আহমদ ছফা

আহমদ ছফা

রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৩৩

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ০৯, ২০১৯

বাংলাদেশের লেখক-কবিদের মধ্যে বর্ণাঢ্য এবং বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশই ছাপোষা মানসিকতা এবং প্রচলিত চিন্তা ধারণ করে জীবন কাটিয়ে দেন। বড়জোর কিছু মদ-গাঁজা খাওয়া আর খুচখাচ পরকীয়াতেই সীমাবদ্ধ তাদের জীবনের অ্যাডভেঞ্চার। ভালো লেখা তো সব লেখক-কবির জন্যই পূর্বশর্ত। তবে সেইসাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, মিছিলে যাওয়া, বুকে পোস্টার বেঁধে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাওয়া, রাষ্ট্রের প্রচারিত একপাক্ষিক ইতিহাস, চিন্তা ও ন্যারেটিভগুলোকে লেখায়-বক্তৃতায়-সাক্ষাৎকারে চ্যালেঞ্জ জানানো, পৃষ্ঠপোষকতা-পদ-পদবি-পুরস্কারের দিকে না তাকিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ এবং গোষ্ঠীস্বার্থগুলোকে উদোম করে দেওয়া— এইসব বিষয়কে ধারণ করেছেন খুব অল্প মানুষ। এমনকী দুর্দান্ত এবং প্লাবনের মতো প্রেমের কিংবদন্তিও নেই আমাদের দেশের লেখক-কবিদের। তাই বারবার সেই অল্প কিছু মানুষই উঠে আসেন আলোচনায়। কখনো উদাহরণ হিসাবে, কখনো নিন্দাবাদের উছিলায়।

আহমদ ছফার ঘরে ঢুকে কোনো কোনোদিন দেখা যেত তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটানা গান করে যাচ্ছেন। কেউ ঢুকলেও গান না থামিয়ে চোখের ইশারায় সিগারেটের প্যাকেট দেখিয়ে দিতেন। আমাদের অনেকেরই জানা নেই যে, বাংলাদেশের খুব বিখ্যাত কয়েকটি গান আহমদ ছফার লেখা। কিন্তু সুর ছিল না তার কণ্ঠে। গান উঠত বেসুরের চরম উচ্চতায়। এর মধ্যেও কোনো কোনো কলি গাইবার সময় শ্রোতার দিকে তাকিয়ে ভ্রুভঙ্গি করতেন। ভাবখানা এমন যে, কেমন দিলাম! হাসি চেপে রাখা মুশকিল হতো শ্রোতার। কতক্ষণ একটানা সেই গান চলবে কেউ জানে না। থামবেন তিনি নিজের ইচ্ছায়। কেউ শুনতে না চাইলে চলে যেতে পারে। অনেক জরুরি খবর নিয়ে কেউ এলেও তাকে অপেক্ষা করতে হবে গান থামার। একটা গান শেষ করে আরেকটা শুরু করার ফাঁকে কেউ কিছু বলতে চাইলে একেবারেই উপেক্ষা করতেন তাকে। একসময় গান শেষ হতো। হারমোনিয়ামটা দূরে ঠেলে দিয়ে গোল্ডলিফ সিগারেট ধরিয়ে একটু আফসোসের সুরে বলতেন, আল্লাহ সুরটা একেবারেই দেয়নি আমার কণ্ঠে!

কিন্তু অবচেতনে গান নিয়ে স্বপ্নটা বরাবরই লালন করে গেছেন। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে একটা মৃদু স্ট্রোকের মতো হয়েছিল। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতেই ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন, কাল তো আমার গানের যৌথ প্রোগ্রাম আছে নুসরাত ফতেহ আলী খানের সাথে। উনি কি এসেছেন ঢাকায়?

বুঝলাম, জ্ঞান ফিরলেও আচ্ছন্নতার মধ্যে আছেন। পুরোপুরি সজ্ঞান নন। নুসরাত ফতেহ আলী খান মারা গেছেন চার বছর আগে। ছফা ভাইয়ের স্মৃতিতে তা আদৌ নেই। আমি উত্তর দিলাম, এসেছেন তিনি।
কোথায় উঠিয়েছ তাকে? মানে ঢাকাতে উনি আছেন কোথায়?
তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ফাইভস্টার হোটেলের নাম মনে এল না। বলে ফেললাম, ব্র্যাক ইন-এ।
কয়েকদিন আগে সেখানে গিয়েছিলাম আমি কোনো একটি কাজে। মুখ দিয়ে তাই বেরিয়ে এল সেই জায়গার নাম।
ছফা ভাইকে সন্তুষ্ট মনে হলো। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

পুরো সুস্থ হয়ে ফিরবার পরে তার স্মৃতিতে ঠিকই ছিল আমার সাথে কথপোকথন। বললেন, আচ্ছন্ন অবস্থায় কী সব বলেছি তাই না? তবে গান আমার স্বপ্ন। তাই আধা-অজ্ঞান অবস্থাতেও গানের কথাই মনে এসেছে।

আরেকটি জিনিস দেখে খুব মজা পেতাম। তিনি হয়তো গভীর কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। আমরা তন্ময় হয়ে শুনছি, কখনো কখনো মৃদু তর্কও করছি, কখনো পুরোপুরি সমর্থন করছি। এই রকম সময়ে কোনো মেয়ে ঢুকল ঘরে। ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে সব আলোচনা স্তব্ধ। ছফা ভাইয়ের পুরো মনোযোগ মেয়েটির/নারীটির প্রতি। খুব সুরেলা প্রশ্ন করতেন, কেমন আছো তুমি? কতদিন আসোনি! আগে বসো। বসো। আরাম করে বসো।

তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে চায়ের অর্ডার দিতে চাইতেন। উঠে দাঁড়িয়ে বলতাম, আমি যাচ্ছি চায়ের কথা বলতে। আর কে কে খাবেন?

ব্যাপারটি নিয়ে আমি চিন্তা করেছি। আমার কাছে প্রথমদিকে হাস্যকর মনে হলেও পরে বরং একটু কষ্টই লাগত। শুনেছি যৌবনে ছফা ভাই প্রেমে পড়েছেন একাধিকবার। এবং কোনো সাধারণ মেয়ের প্রেমে পড়তেন না তিনি। যাদের কথা শুনেছি তারা ছিলেন ঢাকার সবচাইতে অগ্রসর, সবচাইতে সুরুচিসম্পন্না, সবচাইতে বিদুষী, সবচাইতে সাহসিনী যুবতী। তারাও ছফা ভাইকে সঙ্গ দিতেন। ছফা ভাইয়ের সঙ্গ পছন্দও করতেন। কিন্তু কেউ-ই ছফা ভাইয়ের প্রেমে পড়ার মতো বোকা ছিলেন না। চাল-চুলোহীন, উচ্চতর ডিগ্রিহীন, চেহারা গ্ল্যামারহীন, বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের সম্পদহীন-পদহীন আহমদ ছফা যতই মেধাবী হোন না কেন, তার প্রেমে পড়া বা তাকে বিয়ে করাটা একটু বেশিই বোকামি হয়ে যায় সবচেয়ে উদার নারীর পক্ষেও। ছফা যে ভবিষতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে যেতে পারবেন না, তা উপলব্ধি করতে পারতেন সবাই। ছফা ভাইয়ের প্রেম বা সংসার করা আর হয়ে ওঠেনি।

একবার আহমদ শরীফ স্যারের অধীনে পিএইচডি করতে গিয়েছিলেন ছফা ভাই। কিছুদিন পরে স্যার ছফা ভাইকে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকায় তাকে (স্যারকে) নিয়ে একটি বড় লেখা লিখতে। তাহলে স্যারের প্রমোশনের সুবিধা হবে। একথা শোনার পরে ছফা ভাই আর যাননি আহমদ শরীফ স্যারের কাছে। পিএইচডি ওখানেই শেষ। তার কথা ছিল, যে শিক্ষকের প্রমোশন পাওয়ার জন্য তাকে নিয়ে ছাত্রের লেখা প্রবন্ধ দরকার হয়, সেই শিক্ষকের অধীনে পিএইচডি করার ফায়দাটা কী?

অনেকের ধারণা কেবলমাত্র ডানপন্থী ও আওয়ামীপন্থীদের সমালোচনা করতেন ছফা ভাই। কিন্তু যাকেই তিনি মনে করতেন আদর্শ থেকে বিচ্যুত মানুষ, তারই খোলামেলা সমালোচনা করতেন তিনি। শুধু মুখে বলেই ক্ষান্ত হতেন না। লেখার মাধ্যমেও পাঠকদের কাছে উদোম করে দিতেন। তিনি বামপন্থী হোন আর যা-ই হোন। তো এই রকম মানুষ পদ-পদবি-পুরস্কার পান কী করে! আর এই রকম মানুষ না হলে তিনি আহমদ ছফাই বা হন কী করে!

লেখক: কথাসাহিত্যিক