রক্তমাখা চাঁদের আলো অথবা নিজের কথা

পর্ব ৩৪

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : জুন ১০, ২০১৯

কীভাবে কীভাবে যেন মদ-গাঁজা-মাদকের সাথে আমার কোনোই সখ্য তৈরি হয়নি। তার মানে এই নয় যে, যারা ওসব খায় তাদের তুলনায় আমি নিজেকে বড় বা শুদ্ধ কিছু মনে করি। তারুণ্যের শুরুতে খুব শুনতাম যে, লেখক-কবি-শিল্পীরা মদ-টদ খায়। নইলে নাকি ঠিকমতো শিল্প করা যায় না। তো তেমন কিছু আমার ক্ষেত্রে না ঘটায় ভাবছিলাম যে আমার দ্বারা বোধহয় শিল্প হবে না। তবে এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, লেখালেখির জন্য অন্য কোনো নেশা অপরিহার্য নয়। নেশার ঘোর দরকার নেই। বরং শরীর যত সুস্থ থাকবে, মন যত পরিষ্কার থাকবে, লেখালেখির জন্য ততই অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হবে।

তবে আমি যে একেবারে অসূর্যম্পশ্যা, তা কিন্তু নই। একবার দ্বিজেন কোবরেজের দোকান থেকে মদকের গুলি কিনে নিয়ে সন্ধ্যার সময় নববিধান বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে বসে খেয়েছিলাম বাপ্পী আর আমি। তারপরে আজিমের দোকানে এসে গুড়ের দাঁদভাঙ্গা আর ভুনা চা। একটু পরেই খেয়াল করলাম, আমার চারপাশের পৃথিবী টলছে। বাড়িতে এসে সোজা বিছানায় চলে গেছি। রাতে মা ডাকতে এলো খাওয়ার জন্য। কোনোমতে বললাম, খাবো না। কিন্তু মা কি তাই শোনে! রাতে উপোস দিলে কী কী সব হয় বলে জামবাটিতে দুধ-ভাত-কলা মেখে এনে রাখল পাশের টেবিলে। বাধ্য হয়ে নিজেকে টেনে তুলে খাওয়ার উদ্যোগ নিতে হলো। কিন্তু খাই কী করে? যতবার বাটির দিকে হাত বাড়াই, হাত বাইরে পড়ে। মা গজগজ করে, ঘুম পাইলে ছাওয়ালডার আর কোনো হুঁশই থাকে না। যা ঘুমা। আর খাওয়া লাগবি না।

তওবা নাক খপ্তা! তবে আমার বন্ধুভাগ্য যে খুব ভালো তা বিভিন্ন সময়ে বলেছি। বন্ধুরা কোনো কোনোদিন মদের আসর বসাত। আমাকে কেউ খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করত না। বরং বলত, তুমি খাও না যখন, এসব খাওয়ার দরকার নাই। তুমি রুটি-মাংস খাও।

বন্ধুদের মধ্যে আমি বাপ্পীকে উৎসর্গ করেছি ‘কবি ও কামিনী ‘ উপন্যাসটি। আমরা ক্লাস থ্রি থেকে একসাথে পড়াশোনা করেছি। বাড়িও একই পাড়ায়। ফর্সা ধবধবে ছেলে। আইরিশদের মতো নীল চোখ। ডিফেক্ট একটাই। ছোটবেলায় পোলিও-তে আক্রান্ত হয়ে একটা পা দুর্বল হয়ে গেছে। কিন্তু সেই বাধা তার কাছে তুচ্ছ। আর তার মতো মেধাবী আমি এ পর্যন্ত আর কাউকে দেখিনি। যাতে হাত দিত তাতেই সোনা ফলাত। সে যা ইচ্ছা তা-ই হতে পারত। কিন্তু নিজের যৌবন এবং প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া সে বিসর্জন দিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি করতে গিয়ে। অভ্যাসবশত যা-ই করত, তা করত সম্পূর্ণ ডেডিকেশন দিয়ে। বিপ্লবের জন্য কাজ করে গেছে সম্পূর্ণ মনপ্রাণ দিয়ে। তারপর এল সেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্বপ্নভঙ্গের কাল। এতই ভেঙে পড়ল বাপ্পী যে সবার সাথে যোগাযোগই বন্ধ করে দিল। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তখন আওয়ামী লীগে যোগদানের হিড়িক পড়ে গেছে। একানব্বই-এর নির্বাচনে নৌকা ডুবল সব ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা করে দিয়ে। বাপ্পী তখন কারো সাথে যোগাযোগ রাখে না। হঠাৎ একদিন টিভিতে দেখলাম গণভবনে খালেদা জিয়ার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে সে বিএনপি-তে যোগ দিচ্ছে। নাটোরে ফিরে এসে বলল, নষ্টই যখন হবো তখন সরকারি দলে যোগ দেওয়াই ভালো।

বিএনপি-র জেলা এবং উপরের পর্যায়ের নেতৃত্ব তার মেধাকে দারুণ সম্মানই করত। যতটুকু পেরেছে সে মানুষের উপকার করেছে। অনেক মানুষকে বিএনপি-ক্যাডারদের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু বিএনপির ভেতরের রাজনীতির সাথে কোনোদিনই খাপ খাওয়াতে পারেনি সে। স্থানীয় পর্যায়ে আড়াল থেকে ল্যাঙ মেরেছে তাকে অনেকেই। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে সরে গেছে বাপ্পী। আমাদের আরেক বন্ধু হানিফ আলী শেখ। লেখক-নাট্যকর্মী। অনেক দোনোমনো করে শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরীর আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিল। একানব্বই-পরবর্তী সময়ে নাটোরে আওয়ামী লীগ করার লোক হাতে গোনা। সেই সময় চরম প্রতিকূলতা পেরিয়ে হানিফ আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নিয়েছে একটু একটু করে। যেহেতু তখন ডেকেও লোক পাওয়া যেত না, তাই হানিফকেই শঙ্কর চৌধুরী বানিয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। জীবনের হুমকি মাথায় নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছে হানিফ। তখনকার সরকারি দল বিএনপি-র ভেতর থেকে বাপ্পী পুরোটা সময় প্রটেকশন দিয়েছে হানিফকে। নিজের ঘরেও রেখেছে তাকে মাসের পর মাস। নাটোর জেলায় আওয়ামী লীগ মানেই তখন হানিফ। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে হানিফকে বলা হতে থাকল বহিরাগত। এই সেদিনের আওয়ামী লীগার! তাকে জেলা সেক্রেটারির মতো পদে রাখা ঠিক না। সেই টার্মে হানিফের পদটা টিকেছিল। কিন্তু তাকে জনপ্রতিনিধি হবার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলেও আওয়ামী লীগেরই অন্য নেতারা তলে তলে বিপক্ষে কাজ করে হারিয়ে দিয়েছিল তাকে।

সেবার প্রবল প্রতাপে ক্ষমতায় এলো বিএনপি-জামায়াত জোট। তখন আবার আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা হানিফের পেছনেই লুকিয়ে গা বাঁচায়। যত আন্দোলন-সংগ্রাম, ঝুঁকি, সব বহন করতে হয় হানিফকে। সেই অবস্থাতেও দল পুনর্গঠন করেছে হানিফ। ধরে রেখেছে কর্মীদের মনোবল। ২০০৮-এ আবার যখন মনোনয়নের পালা এল, হানিফ মনোনয়ন পেল। আর তখন দলবেঁধে আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা নেতারা হামলে পড়ল হানিফের মনোনয়ন বাতিলের জন্য। তারা সাথে নিয়ে গেল একজন হেরোইনখোরকে। সেই হেরোইনখোর একসময় যুবলীগ করত। পরে নেশার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে সব খোয়ানোর পরে নিজের বউকে বাধ্য করতে চাইছিল কলগার্ল বানাতে। মেয়েটি আশ্রয় পেয়েছিল হানিফের কাছে। এক পর্যায়ে লোকজনের নানা রসালো কথাবার্তা এড়াতে হানিফ বিয়ে করেছিল সেই মেয়েটিকে। এবার সেই হেরোইনখোরকে সঙ্গে নিয়ে জেলা আওয়ামী জোট হাজির হলো সুধা সদনে আর নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে। শেখানো-পড়ানো ছেলে। তাছাড়া মাদকসেবীরা খুব সাজিয়ে-গুছিয়ে অবিশ্বাস্য সুন্দর ভাবে মিথ্যা বলতে পারদর্শী হয়। সে নেতা-নেত্রীদের বাড়িতে ঢোকে, তারপর ঘরভর্তি মানুষজনের সামনে নেতা বা নেত্রীর পা চেপে ধরে আহাজারি করে, আমার নেতা হানিফ আলী শেখ ছিনিয়ে নিয়েছে আমার বউকে। আমি বিচার চাই। ব্যস, হানিফের মনোনয়ন বাতিল।

শুধু বাপ্পী বা হানিফ নয়, আমি শত শত লোকের সাথে কথা বলেছি যারা বাম রাজনীতি ছেড়ে বিএনপি আ আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। বেশিরভাগ-ই ঠিক স্বস্তিতে থাকতে পারেন না। অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি কাজ করেও বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কাছে ঠিকমতো মূল্যায়িত হন না। এই দুই দল যখন বিরোধী দলে থাকে, তখন সামনের কাতারে থাকে বামদল থেকে যাওয়া নেতা-কর্মীরা। তখন সব সিনিয়র নেতারা তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যে-ই ক্ষমতায় বসা, সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় তাদের চেহারা। গর্তের ভেতর থেকে পিল পিল করে বেরিয়ে আসে তারা। সোজা গিয়ে বসে কুরসিতে। চক্ষুলজ্জা বা ভদ্রতার কোনো বালাই নেই। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, কেন্দ্রিয় নেতারাও সেটাকেই সঠিক বলে মেনে নেন। আসলে বিএনপি-আওয়ামী লীগ আর বামপন্থী দলগুলো কেবলমাত্র দল হিসাবেই আলাদা নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আলাদা। এই দুই সংস্কৃতি কোনোদিনই মিলিত হবার নয়।

অনেক বছর সময় লাগলেও সিপিবি তা বুঝতে পেরেছে। আর এখন সেটা বোঝার পরেও ক্ষমতার এঁটো-কাঁটা থেকে নিজেদের ছাড়ানোর কথা ভাবতে চাইছেন না মেনন-ইনু-বড়ুয়ারা। ছাত্র ইউনিয়ন বা অন্য বাম ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি-র নেতা হবার খায়েশ পোষণ করলে গত ২৯ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। আমি কি ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম? যারা এমন প্রশ্ন করবেন, তাদের কাছে আমার পাল্টা প্রশ্ন-- রাজনীতি পর্যবেক্ষণ ছাড়া কি লেখকসত্তা পূর্ণতা পায় আমাদের মতো দেশে? চলবে

লেখক: কথাসাহিত্যিক