার সিনিয়র এবং সমকালীন জীবিত লেখক-কবিদের লেখার মান সম্পর্কে আমার মোটামুটি পরিষ্কার ধারণা আছে। কিছু জুনিয়রেরও। সেই সাথে কোথায় কোন লেখক-কবি কোন্ কোন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে সেইসব খবরও রাখতে কার্পণ্য করিনি। বইমেলার সময় স্টান্টবাজির হিড়িক কম-বেশি সবসময়ই ছিল এবং আছে। হয়তো থাকবেও আরো অনেক বছর। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে কয়েক বছর অন্তর অন্তর একজন করে বাংলাসাহিত্যের ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটে। সেই বছরের পাঠক দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ হচ্ছে সেই লেখকের বই পড়েছে, আরেক ভাগ পড়েনি। কিন্তু কয়েকদিন পরেই দেখা যায় ভাটার টান। কোনো বুদ্বুদ না রেখেই সেই আলোচিত লেখক-কবি মিলিয়ে যায়। মাঝখানে ক্ষতির মধ্যে ক্ষতি করে যায় কিছু নতুন লেখক-কবির, যারা প্রভাবিত এবং বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে ঢাকঢোলের শব্দে। সাহিত্যের ধর্ম এবং এগিয়ে চলার গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে যাদের ধারণা আছে, তারা জানেন যে, এই রকমটাই ঘটবে।
সাহিত্যে হঠাৎ করে কোনো প্রতিভার আগমন ঘটে না। কোনো প্রস্তুতি ছাড়া একটা বই লিখে কেউ সাহিত্যে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে পারে না। ‘প্রস্তুতি’ শব্দটিকে খুব খেয়াল করতে হবে। প্রকৃতিদত্ত বা ঈশ্বরদত্ত প্রতিভার কথা আমরা বলি। কিন্তু অনুশীলন এবং পঠন-পাঠনে শান না দিয়ে সেই প্রতিভা বিকশিত বা প্রকাশিত হতে পারে না। বাংলাকবিতায় বিপ্লব আনা দুই বর্ণাঢ্য কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং কাজী নজরুল ইসলামও কোনো ব্যতিক্রম নন। বইমেলার সাড়ে চার হাজার বইয়ের জনক-জননীদের মধ্যে চার হাজার জনই লোকমুখে শুনে শুনে মনে করেন যে, নজরুলের আবির্ভাব একেবারে ধূমকেতুর মতো আকস্মিক। তাঁর কোনো প্রস্তুতি লাগেনি কবি হতে, তাঁকে কোনো পড়াশুনা করতে হয়নি। কিশোর বয়স থেকে লেটোর দলে গান লিখেছেন নজরুল। সেগুলো তো নিশ্চয়ই ছিল গতানুগতিক। লেটো গান শুনে বা পড়ে কেউ নজরুলকে কবি হিসাবে স্বীকৃতি দেননি। ছোটবেরা থেকেই তিনি যে বাংলাসাহিত্য এবং আরবি-ফারসি সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন, সেই তথ্য আমরা কেউ মনেই রাখি না। নজরুলের কবি হিসাবে সত্যিকারের আবির্ভাব করাচির পল্টন থেকে ফিরে আসার পরে। সেই পল্টন যুদ্ধে যায়নি। তাই নজরুলকেও যুদ্ধে যেতে হয়নি। কিন্তু পল্টনজীবন নজরুলকে সুযোগ করে দিয়েছিল ব্যাপকভাবে ফারবি-ফারসি ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠের। কিছুটা ইংরেজি সাহিত্যের পাঠও পেয়েছিলেন তিনি। এমনকী রুশ সাহিত্যের সাথেও তাঁর পরিচয় ঘটেছিল এই পল্টনে থাকাকালেই। করাচি থেকে কলকাতায় ফিরেই সূত্রপাত ঘটে তাঁর সত্যিকারের কবিজীবনের। নজরুল যে বিপুল পড়াশোনা করতেন, তার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর লেখা প্রবন্ধ এবং সম্পাদকীয়গুলোতে।
আর মধুসূদনের কবিজীবনের প্রস্তুতি তো কিংবদন্তি হয়ে আছে। প্রথমে ইংরেজি ভাষায় লেখার জন্য ইংরেজি ভাষা এবং সাহিত্য তন্নিষ্ঠভাবে আত্মস্থ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে যখন বাংলায় লিখতে আসেন তখন বাংলাসাহিত্যের ভাণ্ডারও তিনি আত্মস্থ করেছিলেন সমান নিষ্ঠায়। তারপরেও কেউ কেউ সুকান্ত এবং সোমেন চন্দর কথা বলার চেষ্টা করেন। অকাল প্রয়াণই তাঁদের সম্পর্কে এই মিথ ছড়াতে সাহায্য করে যে তাঁরা কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই বাংলাসাহিত্যে বিস্ময়কর কিছু গল্প এবং কবিতা উপহার দিয়ে গেছেন। সোমেন চন্দ যে তাঁর এলাকার পাঠাগারের সবচাইতে নিয়মিত এবং একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন সেকথা তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিকথায় অনেকেই বলে গেছেন। আর সোমেনের চিঠি থেকে বোঝা যায় যে পড়াশোনাকে তিনি কত বেশি গুরুত্ব দিতেন। এমনকী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার প্রশংসা করেও সোমেন চন্দ চিঠিতে লিখছেন যে মানিকের লেখা থেকে তাঁর পড়াশোনার ঘাটতি (!) টের পাওয়া যায়। আর সুকান্ত পারিবারিক পরিবেশেই পেয়েছিলেন সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি পাঠের সুযোগ। সেগুলোর সদ্ব্যবহারও যে তিনি করেছিলেন, তার প্রমাণ তো তাঁর কবিতাগুলোতেই স্পষ্ট।
এতক্ষণ ধরে যে কথাটি বলতে চেয়েছি তা হচ্ছে ঢাকঢোল বাজানো স্টান্টবাজরা আসে এবং আসবে। এবং তারা মিলিয়েও যাবে। তাদের নিয়ে তাই বেশি চিন্তার কোনো কারণ নেই। বরং আমি নিজেকে এবং অনুজদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে লেখক-কবি হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে গজানো কোনো প্রাণী নন। তাঁকে সৃজন এবং নির্মাণ করতে হয় নিজেকেই। সাহিত্য নামক অন্তহীন পথ পাড়ি দিতে হয় পায়ে হেঁটে, কখনো বুকে হেঁটে, নিজেকে রক্তাক্ত করতে করতে। লেখক-কবির জন্য কোনো শর্টকাট পথ নেই। কোনোদিন ছিল না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক